বিশেষ কলাম

ইসলামী ব্যাংকের টাকা লুট আর পটিয়ার গণনিয়োগ একসূত্রে গাঁথা

মোসলেহ উদ্দিনঃ ইসলামী ব্যাংকের টাকা লুট আর পটিয়ার গণনিয়োগ একসূত্রে গাঁথা – ২০১৭ সালের ৫ই জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক অঘটনটি ঘটে। এ বছরই শেষের দিকে পটিয়া থেকে ব্যাংকের লোক আসা শুরু হয় দলে দলে।

কোন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই, কোন ইন্টারভিউ নেই শুধুমাত্র পটিয়ায় স্থাপন করা বক্সে সিভি ড্রপ হলেই চাকরি। সামিয়ানা টানিয়ে নিয়োগ পত্র বিতরণের আনুষ্ঠানিকতা এবং সাথে বিরিয়ানি পার্টি। সে কি আনন্দ তখন পটিয়ার আকাশে বাতাসে!

এরপর অবস্থা এমন দাড়ায় যে কোন শাখায় কতজন লোকের প্রয়োজন কিংবা সেখানে আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা সেটার কোনো হিসাব ছিল না কারোর মাথায়।

এমনও দেখা গেছে যে চাকরিতে জয়েন করার পর প্রধান কার্যালয় থেকে ফোন করে বলা হয়েছে অমুক আপনার সাথে জয়েন করেছে, তার কিন্তু আবেদন করা হয়নি। আপনি আবেদন পত্রটি নিয়ে প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিন। অবাক হয়ে ভাবতাম, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে অথচ আবেদনই করেনি এ কেমন কথা? কিন্তু সাথে সাথে সেই ভাবনাটাও মন থেকে বাদ দিতাম। কারণ সে নিয়ে ভাবনাটাও ছিলো অপরাধ।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এরপর দেখে তাকে বলতাম ভাই আপনার আবেদন পত্র দিন। প্রধান কার্যালয়ে পাঠাতে হবে। পাল্টা প্রশ্ন হতো, আবেদন পত্র কিসের স্যার? অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার তো আমার হাতে? মানে আবেদনপত্রের আগেই অগ্রিম অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার!

বুঝিয়ে বলেছি, ফরমাল আবেদন করাটা চাকরির প্রাথমিক শর্ত। কাগজপত্র যাই আছে তাই সাথে নিয়ে একটি দরখাস্ত তৈরি করে দিন। এরপর বেকুবের মত হা করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।

অগত্যা পুরাতনদের কাউকে ডেকে বলতাম, উনার আবেদন পত্রটি তৈরি করে দিন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে চাকরিতে জয়েন এরপর আবেদন পৃথিবীর কততম আশ্চর্যজনক ঘটনা হতে পারে ভাবুন!

বিশেষ বিবেচনায় চাকরি পাওয়া এইসব কর্মীদের হেডমের কিন্তু শেষ ছিল না। গ্রাহকের সাথে হেডম, সহকর্মীদের সাথে হেডম এমনকি শাখা ব্যবস্থাপকের সাথেও। কোথাও কোথাও জোন প্রধানদেরকেও পর্যন্ত ওরা চাপের মধ্য রাখতো।

মন চাইলেই ছুটিতে চলে যাওয়া, একদিনের ছুটিতে গিয়ে তিন দিন কাটানো, তিন দিনের ছুটিতে গিয়ে এক সপ্তাহ! আবার কোন প্রকার ছুটি ছাড়াই অনির্দিষ্টকাল অনুপস্থিতি! এমন নিত্য অভিজ্ঞতা ছিল ম্যানেজারদের।

সবচেয়ে অসুবিধার কথা তারা কাস্টমার সার্ভিস শিখতে চায়নি। নিজেদের মাঝে পেশাদারিত্বের উন্নয়ন ঘটাতে চায়নি। ভাষাগত আঞ্চলিকতা কাটিয়ে বাংলাদেশী হতে চায়নি। যে কারণে গ্রাহকরা তাদের একদম পছন্দ করত না।

আমরা একেক জন একেক জন অভিজ্ঞর পিছনে লাগিয়ে বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়ে কাজ শিখিয়েছি। আচরণগত সভ্যতা যতটা সম্ভব শিখিয়েছি। পেশাদারিত্বের গুণাবলী অর্জন করতে সহযোগিতা করেছি।

আমাদের কম্প্রমাইজের পর কম্প্রোমাইজ এবং সহযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে ধীরে ধীরে ওদের অনেকে কাজ করার উপযোগী হয়ে ওঠে। সম্পর্কের আন্তরিক পরিবেশও কিছুটা উন্নত হয়।

এস আলম কর্তৃক ব্যাংক দখল করে নেওয়ার বাস্তবতা আমরা মেনে নিয়েছিলাম। কারণ ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারের সর্বতো আনুকুল্য নিয়ে রাতারাতি যিনি ব্যাংকটির মালিকানায় বসেছেন তাকে তখনকার পরিস্থিতিতে অবজ্ঞা করে কিছু করার সুযোগ ছিল না।

তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে আমরা ঝুঁকিটা নিতে চাইনি। পরিবর্তিত ম্যানেজমেন্টের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছি। অনেক ভয়-ভীতি এবং চোখ রাঙানো সহ্য করছি দাঁতে দাঁত কামড়ে। কিন্তু আমরা বিদ্রোহ করিনি।

প্রমোশনের পথে নানা নতুন পদের খানাখন্দক তৈরি করে আমাদের সামনে অগ্রসর হবার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একই সাথে আবার লেটারেল এন্ট্রি নামে আরেক গ্রুপকে ডাইরেক্ট বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের পরবর্তী প্রোমোশনের জায়গা গুলোতে। নিয়তি হিসেবে এর সবকিছুই মেনে নিতে হয়েছে।

এর মাঝে আবার একটি সুবিধাবাদী শ্রেণী দখলদারের সাথে আঁতাত করে বছরের শুরুতে একবার শেষে একবার প্রোমোশন বাগিয়েছেন। বিদেশ সফর এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং সবকিছুই ছিল তাদের দখলে।

এরা শুধু নিজেদের সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে নিতেন তা নয়, অন্যের কপাল ভাঙতে তৎপর ছিলেন। জামাত কিংবা তাদের ভাষায় তথাকথিত জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে চাকরি খাওয়া, পানিশমেন্ট ট্রান্সফার এবং নিদেন পক্ষে প্রমোশন ঠেকিয়ে দেওয়া সবাই হতো তাদের হাত ধরে।

বছর বছর প্রমোশনের আনুষ্ঠানিকতার নামে যা হতো তা শুধুমাত্র পটিয়াবাসী, কোম্পানি মালিক এবং তাদের পা চাটা গোলাম ও কোম্পানিকে সুবিধাদাতা আস্থাভাজনদের জন্য। তাও আমরা মেনে নিয়েছি শুধু ব্যাংকেরই স্বার্থে।

আমরা বুঝে নিতাম এই বলে যে, ব্যাংকটি বেঁচে থাকলে একদিন সকল বৈষম্যের অপনোদন হবে। আমরা একবারে সরে গেলে কিংবা চাকুরিচ্যুত হলে আর কিছুই করার থাকবে না। আর ব্যাংকেও বাঁচবে না।

টুকটাক ভিন্নমত এবং প্রতিবাদের ফলস্বরূপ অনেক সিনিয়রদের চাকরিচ্যুতি এবং গ্রেপ্তার হবার উদাহরণও তো আমাদের চোখের সামনেই ছিল। হাউসফুল কনফারেন্স হলে ভাড়াটে ডাইরেক্টরা আমাদের থ্রেড করতেন।

পুলিশ, এনএসআই, ডিজিএফআই, সরকার, রাজনীতি এবং বিচার বিভাগের পক্ষপাত দুষ্ট আচরণের মুখে সাধারণ ব্যাংকারদের পক্ষে কতটাই বা করার থাকে? হ্যাঁ, আমরা অসহায় হয়ে পড়েছিলাম।

কোন এক পর্যায়ে আমরা বুঝতে পারছিলাম ব্যাংকের তহবিল নিয়ে নয় ছয় হচ্ছে। এস আলম এবং তার সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নামে বড় বড় বিনিয়োগ যাচ্ছে। কিন্তু সেসব একেবারে নিয়ম মেনে হচ্ছে না তা কিন্তু আমরা অনুমান করতে পারিনি।

ফের যখন বুঝতে পারলাম তখন তো সব শেষ! তখন তো বিদ্রোহ করেও কোন লাভ ছিল না। তখন আবার প্রশ্ন আসে ব্যাংকটিকে তাহলে বাঁচিয়ে রাখবে কে? ২০২২ এর ভয়ঙ্কর নভেম্বরের জালিয়াতির ব্যাঁকটিকে টিকিয়ে রাখা শেষ চ্যালেঞ্জ ছিল।

ব্যাংক এবং একই সাথে আমাদের চাকুরী বাঁচানোর স্বার্থে বিদ্রোহের তকমাটা আমরা নিতে চাইনি। একজন বড় ব্যবসায়ী ব্যাংকের মালিকানায় আসার পর আমাদের আশা ছিল তার ব্যবসায়িক স্বার্থে হলেও অন্তত তিনি ব্যাংকটি টিকিয়ে রাখবেন। যে ব্যাংক তাকে ক্ষুদ্র থেকে অনেক বড় অবস্থানে নিয়ে এসেছে সেই ব্যাংক তার কাছে নিরাপদ থাকবে বলে আমরা মনে করছিলাম।

দেশের অনন্য সুনাম বহনকারী সর্বাঙ্গীণ সুন্দর, সবচেয়ে লাভজনক এবং আন্তর্জাতিক মানের একটি ব্যাংক এভাবে নিজ হাতে কেউ ধ্বংস করে দেবার জন্য মালিক হবে সেটি আমরা শুরুতে বিশ্বাস করতে চাইনি।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখলাম ব্যাংক থেকে টাকা সরাবার জন্যই তিনি ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। টাকা সরাবার পরিবেশটাকে নির্বিঘ্ন করার জন্য নিজ এলাকার লোক এবং নিজ আস্থাভাজনদের ঢালাওভাবে নিয়োগ দিয়েছেন এবং প্রোমোশন পোস্টিং দিয়েছেন।

