বিশেষ কলাম

জেনেশুনে বিষ করেছি পান

মোঃ জিল্লুর রহমানঃ সবাই জানে ধূমপান করলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। কিন্তু তারপরও জেনেশুনে মানুষ যেখানে সেখানে ধূমপান করে। একটি গবেষণায় জানা গেছে, এখন শিশুকিশোরদের প্রতি দশ জনে একজন ধূমপায়ী। শুধু ধূমপানই নয়, এরা নানা রকমের নেশাও করে এবং ধূমপানের মাধ্যমেই যেকোনো নেশা শুরু হয়। এতে যেমন তাদের দেহের ক্ষতি হচ্ছে, তেমনই পরিবেশের অন্য মানুষের দেহেরও ক্ষতি হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে ধূমপায়ীর সংখ্যা ছিল ১৩২ কোটি। তার দু’ বছর পর, ২০২০ সালে এই সংখ্যা নেমে আসে ১৩০ কোটিতে। যে হারে এই সংখ্যা কমছে, তাতে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ধূমপায়ীদের সংখ্যা ১২৭ কোটিতে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে উদ্বেগের কারণ হচ্ছে ধূমপানের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে মারা যায় আট কোটিরও বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে ছয় কোটি ৮০ লাখ মারা যান সরাসরি ধূমপানের কারণে। বাকি এক কোটি ২০ লাখ ধূমপায়ী ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থাকার কারণে মারা যান।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে সাত বছরের মধ্যে বিশ্বে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন। গোটা বিশ্বে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তার নিরিখে ধূমপায়ীদের সংখ্যা এতটা পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় যথেষ্ট আশাবাদী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। প্রতি বছর ধূমপায়ীদের সংখ্যা কমছে- এটি খুবই উৎসাহব্যাঞ্জক একটি ব্যাপার এবং এতে আরো বলা হয়েছে, ২০০০ সালে ১৫-১৬ বা ১৮-১৯ বছর বয়সী যেসব কিশোর-কিশোরী ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, ২০২৫ সালে তাদের প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে চার জনই এই বদ অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসবে।

সিগারেটের প্রতিটি প্যাকেটেও লেখা থাকে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, ‘ধূমপানের কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষতি হয়’, ‘ধূমপান মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়’, ‘ধূমপান হৃদরোগের কারণ’, ‘ধূমপান ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়’- এমন সতর্কতা। তারপরও ধূমপান করে মানুষ। অনেক জায়গায় লেখা থাকে যে ‘ধূমপান মুক্ত এলাকা’ কিংবা এখানে ধূমপান নিষিদ্ধ। কিন্তু অনেকে তা খেয়াল করার পরও ইচ্ছাকৃতভাবে যেখানে সেখানে ধূমপান করে। কেউ এর প্রতিবাদ করলে মনে হয় যেন প্রতিবাদকারীই আসল অপরাধী।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

জনসমক্ষে ধূমপান আমাদের দেশে হরহামেশাই দেখা যায়। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও জনসমক্ষে ধূমপান নিষিদ্ধকরণ আইন প্রণয়ন হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগই এ আইন মানে না। এতে অধূমপায়ী ও শিশুরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে, প্রকাশ্য ধূমপানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় শিশুরা। এদিকে, প্রকাশ্য ধূমপান নিষিদ্ধ আইনের ফলে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ‘অকালজাত শিশু’ জন্মের হার প্রায় ১০ ভাগ কমে গেছে বলে এক গবেষণার বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি।

আইন অনুসারে জনসমক্ষে, বিশেষ করে গণপরিবহন, বার, রেস্তোরাঁ এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ। বিভিন্ন রাষ্ট্রে ধূমপানবিরোধী আইন প্রয়োগের ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী শিশুদের স্বাস্থ্যে কতটা প্রভাব ফেলেছে সে বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণাটি করা হয়েছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, এ আইনের ফলে ইতোমধ্যে বয়স্কদের ক্রমাগত ধূমপানের প্রবণতা কমে গেছে। আজকাল শিশুরাও ধূমপানের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। বিদ্যালয় থেকে বের হয়েই দোকান থেকে বিড়ি বা সিগারেট কিনে তা টানতে টানতে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। স্কুলের বাইরে কেউ কিছু বলবে না এই ভেবে তারা ধূমপান করে। এর ফলে অধূমপায়ী ছাত্রদের ওপরেও খারাপ প্রভাব পড়ছে।

ধূমপানের কুফলগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্যানসার এবং শ্বাসকষ্ট। আজকাল এসব রোগের আক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে। যার ফলে মানুষের মৃত্যুসংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। ধূমপানের ফলে ফুসফুসে, শ্বাসনালিতে নানা রোগ আক্রমণ করে। ধূমপায়ী বাবা-মার সন্তানেরাও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ধূমপান একটি বদ অভ্যাস। এর জন্য বিশ্বে প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ। ১৯৫০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই মারা গেছে প্রায় ছয় কোটি মানুষ। আর এদের অর্ধেকই ছিল যুবক শ্রেণী। সিগারেটের ধোঁয়ায় যে নিকোটিন থাকে তা হেরোইন অপেক্ষা শক্তিশালী। ধূমপানকারী পরিবার, দেশে ও সমাজে সর্বমহলে একজন ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচিত হয়। ধূমপান হলো সবচেয়ে বড় অপচয় এবং নিয়মিত ধূমপান মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ করে। কারণ সে নিশ্চিত জানে যে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তারপরও সে তা পান করে। ধূমপায়ী তার ছেলে-সন্তান এবং উত্তরসূরীদের জন্য একজন আদর্শহীন ব্যক্তিতে পরিণত হয়।

