ব্যাংকার

করোনা’র বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ ব্যাংকিং সেবা এবং ব্যাংকারদের কিছু কথা

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এখন কোভিড-১৯ নামক এক ভাইরাসবাহী রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। এ যুদ্ধে অবতীর্ণ স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মী, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিযুক্ত বাহিনী, গণমাধ্যমকর্মী সহ জরুরী সেবাদানকারী ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠানকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। জাতির এই চরম দুঃসময়ে নিজের এবং পরিবারের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকি তথা মৃত্যুঝুঁকির এতটুকু তোয়াক্কা না করে যেসকল দেশপ্রেমিক নাগরিক এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন-করোনা পরবর্তী পৃথিবীর আমাদের ভবিষৎ প্রজন্ম তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

একজন ব্যাংকার হিসেবে দুঃখ হচ্ছে, দেশের এই ক্রান্তিকালে দেশের অর্থনীতিকে জিইয়ে রাখার স্বার্থে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকাররা অবিরত সেবা দিয়ে গেলেও করোনা যোদ্ধাদের তালিকায় নেই তাদের নাম। গত ০৯ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটা পরিপত্র জারি করা হয়, যেখানে করোনা ভাইরাস (কোভীড-১৯) প্রতিরোধের লক্ষ্যে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি এবং জনস্বার্থে চলাচল ও গমণাগমণ নিষেধাজ্ঞা অথবা নিয়ন্ত্রণ ও নিবৃত্তিমূলক যেকোন ব্যবস্থাকালে জরুরীসেবা ও সরবরাহ শৃঙখল স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে যেসব পরিষেবাসমূহ যথারীতি চালু থাকবে তার একটা তালিকা দেয়া হয়।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

একই অবস্থায় ব্যাংক কর্মীরা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে, গ্রাহক নির্বিশেষে, একনিষ্ঠ সেবা দিয়ে যাওয়ার পরও পরিপত্রে ব্যাংকের বা ব্যাংকারদের নাম না থাকাটা লাখো ব্যাংকারকে প্রচন্ড কষ্ট দেয়। দেশব্যপী বর্তমান লকডাউন পরিস্থিতি্তে সারাদেশ যেখানে স্থবির-সেখানে ব্যাংক কেন খোলা-তা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকারদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ পরিলক্ষিত হচ্ছে। একজন ব্যাংকার হিসেবে আমার মনে হয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত ব্যাংকারদের আজ যে ক্ষোভ ঘনীভূত হচ্ছে তা আসলে ব্যাংক খোলা রাখার কারণে নয়। মূল কারণটা হচ্ছে, সেবা হিসেবে ব্যাংকিং খাতের স্বীকৃতির অভাব।

গত ০৫ এপ্রিল, ২০২০ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপত্র সিরজুল ইসলামের বরাতে সময় টিভি তাদের ওয়েব ভার্সনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উল্লেখ করেন-“১। নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে ব্যাংকের ভূমিকা অপরিহার্য ২। সংকটের সময়গুলোতে মানুষের টাকার প্রয়োজন বেশী হয়”। এছাড়াও দেশের অর্থনীতির (ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক) চাকা সচল রাখতে ব্যাংকের ভূমিকা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয়না বলেই মনে হয়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

পরম করুণাময় যদি করোনা থেকে পৃথিবীবাসীকে বাঁচিয়ে দেয়, বিশ্ব অর্থনীতি নতুন করে গড়বে কিন্তু এই ব্যাংকাররাই। করোনা মোকাবেলায় সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্যাকেজ বাস্তবায়নও করবে এই ব্যাংকাররাই। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা ফাইটারদের জন্য যে স্বাস্থবীমা, অনুদান, পুরস্কার ইত্যাদি ঘোষণা দিয়েছেন তার কিছুই চাইনা আমরা। আমরা শুধু আমাদের কাজের স্বীকৃতি চাই।

দেশের যেকোন দূর্যোগকালে সবকিছু বন্ধ হলেও কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা যায়না, এটা ব্যাংকাররাও বুঝে। সম্ভবতঃ ব্যাংক বা ব্যাংকিং তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বা বিষয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর কালজয়ী ভাষণের মাধ্যমে যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন সেখানেও ব্যাংকিং সেবাকে কমপক্ষে দুই ঘন্টার জন্য চালু রাখতে বলেছিলেন। আমি নিশ্চিত, সমগ্র জাতি আজ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধে নেমেছে রাষ্ট্রের এই মহাদুর্যোদময় মুহুর্তে দেশের মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ সেবা দিতে পেরে সকল ব্যাংকারই গর্ব বোধ করে।

