ব্যাংকারদের সহিষ্ণু জীবন

নেটফ্লিক্সে নতুন সিরিজ়— Designated Survivor সিরিজ়ের একটা এপিসোডে দেখানো হয়, অদ্ভুত একটা ভাইরাস আমেরিকার মানুষকে মেরে ফেলছে অপরদিকে একজন সদ্য প্রেসিডেন্ট কিভাবে সামাল দিচ্ছেন!
কিছুদিন আগে রাতে এক কাপ কফিতে চুমুক দেই আর তার ঘনঘটা দেখি। সাথে চানাচুর মুড়ি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে ঘড়ির কাটার দিকে চেয়ে দেখি রাত সাড়ে তিনটা। ভাবনার সংমিশ্রণ ঘটানোর চেষ্টা করিনি বিধায় Episode-টি দেখে বুুঝিনি কোন এক সময়ে আমেরিকায় অথবা সারা বিশ্বে প্রতিফলন ঘটাবে। ভাবনায় আসেনি, সেই কল্পকাহিনীর মতোই সত্যি হয়ে আমাদের দেশেও আঘাত করবে!
যাই হোক, Social Distancing বজায় রাখার স্বার্থে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা করা হলো। সেবামুলক সকল প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হলো। ব্যাংকিং সেবাও সীমিত পরিসরে খোলা রাখা হলো। ব্যাংকিং সেবা চালু রাখার স্বার্থে ব্যাংকারদের নিরাপত্তা গৌণ হিসেবে বিবেচনা করা হলো। ওখানে Social Distancing বজায় রাখা খুব সহজ একটা বিষয় নয়। অন্যান্য দেশে ব্যাংক খোলা থাকলেও চেকের বদলে বুথ থেকেই টাকা উঠানোর পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। যদিও আমাদের দেশে এটি সম্ভব নয়। মনে হয়, সেবার মাঝে সীমাবদ্ধতা নেই বলেই জনগণ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে আগ্রহবোধ করেন না।
গত সপ্তাহের কোন একদিন আমাদের শাখায় অনেক গ্রাহক রেমিট্যান্স নেয়ার জন্য অপেক্ষারত। কিন্তু শাখার সামনে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় দূরত্ব বজায় থাকবে কি করে?
| ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
আবার এমনও গ্রাহক ব্যাংকে আসেন যারা সদ্য বিলেত ফেরত! চেক বইটা তাদের অতি জরুরী দরকার। সার্ভিস বলে কথা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাংকিং সেবাটুকু দিয়ে হাসিমুখে বিদায় করার চেষ্টা করি।
অন্য এক গ্রাহক নিতান্তই আমাকে ভালবাসেন। উনার হিসাব থেকে চার হাজার টাকা উঠানোর জন্য ব্যাংকে আসা। সেবা দিয়ে বিদায়ের প্রাক্কালে বয়স্ক লোকটি পুরনো অভ্যাস বশত পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল। করমর্দনের জন্যও হাতটি বাড়িয়ে দিল। কোনো ভাবে বলে কয়ে সেটা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি! সেবার বুকে থু থু দিয়ে নিজেকে অভয় দিলাম! আমার মত করে কয়জন পারবে নিজেকে অভয় দিয়ে চলতে কিংবা শার্টের উপরের বোতাম দুটো খুলে বুকের মাঝে হালকা থু থু দিয়ে নিজেকে বিপদমুক্ত রাখতে। আমি পেরেছিলাম! আমি ব্যাংকার, তাই পারিও বটে!