ধূমপান মানুষের অপমৃত্যু ঘটায়। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, সমগ্র পৃথিবীতে ধূমপানের কারণে যত বেশি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটে, অন্য কোনো রোগ-ব্যাধির কারণে তত ঘটে না। ধূমপানের কারণে শরীরে তাপ বৃদ্ধি, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি রোগ-ব্যাধি দেখা যায়। ধূমপানের কারণে রক্তনালিগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং অনেক সময় তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

ধূমপানকারীর ফুসফুস, মুত্রথলি, ঠোঁট, মুখ, জিহবা, কণ্ঠনালি, কিডনী ইত্যাদিতে ক্যান্সার হয়। ধূমপান স্মরণশক্তি কমিয়ে দেয় এবং মনোবল দুর্বল করে দেয়। ইন্দ্রিয় ক্ষমতা দুর্বল করে। বিশেষ করে ঘ্রাণ নেওয়া এবং স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা লোপ পায়।

ধূমপায়ীদের শ্রবণশক্তি কমে যায়। উইনকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় ৩৭৫০ জন মানুষের ওপর এক সমীক্ষা চালায়। সেখানে লক্ষ্য করা যায় যে, অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের শ্রবণশক্তি কমার শঙ্কা শতকরা ৭০ ভাগ বেশি। গবেষকরা আরো দেখেছেন যে, একজন ধূমপায়ীর ধূমপানের সময়ে কোনো অধূমপায়ী উপস্থিত থাকলে তারও একই সমস্যা দেখা দেবে।

ধূমপানের ফলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বার বার সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। ধূমপায়ী সব সময় দুর্বলতা অনুভব করে এবং আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। হার্টের সাথে সম্পৃক্ত ধমনিগুলো ব্লক হয়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রবল হয়। এমনকি বক্ষ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া শঙ্কা থাকে। ধূমপান উচ্চ রক্ত চাপের কারণ হয়। ধূমপানের ফলে যৌনশক্তি বিলুপ্ত হতে থাকে। ধূমপানের ফলে হজমশক্তি কমে যায়, ধারণক্ষমতা লোপ পায় এবং শরীর ঢিলে হয়ে যায়। ধূমপানের ফলে পাকস্থলী ক্ষত হতে থাকে এবং যকৃৎ শুকিয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। ধূমপানের ফলে মুত্রথলি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং প্রস্রাব বিষাক্ত হয়।

ধূমপান নির্মল পরিবেশকে দূষিত করে। এর ফলে স্ত্রী-পরিজন, সহযাত্রী, বন্ধু-বান্ধব ও আশে-পাশের লোকজনের কষ্ট হয়ে থাকে। বাসে, ট্রেনে ও অন্যান্য যানবাহনে প্রকাশ্যে ধূমপান করার ফলে অনেক সহযাত্রী নীরবে কষ্ট সহ্য করে মনে মনে ধূমপায়ীকে অভিশাপ দেন। আবার কেউ প্রতিবাদ করে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যান। অনেকে প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপমানিত হন। জেনে রাখা উচিত, চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ধূমপানকারীর প্রতিবেশী শারীরিকভাবে ধূমপায়ীর মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘তামাকজনিত ব্যাধি ও অকালমৃত্যুর কারণে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ৩০ বছর বা এর বেশি বয়সীদের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ১৫ লাখ মানুষের রোগাক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়সী ৪ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি শিশু তামাকজনিত রোগে ভুগছে। এদের ৬১ হাজারেরও বেশি (১৪ শতাংশ) শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। তামাক ব্যবহার এবং পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে মারা যাচ্ছে এক লাখ ২৫ হাজার ৭১৮ জন। যা জাতীয় পর্যায়ে সকল মৃত্যুর প্রায় ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে ব্যয় বাড়ে চার হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যক্তিগত ও সরকারি ব্যয়, অক্ষমতা-অসুস্থতার কারণে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি এবং অকালমৃত্যুর কারণে উৎপাদনশীলতার ক্ষতিও অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েল বিং-এর মতে, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণের বিদ্যমান আইনটি সর্বশেষ সংশোধন হয়েছে ২০১৫ সালে। এতোদিনে বদলে গেছে দৃশ্যপট। অনেকেই আবার পাবলিক প্লেসে ধূমপান শুরু করেছে। এটা কমাতে করের হারও বাড়ানো প্রয়োজন। তাই আইন সংশোধন জরুরি। সংসদের প্রায় ১৫৩ জন সংসদ সদস্য ইতোমধ্যে তামাকের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর করেছেন। সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।’

তবে আজকাল ধূমপান রোধের জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। যেমন, টেলিভিশনে প্রচার, নানা স্থানে ধূমপান রোধের পোস্টার লাগানো, ধূমপান রোধের জন্য নানা সংগঠন তৈরি ইত্যাদি। ধূমপায়ীদের অনেকের পরিবারে একথা জানে আবার অনেকের পরিবারে তা জানে না। যাদের পরিবারে একথা জানে না তারা একথা জানার ও চেষ্টাও করে না যে তাদের ছেলেমেয়েরা বাইরে কী করছে। এর ফলে তারা আরো ছাড় পাচ্ছে।

ধূমপানে বিষপান, এটা জীবন ও শরীর উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধূমপায়ীর মতো তার পাশে থাকা অধূমপায়ীও সমান ক্ষতি ও ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এ বিষয়টি অনুধাবন করে ধূমপান রোধের জন্য সবার আগে আমাদের নিজেদের সচেতন ও বদলাতে হবে। আসুন আমরা সবাই ধূমপান ছাড়ি, ঝুঁকিমুক্ত জীবন গড়ি।

মোঃ জিল্লুর রহমানঃ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button