বিশেষ কলাম

ইসলামী ব‍্যাংকগুলোর একীভূতকরণ প্রস্তাবনাঃ কিছু কথা

মুহাম্মদ শামসুজ্জামানঃ ইসলামী ব‍্যাংকগুলোর একীভূতকরণ প্রস্তাবনাঃ কিছু কথা – এটা অস্বীকারে জোঁ নেই যে, দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় ধুঁকছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর খেলাপি ঋণের চাপে বেকায়দায় অব‍্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি ব‍্যাংক। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। ফলে একদিকে যেমন দিন দিন আমানত কমছে, অন্যদিকে এরা আমানতকারীও হারাতে শুরু করেছে। ফলে, নতুন ঋণ দেয়া যাচ্ছেননা, চলমান ঋণ নবায়ন ও সম্প্রসারণ প্রায় বন্ধ। ব‍্যাংকগুলোর খরচ বাড়লেও আয় কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না অনেক ব্যাংক। তারল্য পরিস্থিতি যেমন খারাপ, আবার এসব ব্যাংককে চলতে হচ্ছে অন্য ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে। কেন্দ্রীয় ব‍্যাংকও প্রয়োজন মত ধার দিয়ে রক্ত চলাচল অব‍্যাহত রাখছে।

‘ইসলামী ব্যাংকগুলোকে একদম নতুন রূপ দেওয়া হবে। একটি বড় ও অনেকগুলো ছোট ছোট ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো সমস্যাগ্রস্ত। এসব ব্যাংক একীভূত করে বড় দুটি ইসলামী ব্যাংক গড়ে তোলা হবে। ইসলামী ব্যাংকের জন্য আইন ও তদারকির ব্যবস্থা চালু করা হবে। বৈশ্বিক পরিসরের উত্তম রীতিনীতি অনুসরণ করে এসব করা হবে। তিনদিন আগে ’বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমন মন্তব্য করেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

আরও দেখুন:
​​​​​ইসলামী ব্যাংকের সংস্কার কোথায় কোথায় জরুরী-৫

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আরো বলেন, ‘সমস্যাগ্রস্ত বেশির ভাগ ব্যাংক মূলধনের ঘাটতিতে আছে। এসব ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ। এসব ব্যাংক ঠিক করতে কয়েক বছর লেগে যাবে। রাজনীতির পালাবদলে এসব সংস্কারে সমর্থন লাগবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে হবে।’ আর এসব ব্যাংকের মধ্যে বেশ কয়েকটিই শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে বড় দুটি ইসলামী ব্যাংক তৈরির পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, একীভূতকরণ ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে পারে। এতে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ, পরিচালন ব্যয় কমানো এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শক্তিশালী ব্যাংক গঠন করে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হতে পারে। তবে একীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকলে বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে দেশের ব্যাংক খাত।

তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাথমিকভাবে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এমনকি একীভূত হতে এমওইউ স্বাক্ষর করে ব্যাংক দুটি। যদিও পটপরিবর্তনের কারণে বিষয়টি সফল হয়নি। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংকের একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ওই সময়। কিন্তু মার্জারে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে সংশয় থাকায় কো শেষ পর্যন্ত সেই একীভূতকরণ আর আলোর মুখ দেখেনি। একীভূতকরণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা জারির পর পদ্মা ও এক্সিমের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসির (বিডিবিএল) দায়িত্ব নিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। আর অন্য ব্যাংকের সঙ্গে ন্যাশনাল ও বেসিক ব্যাংক মার্জ হওয়ার আলোচনা চূড়ান্ত হলেও তা চুক্তি পর্যন্ত গড়ায়নি। এর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংক বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার কথা চলছিল রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব)। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের দায়িত্ব বেসরকারি সিটি ব্যাংককে দেওয়ার কথা এগোচ্ছিল।

এভাবে এই দশ ব্যাংক মার্জ করতে পাঁচটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্রের দায়িত্বে থাকা মেজবাউল হক বলেছিলেন, ‘এই পাঁচ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে আমরা (বাংলাদেশ ব্যাংক) অভিজ্ঞতা নেব, অভিজ্ঞাতারও প্রয়োজন আছে। তারপর দেখা যাবে।’ এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল, ব্যাংক একীভূত করতে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। অডিটর নিয়োগ, সম্পদ ও দায় ঠিক করা, শেয়ার দর ঠিক করা, শেয়ার অংশ র্নিধারণ ও আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। পাঁচ প্রস্তাবের ব্যাংকগুলো একীভূত করার সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে তিন থেকে চার বছর লেগে যেতে পারে। ওই সময়ে মার্জ হতে আপত্তি জানিয়েছিল ন্যাশনাল ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। যদিও ওই সময় অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, একীভূতকরণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা ভুল ছিল। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ওই সময় তাড়াহুড়ো করে ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য এটি সফল হয়নি।

