বিশেষ কলাম

ব্যাংকার বহি সাক্ষ্য আইন, ২০২১ প্রসঙ্গে

কাজী মাহমুদুর রহমানঃ বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ ১১ জানুয়ারি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে কার্যরত সব ব্যাংক কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংকার বহি সাক্ষ্য আইন, ২০২১ অবগতি ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে।

ব্যাংকার বহি সাক্ষ্য আইন, ২০২১ হলো পরিমার্জিত/সংশোধিত কার্যবিধিমূলক আইন; যা একাদশ জাতীয় সংসদের পঞ্চদশ অধিবেশনে ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাস হয়েছে। এটা নতুন আইন নয়, এর আগে এর নাম ছিল ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৯১; যা রহিত করা হয়েছে। আইনটি অবিলম্বে কার্যকরের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কী আছে আইনটিতে, কেন আইনটি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আইনটির সীমাবদ্ধতাই-বা কী?

এরই মধ্যে অনেকে মনে করতে শুরু করেছেন ব্যাংকস্থিত গ্রাহকদের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ব্যাংকার বহি সাক্ষ্য আইন, ২০২১ পাস করা হয়েছে। এরই মধ্যে বেশকিছু পত্রিকায় সেই ধারণাপ্রসূত সংবাদ ছাপানোও হয়েছে। একটি পত্রিকা বলেছে, অনুমতি ছাড়া ব্যাংক গ্রাহকের তথ্য প্রকাশে তিন বছরের জেল। ধারণাটা সঠিক নয়। আইনটি গ্রাহকের তথ্য সংরক্ষণ বা তথ্য নিরাপত্তাজনিত উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়নি। তাহলে সঠিকটা কী? সঠিক বিষয়টি জানার জন্য ইতিহাস দেখতে হবে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমল শেষ হয়ে রানীর অধীন ব্রিটিশ শাসন ‍শুরু হয় ১৮৫৭-এর পরপর। তখন কলকাতা ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের রাজধানী। নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ নাগরিক ও দেশীয় (ভারতীয়) ব্যবসায়ীদের দ্বারা। যত বেশি ব্যবসা তত বেশি মামলা-মোকদ্দমা। ফলে মামলা-মোকদ্দমা বেড়ে গিয়েছিল। আদালত পাড়াগুলো ছিল তখন রমরমা। বিচারকার্য যেহেতু ভারতীয় ভূখণ্ডে হচ্ছিল তখন সাক্ষ্য প্রদান ছিল ভারতীয় প্রচলিত আইনে। সমস্যা হয়েছিল ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য, যারা আদালতে ভারতীয় প্রচলিত সাক্ষ্য প্রদান প্রক্রিয়া বা সাক্ষ্য নীতি বুঝতে পারছিল না। সহজে বোঝার জন্য ব্রিটিশ সরকার নিজ উদ্যোগে প্রচলিত সাক্ষ্য নীতিগুলোকে ইংরেজিতে সংকলিত করে এবং পার্লামেন্ট কর্তৃক পাস করিয়ে নেয়। যার নাম দেয়া হয় ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

ভারতীয় সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এর সম্পাদক ছিলেন জেমস ফিটজেমস স্টিফেন। সম্পাদনা শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে, কারণ ব্রিটিশ শোষণামলের আগে থেকে, অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকে বিচারকার্য পরিচালনায় ভারতীয় নীতি প্রচলিত ছিল। জেমস ফিটজেমস স্টিফেন সেই প্রচলিত সাক্ষ্য নীতি সংকলিত করেন এবং লিখিত আকারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস করান। এতে আদালত তার মামলার কাজ পরিচালনার জন্য লিখিত ও সর্বজনীন নির্দেশনা বা গাইড পায়। ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচার পদ্ধতি পরিচালনার জন্য ভারতীয় সাক্ষ্য আইন সাহায্যকারী আইন (কার্যবিধিমূলক আইন) হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। আইনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, জম্মু ও কাশ্মীর ব্যতীত সব জায়গায় বলবৎ ছিল। সাক্ষীর মৌখিক ও দাখিলীকৃত তথ্যের পরীক্ষণ, অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি, তথ্যের গ্রহণ বা বর্জনের মূলসূত্র, প্রমাণের দায়ভার নির্দেশ করা এবং বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা নির্ধারণ করাই হলো ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ বলা যায়, সাক্ষ্য আইন স্থির করে দেয় মামলায় প্রমাণ হিসেবে—১) কোন তথ্য দেয়া যাবে ও কোন তথ্য যাবে না; ২) যদি প্রমাণ করা যায় তবে কী রূপ সাক্ষ্য দ্বারা তা প্রমাণসাপেক্ষ হবে; ৩) কে কীভাবে ওই সাক্ষ্য দেবে।

