ব্যাংকার

মওদুদ হত্যা: একটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ ও শিশুর আর্তনাদ

অনজন কুমার রায়ঃ শত বিভৎস কাজ, শত মানববন্ধন, সবকিছুই কি এক সুতোয় বাঁধা? প্রশ্নের উত্তর মেলানো ভার। বিবেকের দংশন যেখানে তাড়া করে সেখানে করুণার উর্দ্রেক হয়। যে লোকটি কিছু সময় আগেও অটো রিক্সার যাত্রী ছিল চালক তাকেই মেরে ফেলতে এতো উদগ্রীব! তাহলে যাত্রী সেবার মান তো প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যায়। গত ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সিলেট নগরীর কোর্ট পয়েন্টে এমনি এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ব্যাংক কর্মকর্তা মওদুদ আহমদকে দল বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে অটো রিক্সার পরিবহণ শ্রমিকরা। এক পর্যায়ে ব্যাংক কর্মকর্তা মওদুদ আহমদ মারা যায়। ওই এলাকার সিসি টিভির ফুটেজ দেখে খুনের ঘটনা সত্যতা প্রকাশ পায়।

ভাড়া নিয়ে দ্বন্দ্ব। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী থেকে চির বিদায়ের পথ অটো রিক্সার পরিবহণ শ্রমিকরা বাতলে দিতে পারে! বিভৎস ঘটনার রূপায়ন তারা নিজেরাই ঘটাতে পারঙ্গম। বর্বরতার চরম পর্যায় হত্যাকাণ্ড। নাড়কীয় হত্যাকাণ্ড ঘটাতে তাদের হৃদয় একটিবারের জন্যও নাড়া দেয়নি। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা বিভৎসতার কালক্রমে বিস্তৃতি লাভ করে। একা নয়, কয়েকজন মিলিত হয়ে খুন করেছে। যদি সিসি টিভি ফুটেজে দেখা না মিলতো তবে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হতো। কতই না ফন্দি ছিল তাদের মনে।

সমাজের দায়বদ্ধতা হত্যাকারীদের কখনো ভাবায় না। ব্যক্তিস্বার্থ অবহেলিত হলে খুনের মতো ঘটনা ঘটাতেও তাদের বিবেক নাড়া দেয়নি। এতগুলো মানুষ তাকে হত্যা করতে উন্মুখ হয়েছিল! তাদের উন্মত্ততা তারা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছিল। পরিবেশ যখন নষ্টদের অধিকারে চলে যায় তখন মানুষ ভ্রষ্ট পথে হাঁটতে থাকে। নষ্টদের ভীড়ে ভাল মানুষরাও হারিয়ে যায়। সমাজের ভাল মানুষগুলো দিন দিন খোলসের ভেতর মুখ লুকিয়ে রাখে। খারাপ মানুষের সাথে পেরে উঠা দায়। সভ্য সমাজটাকে তাদের মতো কিছু মানুষই কালিমা লেপটে দেয়। ভালবাসার হৃদ্যতা সেখানে শোভা পায় না। দিন দিন আমাদের মন হিংস্র হয়ে উঠছে, নাকি আমরাই হিংসার কলেবরে মেতে উঠছি। অথচ নিজেরা সৃষ্টির সেরা জীব পরিচয়ে গর্ববোধ করি।

নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সমাজ আবারও সরব উপস্থিতি জানান দেবে। তাদের ভেতরে জমে থাকা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রয়া ব্যক্ত করবে। ইতোমধ্যে তার হত্যার প্রতিবাদে মানব বন্ধনের আয়োজন হয়েছে। কি হবে মানব বন্ধন করে? বিচারে হত্যাকারীর বিচার হবে। কিন্তু, হত্যাকাণ্ডের শিকার যে পরিবার তারা নিজেদের কি ভেবে সান্ত্বনা দেবে। তার ছবিটা কোন ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখবে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