বাধ্যতামূলক মার্জার বা একীভূতকরণের উদাহরণ অন্যান্য দেশেও আছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকব্যবস্থা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক (ফেড) জেপি মরগান চেজকে বাধ্য করেছিল বিনিয়োগ ব্যাংক বিয়ার স্ট্যার্নসকে কিনতে। বিয়ার স্ট্যার্নসের প্রতি শেয়ার ২ ডলারে কেনার জন্য আলোচনা শুরু হলেও পরে তা ১০ ডলারে গিয়ে ঠেকে। তখন যদিও বাজারে শেয়ারমূল্য ছিল ৩০ ডলার। এ জন্য ফেড ৩০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সুবিধাও দেয় জেপি মর্গানকে। এই বেচাকেনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বিয়ার স্ট্যার্নসের শেয়ারধারীরা। লাভবান হতে পারেনি জেপি মর্গানও। অনেক বেশি দায় তাদের বহন করতে হয়েছে।

বাধ্যতামূলক একীভূতকরণের সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের দুই বড় ব্যাংক ইউবিএস ও ক্রেডিট সুইসের এক হয়ে যাওয়া। ইউবিএস মোটেই আগ্রহী ছিল না, কিন্তু সংকটে থাকা ক্রেডিট সুইসকে বাঁচাতে বাধ্য করেছিল সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এখনো ধুঁকছে ইউবিএস। সর্বশেষ খবর হচ্ছে, ব্যাপকভাবে লোকবল ছাঁটাইয়ের দিকে যাচ্ছে তারা। গোটা ইউরোপই সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এই একীভূতকরণের ফলাফলের দিকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সমন্বিত নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার লক্ষ্যে যোগ্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশেষ বিধান প্রণয়ন করেছে। এই বিধানবলে ব্যাংক কোম্পানি ও ব্যাংকিং নীতিমালার উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেছে, যারা নির্দিষ্ট ব্যাংকে গভীর নিরীক্ষা চালাবে। ২০২৪ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক স্পেশাল রেজল্যুশন অ্যাক্ট চালু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আইন অনুযায়ী এই বিশেষ বিধান চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে দেশের প্রায় ১২টি ব্যাংকে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা সংস্থার মাধ্যমে বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।

রেজল্যুশন অ্যাক্টে বলা হয়েছে, ব্যাংকের সমন্বিত নিরীক্ষা বা তার অংশ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যোগ্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করবে। সমন্বিত নিরীক্ষাকাজের জন্য তপশিলি ব্যাংকগুলো যাতে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে তাদের গ্রাহকদের বিষয়ে তথ্য জানায়, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ এই বিধানের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে সাধারণ অনুমতি দিয়েছে। তপশিলি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সমন্বয় করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট বিভাগকে দায়িত্ব দেবে। চুক্তি অনুসারে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেবে। এরপর গভর্নর পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওই প্রতিবেদন পরিচালনা পর্ষদের কাছে পেশ করবেন।

বিশেষ বিধানে সমন্বিত নিরীক্ষার সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে ঝুঁকিভিত্তিক বিস্তারিত নিরীক্ষা করা হবে, যার মধ্যে থাকবে সম্পদের মান পর্যালোচনা, করপোরেট সুশাসন পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং ব্যাংকের নীতি, পদ্ধতি, প্রক্রিয়া এবং আইন ও নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিবিধানের পরিপালন বিষয়ে পর্যালোচনা। এ বিধান জারি করার কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও দেশের বেশ কিছু ব্যাংক বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বিশেষ করে সম্পদের মান, করপোরেট সুশাসন, নীতিমালা এবং আইন ও বিধিবিধানের পরিপালনের ক্ষেত্রে এ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর সাধারণভাবে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি পুরো ব্যাংকিং খাতের বিশ্বাসযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