একজন স্বেচ্ছাসেবক বা সরকারী বেতনভূক্ত কর্মচারী দেশের ক্রান্তিলগ্নে তার সেবা দিয়ে যতটা আনন্দ লাভ করে, একজন প্রফেশনাল ব্যাংকারও দেশের স্বার্থে যেকোন পরিস্থিতিতে তার সেবা দিয়ে কম আনন্দ লাভ করে না। কিন্তু অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে নতুন এই যুদ্ধটা বোধ হয় একটু অন্যরকম। নীতিনির্ধারকদের মাঠে থাকা সেবকদের কথা শুনতে হবে। তাদের নিয়ে রণকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। খুব দ্রুততার সাথে প্রয়োজনীয় সংশোধনীও আনতে হবে।তাহলে এই যুদ্ধটা হয়তো আরো ভালোভাবে লড়া যাবে।

ব্যাংকারদের হতাশাটা বোধহয় এখানেই! তারপরও মনে হয়, সময় ফুরিয়ে যায়নি, চাইলেই কিছু উদ্বাবনী উদ্যোগ এখনও নেওয়া যায়; ব্যাংকের মতো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তথা দেশের জন্য। বর্তমানের সমস্যাটা যেমন আমাদের কাছে নতুন তার সমাধানও করতে হবে নতুন নিয়মে, গতানুগতিক ভাবে চিন্তা করলে আমরা হয়তো পিছিয়ে পড়তে পারি।

এমনিতেই বেশ লম্বা সময় ধরে দেশের ব্যাংকিং খাত এক ধরণের দুঃসময় পার করে আসছিল। মনে হয় করোনার চেয়েও মারাত্মক ঝুঁকি ব্যাংকারদের জন্য সামনের দিনগুলোতে অপেক্ষা করছে। পাহাড় সমান মন্দ ঋণ সহ বিগত সময়ের বয়ে চলা হাজারো সমস্যার সাথে সাম্প্রতিক কিছু প্রপঞ্চ যুক্ত হবে এমনটা সহজেই অনুমেয়। যেমনঃ সরকার নির্দেশিত ৬/৯ নীতির সাথে মানিয়ে নেয়া, সামনের দিনগুলোর সম্ভাব্য এবং নতুন বিভিন্ন ধরণের চ্যলেঞ্জসমূহ যেমনঃ করোনা সময়ের অর্জিত সুদ মওকুফ, অল্প সুদ বা সুদবিহীন ঋণ দেয়া, সরকারের বিভিন্ন আর্থিক প্যাকেজের সাথে সু-সমন্বয় সাধন করা, কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে আগের তুলনায় অনেক বেশী পরিমাণ আর্থিক প্রণোদনায় অংশগ্রহণ, গ্রাহকের আস্থার সংকট তৈরি হয়ে ব্যাকিং কার্যক্রম কমে যাওয়া, জমার চেয়ে উত্তোলন বেশি হয়ে লিকুইডিটি ক্রাইসিস হওয়া, ফরেন রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, পরিবর্তিত বাজার ঝুঁকির সঠিকতা বিশ্লেষণ, ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আটকে যাওয়া বিরাট অংকের রপ্তানীমূল্য (এক্সপোর্ট প্রসিড) দেশে আনার ব্যবস্থা করা এবং সর্বোপরি করোনা পরবর্তী নতুন এক বিশ্ব অর্থনীতির বিভিন্ন গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ সহ নানা ধরণের বহুমাত্রিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হবে ব্যাংকগুলোকে। এটা অবধারিত।

তবে নিরাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। প্রথম থেকে চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত নবীন-প্রবীনের সমন্বয়ে ব্যাংকিং খাতে যে মেধাবী ও দক্ষ জনশক্তি বর্তমানে কর্মরত আছে তারা এসব ভেবে হতাশ নয় বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিকতা আছে।