ব্যাংক থেকে বের হবার আগে চিন্তা করি, রাস্তায় তো আবার ঝামেলায় পড়তে হবে না। এত চিন্তা মাথায় নিয়ে কাজ করবো কেমনে। তাই রিক্সা নিয়ে বেমালুম রওনা দিলাম।
রিক্সায় বসে দেশের খবর দেখার জন্য মেবাইলটা হাতে নিয়ে চোখটা বুলিয়ে নেই। সাধারণত খবরের ভিতরকার সংবাদ তেমন একটা পড়া হয় না। সেদিন একটা সংবাদ দেখে চমকে উঠি এবং পড়ার আগ্রহ বোধ করি। জনগণের সেবা দেয়ার স্বার্থে কোন একজন ব্যাংকারকে ব্যাংকে যাওয়ার পথে বাঁধা প্রদান করা হয়েছে। ভাবছি, একদিকে গণপরিবহণ বন্ধ অন্যদিকে রিক্সা করে অফিসে গমণ, সে কিভাবে সম্ভব? যারা অনেক দূরে থেকে যাতায়াত করে তাদের কি হবে। আদার ব্যাপারি জাহাজের খবর নিয়ে লাভ নেই।
তাই তাড়াতাড়ি রিক্সা থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে বাসার উদ্দেশ্যে গমণ করি আর চিন্তিত মন নিয়ে ভাবি, শুনেছি; ব্রিটেনে সেবা প্রদানকারী কোন এক প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রদান কারীর ভাষায় “এটা আমি টের পেলাম সেদিন সকালে। আমি সকাল বেলা অফিসে যাওয়ার জন্য বের হই। সেদিন আমি আমার গেট বন্ধ করে রওনা দেব, এমন সময় আমি আমার প্রতিবেশীদের পক্ষ থকে হাততালি ও হর্ষধ্বনি শুনতে পেলাম। সেটা শুধু আমার পেশার কারণে। আমার চোখ আবেগে ভিজে উঠল। এমনটা কি আমি আশা করেছি কখনও?” -এটা ওদের সংস্কৃতি, আমাদের নয়!!
তারপরও ভেবে আশ্বস্থ হই, আমাদের তো বাসায় ঢুকতে অসুবিধা হচ্ছে না। না হলে পার্শ্ববর্তী দেশের মত সারাদিন ব্যাংকে কাজ করে বাসায় ফিরে আসার পর কারো কপালে তো হাউজিং সোসাইটি কিংবা বাড়িওয়ালার পক্ষ থেকে বাসা ছেড়ে দেবার মত তোড়জোড় চালানো হয় না! চিন্তা, তাদের তরেই যদি ঘটে সংক্রমণ!
ভাবি, বাহবা নাইবা দিক কিংবা রিক্সা দিয়ে নাই বা গেলাম, আমাদের দেশে তো বাসা থেকে বের করে দেবার জন্য উঠেপড়ে লাগেনি। এ বলেই নিজেকে সান্ত্বনা দেই। তারা হয়তো বুঝে, সাড়ে ছয় লক্ষ ব্যাংকারের মাধ্যমে কি আর ভাইরাস ছড়াবে! ওরা যে ভয় পেলে বুকের উপর থু থু দিয়ে ভয়কে নিবারণ করতে জানে (ছোট বেলার কল্পকাহিনী, ভর দুপুর বেলায় বুকে থু থু দিয়ে কতবার যে তেতুঁল গাছে চড়েছি তার ইয়ত্তা নেই)!
আস্তে আস্তে রাস্তা ধরে হেঁটে বাসায় যাওয়ার জন্য তাগাদা অনুভব করি। পাড়ার মুদির দোকানের দিকে তাকিয়ে ভাবি, কিছু নেওয়া লাগবে কি? কিন্তু; সারি সারি ফাঁকা তাকগুলো আমার দিকে দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করছে।
পাস্তা, লবণ, টিস্যু ইত্যাদি থাকা আর না- থাকা জীবনে কোনও প্রভাব ফেলবে না কিংবা ছয় লক্ষ ব্যাংকারদের নিরাপত্তার স্বার্থ সমাজের কাউকে প্রভাবিত করবে কিনা জানি না। তবে এ যেন নৌকার এক পাশে আমি, অন্য পাশে ফুটো হয়ে জল উঠলে আমার কি! ভাবি, বেঁচে কি এ ভাবেই থাকতে হয়?
তাই নন্দলালের ভাষায় বলতেই পারি:
নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ-
স্বদেশের তরে, যা করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।
অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক। প্রিন্সিপাল অফিসার, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, বন্দর বাজার শাখা, সিলেট।




