ব্যাংকার

চেক লিখতে না পারা ছেলেটিই এখন ব্যাংকের ম্যানেজার!

নবম-দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বাবা একদিন একটি চেক লিখতে দিয়েছিলেন। যতটুকু মনে আছে, চেকটি অগ্রণী ব্যাংক, নন্দলালপুর শাখার। চেকের পাতাটি যখন হাতে দিলেন, আমি তাতে কিছু না লিখে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দেখছিলাম, কোথায় কি লিখতে হবে। কারন কোথাও ভুল করা যাবে না। একেতো ভুল করলে ব্যাংক তা গ্রহণ করবে না, তার উপর আগামী ছয় মাস কেবল খোটা শুনতে হবে “এই না ছেলের লেখাপড়া”!

অনেকক্ষণ চেকের পাতাটি ভালো মতো দেখে নিশ্চিত হলাম কোথায় কি লিখতে হবে। বাবা মেজিস্ট্রেটের মতো করে পাশে বসা! গা থেকে কেমন একটা চিকন ঘাম বের হতে চেষ্টা করছে। একটা সময় বাবা বলে উঠলেন, “কি মশাই, লিখছেন না কেনো?” বললাম- “বাবা এইতো লিখছি, ব্যাংকের বিষয় তো,তাই একটু ভালো করে দেখে নিলাম”।

অতপর লিখতে শুরু করলাম। সবার প্রথমে লিখলাম অঙ্কে টাকার পরিমান। সিক্স লিখে চারটি জিরো। মানে সিক্সটি থাউজ্যান্ড টাকা। খুব সুন্দর করে সিক্সটির পরে একটি কমা দিলাম। দুর্ভাগ্যবশত কমাটি জিরোর সাথে লেগে নাইন হয়ে গেলো। যার ফলে টাকার পরিমানটি গিয়ে দাড়ালো ঊনসত্তর হাজারে! ব্যাপারটি আমার চোখে পড়লো না, বাবারও না। তারপর লিখে ফেললাম কথায়। শাট হাজার টাকা মাত্র। এখানে “ষ” এর স্থলে “শ”। এবার “অথবা বাহক কে” কথাটির পূর্বে বাবার নামটি খুব যত্ন করে লিখলাম। খুব ধীর গতিতে লিখছিলাম যাতে লেখাগুলো সুন্দর হয়। হলো তাই। সব শেষে তারিখ লিখতে গিয়ে একটু কাটাকাটি হলো আর তাতেই বাবা রেগে উত্তেজিত হয়ে গেলেন!

তারিখটি একটানে কেটে তার নিচে লিখে বাবা নিজে স্বাক্ষর দিলেন। সর্বশেষ স্বাক্ষর দেয়ার নির্ধারিত স্থানে স্বাক্ষর দিয়ে বললেন “চলো ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে আসি”। অনিচ্ছা সত্বেও বাবার সাথে যেতে হলো। ব্যাংকে ঢুকে প্রথমে টোকেন নিতে হলো। যে লোকটি টোকেন দিলেন, আমার কেনো যেনো মনে হলো সে তার রেজিষ্টারে ঊনসত্তর হাজার লিখলেন। পেচানো লেখার কারনে বিষয়টি তখনো বাবার দৃষ্টিগোচর হলো না।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

অনেক্ষণ ক্যাশ কাউন্টারের সামনে লাইনে দাড়িয়ে থাকার পর কাউন্টারের ভিতর থেকে বাবার নাম ধরে ডাক শুনা গেলো। ক্যাশিয়ার সাব টোকেন নিয়ে টাকা বুঝিয়ে দিলেন। এবার বাবা টাকাগুলো গোনতে শুরু করলেন। একবার দুইবার তিনবার গোনলেন। আমি তাকে বললাম এতো বার গোনা লাগে নাকি?

বাবা উত্তরে যা বুঝালো তার মানে হলো, নয় হাজার টাকা বেশি। এটা নিশ্চত হয়ে বাবা এমন একটা ভাব নিয়ে সরাসরি ম্যানেজারের রুমে গেলেন, মনে হলো আজ ক্যাশিয়ারের গোষ্ঠী উদ্ধার করবেন!

ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে ভাই? বাবা নয় হাজার টাকা দিয়ে একদমে একগাদা উপদেশ- পরামর্শ দিয়ে দিলেন। ম্যানেজার ক্যাশিয়ার সাহেবকে ডেকে আনলেন। সবকিছু শুনে তিনি ম্যানেজারকে জানালেন সে রাইট এমাউন্টই পেমেন্ট করেছেন। ম্যানেজার সাব নিশ্চিত হওয়ার জন্য চেকটি দেখতে চাইলেন।

চেকটি দেখে তিনি যা আবিস্কার করলেন- প্রথমত চেকটিতে কথায় এবং অঙ্কে লেখার মিল নেই। কথায় (শাট) মানে ষাট হাজার এবং অঙ্কে সিক্সটি নাইন থাউজ্যান্ড। দুই লেখায় টাকার পরিমানের মিল নেই। দ্বিতীয়ত “অথবা বাহক কে” লেখাটির পূর্বে একাউন্ট হোল্ডার নিজে উত্তোলন করলে “নিজ” এবং বাহক উত্তোলন করলে বাহকের নাম লিখতে হয়। এখানে নিজের পরিবর্তে নাম লেখা হয়েছে। তৃতীয়ত কিছু বাংলায় আর কিছু ইংরজিতে।

এইবার ম্যানেজার সাব বাবাকে উল্টো ধোলাই দিলেন! কে লিখছে এই চেক? একটা চেক লিখতে জানেন না, এই ভাবে কেউ চেক লিখে? একটি চেকে এতগুলো ভুল থাকলে চলে? পরবর্তীতে যেন এমন ভুল আর না হয়, সে সম্পর্কে কতগুলো উল্টো উপদেশ গিলে বাবা ম্যানেজারের রুম থেকে বের হলেন।

আমরা যখন টাকা নিয়ে ব্যাংক থেকে বের হচ্ছি, পেছন থেকে শুনছিলাম ম্যানেজার সাব টোকেন দাতা, লেজারে এন্ট্রিকারী কর্মকর্তা এবং ক্যাশিয়ারকে ইচ্ছে মতো ধমকাচ্ছেন। এতোগুলো ভুল থাকা সত্বেও কীভাবে চেকটি পেমেন্ট হলো…………….!

আমরা বেড়িয়ে গেলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর ভাবলাম এই মুহূর্তে বাবার সাথে বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না এবং সে মতেই কেটে পড়লাম। নিয়তির নির্ধারনে সে দিনের সেই চেক লিখতে ভুল করা ছাত্রটিই আজ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একটি শাখা ম্যানেজার।

রোজ রোজ আমার বাবার মতো অনেকেই ব্যাংকে আসে। কেউ চেক লিখতে পারে না, কেউ বা জমা স্লিপ। কেউবা তার ছেলের পাঠানো রেমিটেন্স উত্তোলনের ফরমটা ফিলআপ করতে হিমসিম খায়। আমাদের সরকারী ব্যাংকে না পারা, না জানা লোকদেরই সমাগম বেশি।

তাদেরকে অবহেলা না করে যদি একটু সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেই, মনে হয় আমার বাবাকেই সাপোর্ট দিচ্ছি! তারাও মন ভরে দোয়া করে যায়। আসুন আমরা সবাই বদলে যাই, পরবর্তী প্রজম্ম একটি পজেটিভ বাংলাদেশ পাবে।

লেখকঃ মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন
ব্যবস্থাপক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, বাতাকান্দি শাখা, কুমিল্লা উত্তর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button