আরও দেখুন:
ব্যাংকার বহি সাক্ষ্য আইন, ২০২১

প্রায় ১৯ বছর পরে ব্যাংকার্স বুুক এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৯১ সম্পাদিত হয়। কেন সম্পাদিত হয়? কী প্রয়োজন ছিল? ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২-এ বলা হয়েছে, প্রমাণের জন্য ব্যাংকের মূল লেজার বহি মূল সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে হাজির করতে হবে। ব্যাংকের লেজার বহি হলো এক প্রকার পাকা হিসাব রেজিস্টার বহি, যেখানে যথার্থ নিয়মমাফিক গ্রাহকের হিসাব-হিসাবায়ন লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ থাকে। এ বহি যথেষ্ট নিরাপত্তার সঙ্গে রাখা হয়। নির্ধারিত ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ছাড়া এ বহির হিসাব কর্তন বা সংযোজন করা যায় না। বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের হিসাব লেজার কম্পিউটারভিত্তিক। ফলে পাঠকের হয়তো এ আইনের প্রেক্ষাপট বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। যাহোক, ওই সময়ে ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২-এর কারণে বিচারকের সামনে সাক্ষ্যপ্রমাণের জন্য এত বড় বড় লেজার বহি কুলি দ্বারা নিরাপত্তাবেষ্টনীযুক্ত আদালতে হাজির করতে হতো।

যেদিন লেজার বহি আদালতে হাজির করা হতো, সেদিন ব্যাংকগুলোয় গ্রাহকসেবা প্রদান বন্ধ থাকত। প্রয়োজনের সময় গ্রাহক টাকা পেতেন না। চাহিবামাত্র গ্রাহকের নিজস্ব টাকা না পাওয়ার কারণে ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা দেয়। এ সমস্যা দূরীকরণের জন্য ১৮৯১ সালে ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্ট পাস হয়। এ নতুন/অতিরিক্ত আইনে বলা হলো, ব্যাংকের হিসাব প্রদানের জন্য লেজার বহি আদালতে আনতে হবে না। বিচার্য হিসাবটি আদালত দেখতে চাইলে তা ব্যাংকের ম্যানেজার বা প্রধান হিসাবরক্ষক সত্যায়িত অনুলিপি আদালতে দাখিল করে বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারবেন। আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য আদালত তলব করলে ম্যানেজার বা প্রধান হিসাবরক্ষক এই বলে ঘোষণা দেবেন যে দাখিলকৃত হিসাব ছাড়া ওই হিসাবধারীর আর কোনো হিসাব ব্যাংকে পাওয়া যায়নি। অতএব, ব্যাংকারদের সুযোগ-সুবিধার জন্য ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্ট পাস ও কার্যকর হয়।