এরপর সুযোগমতো তিনি টাকা নিয়ে সরে পড়েছেন। বছর দুই আগেই দেশের নাগরিকত্ব সারেন্ডার করেছেন। ২৪ শের জুলাই আন্দোলনের উত্তাপ তার গায়ে লাগেনি। সেদিক থেকে তাকে ভাগ্যবানই বলতে হয়।

জবরদস্তি মূলকভাবে প্রায় আটটি ব্যাংকের মালিকানায় প্রভাব বিস্তার করে সোয়া ২ লক্ষ কোটি টাকা কামিয়ে দেশ ছেড়েছেন আগেই। তার অবৈধ উপায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত লোকদের এ নিয়ে এতটুকুও লজ্জাবোধ নেই সেটা দেখে অবাক হই! কিন্তু তাদের কিছু লাগেনা।

২০২৪ এর জুলাই বিপ্লবের পর ওদের মনে ভয় ধরে গিয়েছিল যে চাকরিটা থাকে কিনা? কারণ তারা তো জানত কতটা অপরাধী তারা? কিন্তু ম্যানেজমেন্টের আনুকূল্য আগ্রহে এদের বিরুদ্ধে কোন উস্কানিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি।

লুটেরা এস আলমের লুট পাটের কারণে কারণে ব্যাংকের এখন ক্রান্তিকাল চলছে। সংকট কাটাতে এস আলমের নিয়োগক কর্মীদের ভালোভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না নানা কারণে।

২৪ এর বিপ্লব উত্তর বাংলাদেশের কোন ব্যাংকের কাউন্টারে দেখতে গ্রাহকরা আর তাদের মেনে নিতে চান না। মার্কেটিংয়ে পাঠালে তো সর্বনাশ! প্রায়ই হিতে বিপরীত ঘটনা ঘটে। মাঠের মার্কেটিংয়ে ওনাদের দেখলে গ্রাহকেরা একাউন্ট বন্ধ করে দেবার হুমকি দেয়।

আবার সংশ্লিষ্টদেরও এ নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ওরা শাখায় আসে যায়, চাকরি করে এবং বেতন পায়। এতেই ওরা সন্তুষ্ট। কোথায় টাকা গেছে কোত্থেকে কি হচ্ছে এসব নিয়ে তাদের মাঝে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় না।

একটু চাপে থাকলেও ভেতরে ভেতরে তারা আবার সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছে বলে বুঝা যায়। তারা মনে করে ভারতে পালিয়ে থাকা আপা অচিরেই ফিরবেন এবং সাথে তার ক্যাশিয়ার এস আলমও ফিরবেন। এমন মনোভাবাসম্পন্ন লোকদের নিয়ে ব্যাংকের মাথাব্যথা তো কিছুটা ছিলই।

তাই হয়তো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোন প্রকার পরীক্ষায় না বসাদের একটু যোগ্যতা যাচাই করে দেখতে চেয়েছিল ব্যাংক। সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে না নিয়ে নিলো তারা সম্পূর্ণ নেতিবাচক ভাবে। প্রচার দিল যে তাদেরকে চাকরি থেকে ছাটাই করতেই পরীক্ষার ব্যবস্থা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

ফলস্বরূপ হুমকি ধামকিসহ এমন কিছু নেই যে তারা করেনি। তাদের মিথ্যাচার ও দুর্বৃত্তপনার আক্রোশ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট, ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা থিং ট্যাংকার, উদ্যোক্তা অভিভাবক সংগঠনসহ কেউ বাদ যাচ্ছে না।

ব্যাংকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কাজে লাগাবার জন্য প্রাথমিকভাবে এদের হাতে প্রায় ২ কোটি টাকার তহবিল আছে। সেই তহবিল খরচ করে তারা নানা প্রকার ধ্বংসাত্মক কাজে হচ্ছ এবং ভবিষ্যতেও হবে।

ব্যাংকের ফেসবুক পেজ হ্যাক করে চাকরিরচ্যূতদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবির বিষয়টির সাথে এদের ষড়যন্ত্র সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এতে আছে সিস্টেম হ্যাকিংয়েরও হুমকি।

মানবিকতার নামে কেউ কেউ এদের ছাড় দিতে চাইতে পারেন। আসতে পারে নানা দিক থেকে চাপও। তবে আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এসব বিদ্রোহী বিশৃংখলদের এখন ছাড় দিলে পরবর্তী পরিস্থিতি হবে আরো ভয়াবহ।

এমতাবস্থায় ব্যাংক তহবিলের প্রকৃত যোগানদাতা মালিক গ্রাহকগণ এবার মাঠে নেমেছেন লুটেরাদের বিচারের দাবিতে। তারা চাকরি-বাতিল চাইছেন জবরদখলকারী লুটেরার মাধ্যমে অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্তদের। এবার দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়?

লেখক: মোসলেহ উদ্দিন, ব্যাংকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button