দেশে সংকটে পড়া বেশিরভাগই শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংকে নানা জালিয়াতি, ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে ধুঁকছে পুরো ব্যাংক খাত। এই ব‍্যাংকটি দখলের আগে গত পনেরো বছর ধরে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে ও রেটিং এ “বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ব‍্যাংক” এবং “বিশ্বের এক হাজার ভালো ব‍্যাংক” এর একটি ছিল। আওয়ামী লীগ আমলে চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ ইসলামী ধারার বেশিরভাগ ব্যাংকই লুট করেছে। এর ফলে শুধু ইসলামী ধারার ব‍্যাংকগুলোই নয় পুরো ব‍্যাংক খাতই এখন বিপর্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতকে ঠিক করতে দুর্বল ও সবল ইসলামী ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে দুটি বড় ব্যাংক করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘ইসলামী ব্যাংকগুলোকে একদম নতুন রূপ দেওয়া হবে। একটি বড় ও অনেক ছোট ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো সমস্যাগ্রস্ত। এসব ব্যাংক একীভূত করে বড় দুটি ইসলামী ব্যাংক গড়ে তোলা হবে। ইসলামী ব্যাংকের জন্য আইন ও তদারকির ব্যবস্থা চালু করা হবে। বৈশ্বিক পরিসরের উত্তম রীতিনীতি অনুসরণ করে এসব করা হবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র বলছে, দেশে বর্তমানে ১০টি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক রয়েছে। এগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ দখলে নেয় এস আলম গ্রুপ। সব মিলিয়ে ইসলামী ধারার পাঁচটি ব্যাংক ছিল প্রতিষ্ঠানটির দখলে। এর বাইরে তাদের প্রভাব ছিল আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও ন‍্যাশনাল ব‍্যাংক এ। সব ব্যাংকেই ব্যাপক অনিয়ম ও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার।

ব্যাংকাররা বলছেন, দেশের বর্তমানে শরিয়াহভিত্তিক যে ব্যাংকগুলো রয়েছে, তাদের মধ্যে ভালো অবস্থানে রয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির শক্তিশালী পর্ষদের কারণে আওয়ামী লীগের আমলেও কোনো ধরনের লুটের খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু খারাপ কোনো ব্যাংকের সঙ্গে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক একীভূত করা হলে ওই ব্যাংকও দুর্বল হয়ে পড়বে। শুধু তাই নয়, পটপরিবর্তনের পর শরিয়াহভিত্তিক সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ব্যাংকটি দখলপূর্ব পরিচালকদের নেতৃত্বে দিলে চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকও আগের মতো শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে।

সুতরাং ইসলামী ব‍্যাংক বাংলাদেশ ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এর বাইরে অপেক্ষাকৃত কম দুর্বল ব্যাংক ধরা হয় আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল)। এসব ব্যাংককে ঠিকভাবে পরিচালনা করা গেলে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এর বাইরে যে পাঁচটি ব্যাংক রয়েছে সেগুলোই প্রকৃত দুর্বল। এর মধ‍্যে আইসিবি তো আইসিইউ তে বেশ কয়েক বছর। গত বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক আদেশে বলা হয়েছে, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদের দুর্বলতার কারণে মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ব্যাংকের শ্রেণিকৃত বিনিয়োগ ও পুঞ্জীভূত ক্ষতি বিপুল। ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা ও তারল্যসংকট তীব্র হয়েছে। আর্থিক সংকটের পাশাপাশি পর্ষদের নীতিনির্ধারণে দুর্বলতার কারণে ব্যাংকিং সুশাসন বিঘ্নিত হচ্ছে। পর্ষদ আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এসব কারণে আমানতকারীদের স্বার্থ ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে ব্যাংক কোম্পানি আইনের অধীন বিদ্যমান পরিচালনা পর্ষদ বাতিলের আদেশ দেওয়া হয়েছে। স্ট‍্যান্ডার্ড ব‍্যাংক কোন ক‍্যাশ লিক‍্যুইডিটি সাপোর্ট ছাড়াই বেশ চলছে। চিন্তা বাকী তিনটি নিয়ে। গ্লোবাল,ইউনিয়ন এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি। বলাবাহুল্য এও তিনটি মূলতঃ এক ব‍্যক্তি ও এক পরিবারের পারিবারিক ব‍্যাংক।