আলোচ্য আইনে যা বলা হয়েছে
আইনের ধারা বর্ণনার ধারাবাহিকতায় নামকরণের পরপরই সংজ্ঞার অবতারণা হয়েছে। আগের আইন থেকে এ আইনে নতুন যেসব সংজ্ঞা সংযোজন করা হয়েছে তা হলো, ইলেকট্রনিক স্বাক্ষর, উপাত্ত, কম্পিউটার সিস্টেম, গ্রাহক, গ্রাহক তথ্য, ব্যক্তি, তফসিল সম্পর্কিত আইনের তালিকা। সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেশ কতগুলো সংজ্ঞার আধুনিকায়ন করা হয়েছে—আইনি কার্যক্রম, প্রত্যয়িত অনুলিপি, প্রত্যয়িত অনুলিপি প্রদানকারী, ব্যাংক ও ব্যাংকার, ব্যাংকার বহি প্রভৃতি।

‘গ্রাহক তথ্য’ সংজ্ঞা হলো ব্যাংকারের বহিতে লিপিবদ্ধ বা সংরক্ষিত গ্রাহক তথ্য (ধারা ২-১-জ)
ব্যাংক ও ব্যাংকার হলো ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ ও অন্য কোনো আইন দ্বারা ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত যেকোনো প্রকার প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩-এ সংজ্ঞায়িত যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ধারা ২-১-ট)। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, সব প্রকার জামানত গ্রহণ ও ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানই হলো ব্যাংক। নন-ব্যাংক বলে কিছু আর থাকল না। সেদিক থেকে নামকরণ আধুনিক হয়েছে।

ব্যাংকার বহি অর্থ ব্যাংকের খতিয়ান/লেজার বুক, দৈনিক বহি, ক্যাশ বুক, হিসাব বহিসহ ব্যাংকে ব্যবহূত সব ধরনের বহি ও নথি; যা লিখিত আকারে অথবা মাইক্রোফিল্ম বা ইলেকট্রিক স্বাক্ষরযুক্ত বা তথ্যপ্রযুক্তির অন্য কোনো মাধ্যমে সংরক্ষিত হয় (ধারা ২-১-ঠ)। অর্থাৎ, ডিজিটাল পদ্ধতিতে যেসব রেকর্ড হবে সেগুলোও ‘সাক্ষ্য’ হিসেবে আইনে বিবেচিত হবে।

আগের আইনে প্রত্যয়িত অনুলিপি প্রদানের ক্ষেত্রে শুধু ব্যাংকের ম্যানেজার (ব্যবস্থাপক) বা প্রধান হিসাবরক্ষক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন। এ সংস্কারিত আইনে তার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করে বলা হয়েছে, ‘ম্যানেজার (ব্যবস্থাপক) বা প্রধান হিসাবরক্ষক ছাড়াও বিভাগীয় প্রধান বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ব্যাংকার বহির কোনো এন্ট্রির প্রত্যয়িত অনুলিপি প্রদান করিতে পারবেন (ধারা ৩-১)। এছাড়া যদি ডিজিটালভিত্তিক তথ্য হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার সিস্টেম পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি কর্তৃক অরো অতিরিক্ত একটি প্রত্যয়নপত্র প্রদান করিতে হবে।’

ব্যাংকার বহি লিখিত আকারে সংরক্ষিত থাকিলে এর কোনো এন্ট্রি প্রত্যয়িত অনুলিপি প্রদানের ক্ষেত্রে ওই অনুলিপির সঙ্গে বেশ কতগুলো নির্ধারিত বিষয় নিশ্চিতপূর্বক একটি প্রত্যয়নপত্র থাকতে হবে যে এটি একটি অবিকল অনুলিপি [ধারা ৩-২ (ক)]। এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র দেয়ার আগে মূল গ্রাহকের তথ্য অবশ্যই পাকা রেজিস্টারে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে বলে অনেকে মনে করেন। ডিজিটাল সফট কপির ওপর এমন প্রত্যয়ন দিলে প্রদানকারী কি ভবিষ্যতে কোনো রকম বিপদের সম্মুখীন হবেন? কারণ ডিজিটাল সংরক্ষিত তথ্যভাণ্ডার স্থায়ী ও দৃশ্যমান বা অস্তিত্বযুক্ত হয় না।

