ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ব্যাংকের অবস্থান

নূর ই আলমঃ চলমান ডলার সংকট মোকাবেলায় প্রবাসী আয় সংগ্রহের ক্ষেত্রে একটি দাম বেঁধে দিয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়েছিল, কোনো ক্ষেত্রেই ডলারের দাম ৯০ টাকার বেশি হবে না। এছাড়া ব্যাংকে কত দামে রফতানি বিল নগদায়ন হবে এবং আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করবে তাও নির্ধারণ করে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। ডলার সংকট কাটাতে ২৭ মে বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন ও ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব সিদ্ধান্তের কথা জানায়। স্বাভাবিকভাবে এসব সিদ্ধান্তের বিষয় নতুন কয়েকটি আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এর মধ্যে প্রধান ও অন্যতম আলোচনা ছিল, বর্তমান বাজার অর্থনীতিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কতটুকু ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে? পাশাপাশি এ ধরনের অবস্থানের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে যায়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক তার অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কোনো দেশ চাইলেই দীর্ঘমেয়াদে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কোনো কোনো দেশ বিশেষ পরিস্থিতিতে সাময়িক সময়ের জন্য ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণের পথে হেঁটেছিল। থাইল্যান্ডের মতো অর্থনীতি অল্প সময়ের জন্য কাজটি করে ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কিছুদিন প্রাণপণ চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষের এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের। কিন্তু বিনিময় বাজারে বিভিন্ন ধরনের বৈধ ও অবৈধ নিয়ামকের কার্যকরণের কারণে কিছুদিন পর এ ধরনের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন সীমিত হয়ে যায়। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ একটি স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ, এটির কার্যকারিতা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি কত দ্রুত ডলারের মজুদ বৃদ্ধি করতে পারে তার ওপর।
এর মানে হলো, বাজারে স্থিতিশীলতার জন্য আলটিমেটলি ডলারের মজুদ বৃদ্ধি করা ছাড়া বিকল্প অধিক কার্যকর কোনো পথ খোলা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো ব্যাংকই প্রবাসীদের পাঠানো প্রতি ডলারের বিনিময় হার সর্বোচ্চ ৮৯ টাকা ৮০ পয়সার বেশি দিতে পারত না। কিন্তু বাস্তবে প্রতি ডলারের বিপরীতে প্রবাসীরা ৯৫ টাকা বা এর বেশি পেয়ে আসছেন। এ বাস্তবতায় প্রবাসীদের অর্জিত ডলারের বিনিময় হার ৮৯ টাকা ৮০ পয়সায় বেঁধে দেয়ার মানে হচ্ছে, বৈধ উপায়ে ডলার আসার পরিমাণ কমে যাবে, এটির ফলস্বরূপ রেমিট্যান্স আয়ও কমে যেতে পারে। যদি এ সম্ভাবনা বাস্তব রূপ লাভ করে তাহলে বর্তমান ডলার সংকট তীব্রতর হবে। কারণ রফতানি বাণিজ্যের বাইরে দেশে ডলার জোগানের অন্যতম উৎস হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। অবৈধ উপায়ে দেশে ডলার ঢুকলে চলমান সংকট সমাধানে এটি কাজে আসবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের নির্দেশনা অনুযায়ী রফতানি বিল নগদায়নের ক্ষেত্রে ৮৮ টাকা ৯৫ পয়সার বেশি দেয়া যাবে না। ডলারের দাম বাড়লে, অর্থাৎ প্রতি ডলারের বিপরীতে আগের চেয়ে বেশি টাকা পাওয়া গেলে রফতানিকারকরা লাভবান হন। অর্থনীতিতে স্বাভাবিকভাবে রফতানি বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি ডলারের দাম বাড়ার ফলে দেশের রফতানিকারকরা স্বল্প সময়ে অধিক রফতানিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং চলতি কোয়ার্টারে রফতানি আয় বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এখন রফতানি বিল নগদায়নের সর্বোচ্চ হার বেঁধে দেয়ায় ভাটা পড়বে বলে শঙ্কা ছিল। ডলারের দাম বাড়ার কারণে রফতানি প্রবৃদ্ধিতে যদি অধিক ইতিবাচক প্রভাব পড়ত তাহলে অধিক রফতানি আয় ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে ভূমিকা পালন করত।
| ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
আরেকটি বিষয় এখানে প্রাসঙ্গিক। বাজারে ডলারের দাম ৯৫ টাকা বা এর বেশি। কোনো রফতানিকারক বা প্রবাসী ডলারকে টাকায় রূপান্তর করতে গেলে ৯০ টাকার বেশি পাবেন না, কিন্তু আমদানিকারক বা প্রবাসী ডলার কিনতে গেলে একই দামে পাবেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। আমদানিকারকদের যদি খোলাবাজারের দামে, অর্থাৎ ৯৫ টাকা করে ডলার কিনতে হয় তাহলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তেন কাঁচামাল আমদানিকারকরা। এর প্রভাব পড়ত রফতানিতেও। প্রকৃতপক্ষে এত প্রতিকূলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ডলারের জন্য বেঁধে দেয়া এ সর্বোচ্চ মূল্য টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। সংশয় সঠিক প্রমাণ হয়েছে।
বিশ্ববাজারে ডলারের দাম বা বিনিময় হার তিনভাবে নির্ধারিত হয়। প্রথমটি হচ্ছে, কোনো ধরনের সরকারি বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ ছাড়া শুধু ডলারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে এ হার নির্ধারিত হয়। এটিকে বলা হয় ফ্রি ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ সিস্টেম। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ম্যানেজড ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ সিস্টেম। এক্ষেত্রে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। শেষটি হলো ফিক্সড এক্সচেঞ্জ সিস্টেম। এখানে সংশ্লিষ্ট দুটি দেশ নির্দিষ্ট কিছু পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিনিময় হার নির্ধারিত করে।
বাংলাদেশে ডলারের দাম বেঁধে দেয়া নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, সেটি মূলত ম্যানেজড ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ সিস্টেম। যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন অধিক হারে কমে যাওয়াসহ কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে এ ধরনের ম্যানেজড ফ্লোটিং সিস্টেম অনুসরণ করতে দেখা যায়। অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কৌশলগত কিছু কারণেও এটি অনুসরণ করতে দেখা গেছে। দেশে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি বিরাজ করছিল না। ডলারের আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতার পাশাপাশি এ দেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার ও মুদ্রাস্ফীতি চলমান ডলার সংকটের পেছনের কারণ বলে মনে করেন কেউ কেউ।
চলমান সংকট মোকাবেলায় প্রথমত আমাদের সমস্যাটি মেনে নিতে হবে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে ডলার নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এছাড়া আমরা নিজেরাও এক্ষেত্রে সমস্যাটিকে প্রকট রূপ দিচ্ছি। বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট ও সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিভিন্নভাবে। এটি ডলারের বিপরীতে আমাদের মুদ্রাকে দুর্বল করছে। অনতিবিলম্বে দেশ থেকে অর্থ পাচারের পথ বন্ধ করতে হবে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য দ্রুত কিছু ব্যবস্থা না নিলে পরিত্রাণের পথ হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না। অর্থ পাচার ছাড়াও কোনো একটি অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেলে সে দেশের মুদ্রার মান কমে যায়। আমাদের দেশের বাস্তবতায় মুদ্রাস্ফীতির প্রকৃত তথ্য নিরূপণ এবং এটি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পলিসির বাস্তবায়নও জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুতই পরিস্থিতি অনুধাবনপূর্বক ডলারের মূল্য বেঁধে দেয়া সংক্রান্ত নির্দেশনা শিথিল করেছে, যা ইতিবাচক। তবে বাজার পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখকঃ নূর ই আলম, অর্থনীতি বিশ্লেষক।