ব্যাংকিং যে কোন দেশের জন্য একটি অপরিহার্য সেবা। দেশের অর্থনীতিতে মূল স্ট্রাইকারের ভুমিকা পালন করে ব্যাংক। বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সুদৃঢ় কাঠামো ভিত্তিক, আধুনিক ও পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো সক্ষম ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছাড়া টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। আমদানি রপ্তানি, ফরেন রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্র/ মাঝারী/ বৃহৎ যেকোন ধরণের ব্যবসা সেটা শিল্প/ কৃষি/ ট্রেডিং যাই হোক না কেন; সবই মুখ থুবড়ে পড়বে যদি ব্যাংকিং ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে। সুতরাং ব্যাংকারদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা, তাদের গ্রাহকদের সেবা পদ্ধতি ও সুরক্ষা এবং দেশের সুরক্ষার বিষয়গুলো অবশ্যই যথাযথ কতৃপক্ষকে আমলে নিতে হবে।

দেশে সকল পেশাজীবীদের নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে। নেই শুধু ব্যাংকারদের। এবিবি (এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ) নামে সকল ব্যাংকের এম.ডি. মহোদয়গণের একটা সংগঠন থাকলেও সেটা শুধু সরকারের সাথে ব্যাংকিং সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যু সমন্বয় করে। ব্যাংকে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন বিষয় নিয়ে সরকারের সাথে কোন ধরনের দর কষাকষি করেনা। ব্যাংকারদের কথা বলারও কেউ নেই, শোনারও কেউ নেই।

পরিশেষে বলতে চাই যে, ঔপনিবেশিক আমলে আমলারাই ছিলেন সর্বেসর্বা। একাধারে বিচারক, প্রশাসক, রাজস্ব সংগ্রাহক, শান্তি শৃঙ্খলার বাহক। মিলিটারী সার্ভিস ছিল “কিংস সার্ভিস” কার্যতঃ রাজনীতি বা প্রশাসনে ব্রাত্য। পুলিশ ছিল আরো ব্রাত্যতর। পাকিস্তান আমলে অবৈধ সামরিক শাসকরা ক্ষমতা গ্রহণ করে আমলাদের নিজেদের কাজে ব্যবহার করতো৷ অন্যদিকে, বিরোধী রাজনৈতিক মতসহ দমন পীড়নের জন্য পুলিশের রাজনৈতিক গুরুত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই ধারাবাহিকতায় এখনো আর্মি, আমলা, পুলিশ — এই ট্রায়ো সার্ভিসই সর্বত্র গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, পৃথিবীব্যপী অর্থনৈতিক যুদ্ধের এ যুগে আধুনিক অর্থনৈতিক ও ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে বেশ কিছু সার্ভিস যেমন চিকিৎসা, ব্যাংকিং, টেলিকম ইত্যাদি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

কিন্তু, এদের স্বীকৃতি নেই বললেই চলে। এমনকি সব সার্ভিসের তুলনায় ব্যাংকিং এখনো তেমন গুরুত্ব পায়নি। সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের কথা খুব কমই মনে রাখে। চলমান করোনা পরিস্থিতি ব্যাংকারদের সত্যিকার অবস্থা আরো স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে। আমরা চাই, সার্ভিস হিসেবে ব্যাংকিং যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা স্বীকৃতি লাভ করুক। অন্য সকল সার্ভিসও যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি পাক। ব্যাংকাররা সকল সার্ভিসকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে। অন্যরাও ব্যাংকারদের প্রাপ্য সম্মান বা মর্যাদার আসনে রাখবেন-আমাদের প্রত্যাশা এতোটাই ক্ষুদ্র!

লেখকঃ আহাম্মেদ মেহেদী ঈমাম
এভিপি এন্ড হেড অব ব্রাঞ্চ
সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কর্মাস (এসবিএসি) ব্যাংক লিমিটেড
কুমিল্লা ব্রাঞ্চ, কুমিল্লা।

প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংক, ব্যাংকার ও ব্যাংকিং বিষয়ক চলমান খবর বা সমসাময়িক বিষয়ে আপনার লেখা ও মতামত ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ প্রকাশ করতে আমাদেরকে ই-মেইল করুন- bankingnewsbd@gmail.com আমরা আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে তা প্রকাশ করব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button