প্রত্যয়িত ও সত্যায়িত যে নামেই ডাকা হোক না কেন, প্রত্যয়নকারীর প্রত্যয়িত অনুলিপির সঙ্গে বেশ কয়েকটি ঘোষণা আদালতে দিতে হবে। তা হলো, প্রত্যয়নপত্র ব্যাংকের কোনো একটি সাধারণ বহিতে লিপিবদ্ধ ও অদ্যাবধি ব্যাংকারের হেফাজতে রক্ষিত আছে [ধারা-৩-২ (গ)]। এ শর্ত থেকে বোঝার কোনো অবকাশ নেই ডিজিটাল হিসেবে সফটওয়্যার ব্যবহার করলেও গ্রাহকের হিসাব মুদ্রিত কপিতে সংরক্ষণ করতে হবে তামাদি না হওয়া পর্যন্ত।

ডিজিটালভিত্তিক প্রত্যয়নপত্র প্রদানের আগে ব্যাংকগুলোকে ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণের নানা আধুনিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। যেমন হ্যাকিং বা অনধিকার প্রবেশ, ভাইরাস আক্রমণ, ডিভাইস বিপর্যয়, ডিভাইস থেকে মুছে যাওয়া, হিসাবায়ন ক্রটিমুক্ত প্রভৃতি (ধারা ৩-৫)। এসব বিষয় সবসময় ব্যয়বহুল ও বিদেশনির্ভর। প্রতি বছর নতুন নতুন ভাইরাস আসে আর নতুন নতুন অ্যান্টিভাইরাস সফট কপিসহ নানা ধরনের টেকনোলজি ক্রয় করতে হয় এবং এ আইনের কারণে ক্রয়বিষয়ক ব্যয় বেড়ে যাবে। এমন ভবিষ্যত্মূলক ব্যয়ের কারণে প্রফিট ক্যালকুলেশন প্রক্রিয়ায় পরির্বতন আনতে হবে। সম্ভাব্য ব্যয় প্রভিশন আকারে রাখতে হবে। পাশাপাশি ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইস্যুতে প্রতিষ্ঠানকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইলেকট্রনিক জটিলতার কারণে কখনো কখনো জুন ও ডিসেম্বর ক্লোজিংয়ের হিসাবায়নে একটু বিলম্ব হলেও সমস্যা হবে না। কারণ আদালতে হিসাব প্রদানের সময় দেয়া হয়েছে সাত কর্মদিবস (ধারা-৬)।

আগের চেয়ে গ্রাহক তথ্য প্রকাশ করার অনুমোদিত ক্ষেত্র বাড়ানো হয়েছে নতুন আইনে। ব্যাংক যাদের কাছে গ্রাহক তথ্য দিতে পারবে তার একটি তফসিল দেয়া হয়েছে। তফসিলে বর্ণিত ক্ষেত্রগুলো হলো: গ্রাহক, মৃত গ্রাহকের মনোনীত ব্যক্তি, মৃত গ্রাহকের সম্পত্তি বিলি-বণ্টনবিষয়ক প্রশাসনিক দপ্তর, ব্যাংক মনোনীত ব্যক্তি, দুদক, কাস্টমস, মূসক, আয়কর কর্তৃপক্ষ, তদন্তে নিমজ্জিত পঞ্চম গ্রেডের ঊর্ধ্বে কোনো সরকারি কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংক, ক্রেডিট রেজিস্ট্রি বা ক্রেডিট ব্যুরো, গেজেটে প্রকাশিত সরকারি ব্যক্তি, ব্যাংক পরিষেবা প্রদানে চুক্তিবদ্ধ আইনজীবী বা পরামর্শক বা উপদেষ্টা, সেবা প্রদানকারী তৃতীয় পক্ষ, সংশ্লিষ্ট আদালত, বাংলাদেশের বাইরে নিবন্ধিত ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রক বা তদারকি কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি (ধারা-৭)। এত বড় তালিকা। কেউ বাদ যায়নি। ব্যাংকের গোপনীয়তা বলে কিছু থাকছে কি? উল্লেখ্য, ব্যাংক কোনো আইনি কার্যক্রমে অংশীদার না হলে গ্রাহকের তথ্য দিতে বাধ্য নয়।

