ব্যাংকার

নিস্তব্ধতায় এক ব্যাংকার দম্পতির বহমান দিনগুলি

ঘড়ির অ্যালার্মটি বেজেই চললো। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় প্রতিদিনের অভ্যাসবশত অ্যালার্মের সময়টুকু পিছিয়ে নেই। আজ আর সেটা করা হলো না। ঘড়িতে ভোর সাড়ে পাঁচটা। আধো আধো ঘুম নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। বেদনাতুর হৃদয়ে আঁচ করি মুহূর্তের নিস্তব্ধতাটুকু। মনে হয় প্রতিটি মুহূর্তই গ্রাস করে আছে নি:শব্দতায়। মাঝে মাঝে ঝরা পাতার শব্দ একটু রাশ টেনে ধরে। পরক্ষণেই ভাবি, ঘুচিয়ে যাবে মলিনতার ছাপ।

আজ-কাল আর সকালেও হাঁটা হয় না। সময় পেলে মাঝে মাঝে হাঁটার অনুভব করি। হাঁটার মাঝেও যে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ কাজ করে সহকর্মী আনোয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে বুঝতে পেরেছিলাম। তবে নিস্তব্ধতার দরুণ আগের মতো হাঁটার মাঝেও আর কোন আনন্দ ফিরে আসে না।

আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজন ব্যাংকে চাকরি করি বলেই সময়ের তাগাদায় দুজনই বের হই। হাতে দস্তানা এবং মুখে মাস্ক পরিহিত দেখে ছোটন সোনাও দূরে চলে যায়! আমাদের থেকে দূরে সরে মুখে একটি আঙ্গুল দিয়ে আনমনা হয়ে আমাদেরকেই অনুসরন করে। হয়তো আঁচ করতে পারে না দুজনের হঠাৎ পরিবর্তনের আভাস। তাই বাসা থেকে বের হবার মুহূর্তে আচমকা হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাসার নিচে নামতেই বারান্দা থেকে বলে, বাবা-মা তোমরা তাড়াতাড়ি চলে এসো। বলি, এইতো যাবো আর আসবো। অন্তরের অনুভূতি প্রকাশের ভাষা এখানেই স্তিমিত! দীর্ঘ নি:শ্বাসটুকু ছেড়ে চিন্তিত মনে গমণ করি।

মাস্ক এবং হাতের দস্তানাগুলি বারবার ব্যবহারের অনুপযোগী। তারপরও প্রতিদিন ব্যবহার করি। শুনেছি, সার্জিক্যাল মাস্কের খুবই সঙ্কট। তাই একান্ত বাধ্য হয়েই অপারগতার কাজটুকু আমাদের এভাবেই সেরে নিতে হচ্ছে! হাতের দস্তানাগুলো কয়দিন যাবৎ ব্যবহার করে আসছি তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিদিন নিজেদের প্রোটেক্ট করার জন্য এভাবেই তৈরি করি! ভাবি, আস্তে আস্তে আমাদের শরীরও এভাবেই জীবাণুকে প্রোটেক্ট করতে পারঙ্গম হবে। প্রতিদিন এভাবেই দুজনের দুই ব্যাংকের আঙিনায় বিচরণ।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

ব্যাংকে সব কাজ কর্ম করার মাঝে বাসায় ফোন করি। মাঝে মাঝে ক্লান্তির অবসাদে ছেয়ে থাকা শরীরটাকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাই। ওদিকে ছোটন সোনা বাসা থেকে ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি আসার জন্য তোড়জোড় চালাচ্ছে। ঘড়ির কাটা যে নিজ গতিতেই ধাবমান। তারপরও তাড়াহুড়ার মাঝে গতি খুঁজে পাই। সব সামলে এভাবেই নিজেদের তৈরি রাখি।

শিহরণ জাগিয়ে নিজেকে নিয়েও একটু চিন্তার আঁচড় কাটি। ব্যাংকে সামাজিক দূরত্ব কতটুকুই বা বিবেচনা করতে পারি। রাস্তায়ও মানুষের আনাগোনা রয়েই গেছে। মনে মনে শঙ্কা তৈরি হয়েই যায়। দিনশেষে অফিস থেকে বাসায় ফেরার স্পন্দনটুকু অনুভব করি। হৃদ্যতার সংস্পর্শে থেকে ভাবাবেগে নিজেকে আর এতটুকু সংবরণ করতে পারি না।

বাসায় ঢুকার আগ মুহূর্তেই ছোটন সোনাটিকে কোলে নিয়ে সামলে নিতে হয়, এখন যে আর সেটা পারা হয় না। তাই, কলিং বেল না চেপে আস্তে আস্তে দরজায় নক করি যাতে আমাদের আগমন সে আঁচ করতে না পারে! হয়তো আমরাও শুনতে চাই না ছোটন সোনার ছোট ছোট আকুতিগুলি।

তাই, দরজার ওপাশে বালতিতে কাপড়-চোপড়গুলি রেখে ভেতরে প্রবেশ করে তাকে এখন আর কোলে নিতে আসি না। হাত-পা ভালভাবে ধুঁয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। একটি বালতির মাঝে পানির সাথে কয়েক ফোঁটা ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে কাপড়-চোপড়গুলি ভিজিয়ে রাখি। আমাদের ধারণা, তাতেই প্রোটেক্ট হয়ে যাবে। সাথে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রয়েছে। যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করি সেটাও নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছি।

ছোটন সোনার কান্নার স্বরটা বাড়তেই থাকে। মিছে মিছে অভয় দিয়ে বলি, আসছি। তাতে কি আর তার সাধ মিটে! দরজার বাহির থেকে তবেই তাকে নিয়ে আসতে হবে। বাধ্য হয়ে তাতে সাড়া দিতেই হচ্ছে।

তারপরও শান্তি খুঁজে ফিরি তার নিতান্ত সহজ-সরল হাসিটুকুর মাঝেই। মনে হয়, নিস্তব্ধ পৃথিবীটা এখানেই সরব হয়ে উঠে। এভাবেই চলে প্রতিদিনের ঘূর্ণনায়মান চলার চাকা।

মনের বিষণ্নতাকে দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। ক্লান্তিতে মনটা ছেয়ে গেছে বলেই হাতে ফোনটি নিয়েও আপনজনদের খোঁজ খবর না নিয়েই বিছানায় ঘুমোতে যাই। সুনসান নিরবতা। সবাই ঘুমিয়ে আছে। মনে হয় রাতের তৃতীয় প্রহর চলছে। ছেলেটিকে ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়েছি।

মনের বিষণ্নতা ক্রমশ বেড়েই চলছে। রিক্ততার চিহ্ন আঁচড়ে পড়ে আছে মানুষের জীবনে। এই বিপন্ন সময়ে নির্জনবাস যখন অস্থির করে তুলেছে ল্যাম্প পোস্টগুলির এক ঝিলিক আলো মুখর করে তুলে খানিকটুকু হলেও। বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা পানি প্রকৃতিকে যেন আরও প্রাণবন্ত করে তুলে। জানালার অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা করবী ফুলের গাছ জুড়ে ফুলের সাম্রাজ্য যেন আশা জাগানিয়ার গানটুকুও শুনিয়ে বেড়ায়।

অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক। প্রিন্সিপাল অফিসার, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, বন্দর বাজার শাখা, সিলেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button