২০২১ সালে ব্যাংকগুলোর স্ফীত মুনাফার নেপথ্যে
মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ বহুল প্রচারিত পত্রিকা প্রথম আলো লিখেছে, করোনার দ্বিতীয় বছরে বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেছে। ২০২১ সাল শেষে কোনো কোনো ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মুনাফার এমন উত্থানের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে আমদানি বাণিজ্য, ব্যাংকঋণের সুদ, কমিশন ও মাশুল আদায় এবং শেয়ারবাজারের মুনাফা। সদ্যবিদায়ী বছরে এসব ব্যবসা থেকে ভালো আয় করেছে ব্যাংকগুলো। এতেই মুনাফা বেড়েছে। করোনার আগে ২০১৯ সালে বেসরকারি ব্যাংকগুলো যে মুনাফা করেছিল, সেটিকেও ছাড়িয়ে গেছে এবারের মুনাফা।
অন্যদিকে দি ডেইলি স্টার বলেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিল নীতি ব্যাংকগুলোতে বেশি মুনাফা করতে সহযোগিতা করলেও এটি সামগ্রিকভাবে এই খাতের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। বরং এতে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে, গত বছর ঋণগ্রহীতারা তাদের সবগুলো কিস্তির মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলে ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করতে পারবে না। এর বিপরীতে অপরিশোধিত বাকি ৮৫ শতাংশ কিস্তির সুদ ব্যাংকের মুনাফা হিসেবে স্থানান্তর করার অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা আদতে পরিশোধই করা হয়নি। এই প্রক্রিয়া ব্যাংকগুলোর মুনাফার অঙ্ক বাড়াতে সহযোগিতা করেছে।
আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকারদের সর্বনিম্ন বেতন বেঁধে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক
দৈনিক জনকন্ঠ রিপোর্ট করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ছাড়ের কারণে বেশকিছু ব্যাংকে অনাদায়ী সুদও আয়ের খাতে নিয়ে আসায় পরিচালন মুনাফা বেশি দেখাচ্ছে। পরিচালন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে আনার সুফলও পেয়েছে ব্যাংকগুলো। আমদানি, রফতানি, রেমিটেন্সের কমিশন থেকে প্রাপ্ত আয় ও পুঁজিবাজার থেকে পাওয়া মুনাফার প্রভাব বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় প্রতিফলিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফন হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
| ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হাজার কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে চারটি ব্যাংক। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটি ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। গত বছরও সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা করেছিল ইসলামী ব্যাংক।
পূবালী ব্যাংক গত বছরে মুনাফা করেছে ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা। আর দেশীয় মালিকানার সিটি ব্যাংক ২০২১ সালে মুনাফা করেছে ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৮০৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইস্টার্ণ ব্যাংক সদ্য বিদায়ী বছর শেষে ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। ২০১৯ সালে ব্যাংকটির এ মুনাফার পরিমাণ ছিল ৯০০ কোটি টাকা। এই ব্যাংক তিনটি করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে ডাচ্-বাংলা ও ব্র্যাক ব্যাংকেরও বড় অঙ্কের পরিচালন মুনাফা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংক দুটির একাধিক কর্মকর্তা।
এর আগে ভালো ক্লোজিং এর সূযোগ দিতে বকেয়া ঋণের ১৫ শতাংশ জমা দিয়ে নিয়মিত রাখার সুযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সুযোগের মেয়াদ কাগজে-কলমে শেষ হলেও আবারও সময় বাড়ছে। নতুন বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এই অর্থ জমা নেওয়া যাবে। সোমবার (৩ জানুয়ারি) ব্যাংকগুলোকে মৌখিকভাবে বিষয়টি অবহিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্ট (বিআরপিডি) বলে খবর বেরিয়েছে।
প্রথমে ডিসেম্বরের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে ঋণের ২৫ শতাংশ পরিশোধ করে খেলাপি না থাকার সুযোগ ছিল। তবে গত ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক আগের নির্দেশনা পরিবর্তন করে। ঋণের ১৫ শতাংশ পরিশোধ করেই খেলাপি না থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু চারদিন পরই আবার সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলো নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।ব্যাংকাররা বলছেন, অনেক গ্রাহক আশা করেছিল ২৫ শতাংশ পরিশোধ করেই খেলাপি না থাকার সুযোগের সময় বৃদ্ধি করা হবে। তাই ঋণের এক-চতুর্থাংশ টাকাও পরিশোধ করেনি অনেকে। এ সুযোগে তারা কিস্তি শোধ করতে পারবেন। পাশাপাশি খেলাপি ঋণও কমে আসবে।
এর আগে ১৫ ডিসেম্বর ব্যাংকখাতে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানোর জন্য গভর্নর বরাবর আবেদন জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআিই। সেই চিঠিতে বলা হয়, করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা বর্তমানে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে সময় পার করছেন। তাই ২৫ শতাংশ পরিশোধের শর্ত শিথিল করে ঋণ শ্রেণীকরণ সুবিধার মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। তবে ব্যবসায়ীদের সে দাবিতে সায় দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
করোনাকালীন অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় ২০২০ সালজুড়ে ঋণের কিস্তির এক টাকা শোধ না করলেও গ্রাহককে খেলাপি করতে পারেনি ব্যাংক। চলতি বছর শুরু হয় ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি ৬ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ নিয়ে। এ বছর নতুন করে আগের মতো সব সুযোগ দেওয়া হয়নি। একজন গ্রাহকের যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে তার ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলেও তাকে আর খেলাপি করা যাবে না। তবুও খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকখাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকায়। বর্তমানে তা এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সবশেষ ব্যাংকখাতের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৮.১২ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা।
টেকনিক্যালী শ্রেণিকৃত ৠণ কমবে বটে, তার বিপরীতে তিলে তিলে গড়া সঞ্চিতিও মুনাফার হিসাবে এ বছর গেল কিন্ত আবার কয়েকমাস পরেই যখন এটি পুনরায় শ্রেণিকৃত হবে তখন আবার সেই সঞ্চিতি বিল্ড করা অসম্ভব ব্যাপারই হবে। এরপরও কথা থাকে যে পরিচালন মুনাফা কোন ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। এ মুনাফা থেকে খেলাপী ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ ও কর-পরবর্তী মুনাফাই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা।
লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।