বর্ণিত ক্ষেত্র ছাড়া কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোনো গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করলে তার সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এ আইনের অধীন অপরাধ অ-আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আদালতের সম্মতি সাপেক্ষে আপসযোগ্য হবে। অপরাধের বিচার দণ্ডবিধি, ১৮৯৮ অনুসারে হবে। উল্লেখ্য, দণ্ডবিধিতে যা-ই থাকুক না কেন অপরাধ ব্যাংক সংগঠক ব্যাংক কর্মকর্তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার লিখিত প্রতিবেদন ছাড়া কোনো আদালত এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ করিবেন না (ধারা-৮, ৯ ও ১০)। উল্লেখ না করলেই নয়, যদি ব্যাংক কর্মকার্তার কোনো কর্মে দূষণ মন না থাকে বা কোনো প্রকার ক্ষতি করার অভিপ্রায় না থাকে, সরল বিশ্বাসে আইনটি পালন করেন এবং এর ফলে গ্রাহকের যদি কোনো প্রকার ক্ষতি হয় তাহলে ব্যাংকারের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা করা যাবে না (ধারা-১১)।

ব্যাংকার বহি সাক্ষ্য আইনের শাব্দিক ব্যাখ্যা করলে ব্যাংকের হিসাব অবশ্যই বহি হতে হবে। যদিও ডিটিজাল বহি গ্রাহক সেবাদানের জন্য প্রয়োজন, তবুও তথ্য সংরক্ষণের জন্য কাগুজে দীর্ঘস্থায়ী রেজিস্টার সংরক্ষণ করতে হবে বলে অনেকে মনে করেন। যেহেতু ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ডিজিটাল সেবার দিকে এগোচ্ছে এবং ব্যাংকগুলো সফটওয়্যার কোম্পানিনির্ভর, সেক্ষেত্রে সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর দায়বদ্ধতা নিয়ে আইনটিতে কোনো প্রকার নির্দেশনা দেয়া হয়নি। প্রত্যয়নপত্রের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তামূলক নিশ্চয়তা ব্যাংকগুলোকে দিতে হবে। এ নিশ্চয়তার পেছনে ব্যয় লুকিয়ে আছে। ব্যয় থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ডিজিটাল লেজার ও কাগুজে লেজারের মধ্যে একটি সমন্বয় হয়তো করতে হতে পারে।

চলমান বিশ্বায়নের যুগে দ্রুতগতিতে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের উন্নয়নের ফলে আইসিটিভিত্তিক ব্যাংকিং এখন অপরিহার্য। অনলাইন ব্যাংকিংসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্যাদি ইলেকট্রনিক ডাটা ডিভাইসে সফট কপি হিসেবে সংরক্ষিত হচ্ছে। ফলে ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৯১ সংশোধন হয়ে ডিজিটাল ডকুমেন্ট সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হওয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করেই ব্যাংকার বহি সাক্ষ্য আইন, ২০২১ পাস হয়েছে। আইনে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোও ভালোভাবেই প্রতিফলিত হযেছে।

তবে এ লেখার সমআলোচ্য শঙ্কাগুলো আমলে এনে আইনটি আরো উন্নত করার অবকাশ রয়েছে। আমাদের দেশে আইন তৈরি করা হয় কিন্তু তা গণসমালোচনায় দিয়ে যাচাই করা হয় না। অথবা যাচাইয়ের উদ্যোগ নিলে আশানুরূপ সমালোচনা পাওয়া যায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিগূঢ় সমালোচনা গ্রহণ করা হয় না। আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতে আইন তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্ব মানসম্পন্ন আধুনিক প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করা হবে।

কাজী মাহমুদুর রহমান, ব্যাংকার ও ফ্রিল্যান্স লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button