আর্থিক জগতে ব্যাংক একীভূত হওয়া বা এক ব্যাংক আরেক ব্যাংককে অধিগ্রহণ করা খুবই সাধারণ বিষয়। পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাংক একীভূত হওয়ার বিষয়টিকে মূলত একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বেচাকেনা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। দুটি ব্যাংকই চায় তাদের সম্পদ একসঙ্গে করে আরও ভালো ব্যবসা করতে। পুঁজি বাড়ানো, খরচ কমানো, নতুন বাজারে প্রবেশ করা, আরও গ্রাহক অর্জন করা, প্রযুক্তি ও পণ্যের ঘাটতি দূর করা, ব্যবস্থাপনায় নতুনত্ব আনা—এমন অনেক বিবেচনায় ব্যাংক একীভূত হয়।

অনেকেই বলেছেন, ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত করা ঠিক হবে না। বিদ‍্যমান সম্পদের শক্তি বিবেচনায়, ভাল ব‍্যাংকগুলোর ভাল সম্পদের পরিচর্যা আর মন্দ ব‍্যাংকগুলোর মন্দ সম্পদ পরিচর্যা কখনো এক নয়। সে কারণে যারা দুর্বল ব‍্যাংকের দায়িত্ব নিবে তাদের সম্পদ মান উন্নয়নে অধিক মনোযোগী হতে হবে। আবার হতে পারে, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি বড় ব্যাংক। অন্যগুলো ছোট। এজন্য এখানে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা হচ্ছে না। তাই ছোট ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে আরেকটি বড় ব্যাংক করা হতে পারে। কিন্ত সেখানেও বড় ব‍্যাংক হলেই যে সম্পদমান আপনিতেই ভাল হবে, তা মোটেও নয়।

ব্যাংকের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে একীভূত প্রক্রিয়ায় যাওয়া উচিত। একীভূত করা নিয়ে কী ধরনের আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা হয়, তা–ও দেখতে হবে। কারণ, ভাল ব্যাংক কারো এমন অতিরিক্ত দায় নেয়ার দৃষ্টান্ত নেই যার প্রায় পুরোটাই মন্দ ও শ্রেনীকৃত। সম্পদের গুণমান নির্ণয় শাখা করছি বর্তমানে যে ফরেনসিক অডিট চলছে তাতে এ বিষয়ে যথেষ্ট যাহায‍্য পাবে।

আমাদের সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গা হল, ঋণখেলাপি, দুর্নীতিবাজ ও অনিয়মে যুক্ত পরিচালক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান কি আমরা আদৌ নিতে পারব? ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত না করে ও দোষী পরিচালক ও কর্মকর্তাদের শাস্তি না দিয়ে ব্যাংক একীভূত করে কোনো ফল পাওয়া যাবে না।তার চেয়েও বড় কথা হল, এদেশে ইসলামী ব‍্যাংকিং জনগণের একটি প্রত‍্যাশা ও আস্থার প্রতীক। আপনারা যখন লাইসেন্স দিলেন তখন কেন বিবেচনা করলেন না যাদের ইসলামী ব‍্যাংক দিলেন তাদের ইসলামের প্রতি সামান‍্যও দরদ ভালবাসা বা জ্ঞান ও লেখাপড়া ছিল কিনা? এরপর সরকার, গোয়েন্দা বাহিনী, কেন্দ্রীয় ব‍্যাংক সবাই মিলে বাহবা দিয়ে এক ব‍্যক্তির হাতে সবগুলো ব‍্যাংক তুলে দিলেন। আমি মনে করি ইসলামী ব‍্যাংকগুলির আজকের পরিণতির জন‍্য তারাই দায়ী।

ব্যাংক একীভূতকরণ হচ্ছে একটা বিকল্প। তবে বাংলাদেশের আগে এমন কর্মকান্ডের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, এজন্য করা যাবে না তেমনও নয়। মার্জার করতে হলে প্রথমে ব্যাংকগুলোকে তাদের পরিকল্পনার করার জন্য সময় দিতে হবে। পুনর্গঠিত বোর্ডেরও পারফরমেন্স পর্যালোচনা করা যেতে পারে। জানামতে, অনেকেই পেশাদারিত্বের সাথে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারপর তারা যদি ব্যর্থ হন, ব‍্যাংকগুলোকে লাইনে তুলতে একেবারেই আর না পারেন তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের মার্জ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে উত্তম হবে বলে মনে করি। তবে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, তা ভেবেচিন্তে নেওয়া উচিত।

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান [সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button