তারা তাকে খুন করে কি জানান দিতে চাইছে? ক্ষমতার দাপট নাকি ভবিষ্যতের সতর্কবাতা! অথবা ভবিষ্যতে কেউ যেন তাদের সাথে বাক বিতণ্ডায় না জড়ায়। এমন কাজ ঘটানোর চেষ্টা করলে শত্রুর হাতে শেষ পরিণতি হবে। সমাজের এহেন বিকৃত মানসিকতার পরিবর্তন করা অনেক কঠিন ব্যাপার। এ সকল অন্ধশ্লাঘা লোকেরা নিজেদের ধারণাকেই শ্রেষ্ঠ বলে মানে। মানবিকতার হৃদ্যতা সেথায় হার মানে। অথচ আমাদের সমাজ আমাদেরকে সুন্দরভাবে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। সমাজের বিভাজন ব্যবস্থা আমাদের শঙ্কিত করে তোলে।

মনে পড়ে ২০১৯ সালে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েরওয়াসিম আফনান নামের এক ছাত্রকে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে চাকার নিচে ফেলে হত্যা করতে প্রাণ কাঁপেনি। ঘটনাগুলো মর্মান্তিক এবং হৃদয় বিদারক। শুনলেই গা শিউরে উঠে। কথা কাটাকাটি থেকে খুন করা সভ্য সমাজের পরিচায়ক নয়।

শত আঘাত, শত লাঞ্ছনার ভীড়েও মওদুদ আহমদ সেবা মুলক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে চাকরি করতো। করোনাকালীন সময়েও দেশের সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে ছিলেন। সেখানে একজন ব্যাংকারকে হত্যা করা মানে মানবতা প্রশ্নবিদ্ধ করা। কিন্তু গণ মানুষের মাঝে মানবিকতা উৎসারিত না হলে তা কেবল আকাঙ্ক্ষা ও শুভ মানসের পরিচয় হয়ে দাঁড়াবে।

আমাদের সমাজ আমাদেরকে অনেক কিছু বুঝতে শেখায়। আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেয় নষ্টদের মাঝে জেগে থাকা রূঢ় আচরণ। সভ্য সমাজটাকেই আমরা নোংরা করে ফেলছি। পরস্পর একজন আরেকজনকে মেরে ফেলতে দ্বিধাবোধ করি না। হত্যা করা ব্যক্তির পরিবারের মানুষগুলোও বিচারের আশায় দিন পার করবে। তাকে মেরে ফেলা মানেই তো তার পরিবারে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করা, সমাজের মানুষকে শঙ্কিত করে তোলা। সমাজের কয়জন মানুষ প্রতিবাদ করবে। কয়টা ঘটনার প্রতিবাদ জানাবে। বহু ঘটনার দায় নিয়ে কতদিন মানব বন্ধনে সামিল হবে। অনেক ঘটনার দায় হয়তো তলানীতে আটকে আছে।

পুরো সমাজটাই কেমন যেন ধোঁয়াশায় নিক্ষেপিত এক সমাজ। অনেক কিছু দেখার চেষ্টা করলেও অন্ধকার জগতই ঠাঁই পায়। শিল্পীত সমাজটাকে আমরা এভাবেই অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছি। তারা জানে না, যাকে হত্যা করা হয়েছে তারও একটা স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্নকে নিয়ে তার বেঁচে থাকার আকুতি ছিল। তার সাথে তার পরিবারের স্বপ্নকেও হার মানতে হয়েছে। শুনেছি যাকে হত্যা করা হয়েছে তার চল্লিশ দিনের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। কিভাবে বেড়ে উঠবে কন্যা সন্তানটি। পিতার স্নেহ-মমতা, আদর-ভালবাসার মাঝে যে শিশুটি বেড়ে উঠার কথা, সে শিশুটিকে পিতৃহারা করলো। বিচারের মধ্য দিয়ে কি তার স্নেহ ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে পারবে? সমাজের ভেতর সে প্রশ্নটি বার বার থেকেই যায়।

অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক। প্রিন্সিপাল অফিসার, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, বন্দর বাজার শাখা, সিলেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button