ব্যাংক গ্রাহক

ব্যাংক বন্ধের গুজবে কার কী ভূমিকা এবং আমানতকারীদের জন্য জ্ঞাতব্য

মোশারফ হোসেনঃ সম্প্রতি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়া তথা ব্যাংক বন্ধ হওয়ার গুজবে চাউর হয়েছে দেশ। পরিচিত-অপরিচিত গ্রাহকের প্রশ্নবাণে বিদীর্ণ হচ্ছে ব্যাংকাররা। গুজব আতঙ্কিত গ্রাহকদের কেও কেও তুলে নিচ্ছেন আমানত। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে মিডিয়াতে বিবৃতি দিয়ে ব্যাংক গ্রাহকদের ব্যাংক বন্ধের গুজবে বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ করেছে।

কিন্তু এরপরও এই গুজব বন্ধ হয়নি। এখনো গুজবতাড়িত আতঙ্ক বিক্রি চলছেই। তবে কী কারণে এই গুজব ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে তা একটু খতিয়ে দেখলে, বিষয়টি আসলেই ‘গুজব’ নাকি এর পিছনে কোন সত্যতা রয়েছে, আর গুজব হলেও তার প্রচার-প্রসারে কারা ভূমিকা রাখছে- তা আশা করি স্পষ্ট হবে।

কয়েকদিন আগে আমানতকারীদের হৃদয়ে আতঙ্কের বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দিয়ে একাধিক পত্রিকা সংবাদ শিরোনাম করেছে ‘আমানতের সুরক্ষা দিতে পারছে না ১২ ব্যাংক’। সংবাদটি পড়ে জানতে পারলাম- ১২ ব্যাংকে ঋণের প্রভিশন ঘাটতি আছে; অর্থাৎ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশনের চেয়ে কম প্রভিশন সংরক্ষণ করেছে ব্যাংকগুলো। কোনো কোনো পত্রিকা আবার এই সংবাদটির শিরোনাম করেছে ‘প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ ১২ ব্যাংক’। এ শিরোনামের ‘ব্যর্থ’ শব্দটি দিয়েও পাঠক বিভ্রান্ত হয়েছে।

কারণ, এতে করে কেও কেও মনে করেছে যে, ‘সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো একটি টাকাও প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি’। এই সংবাদটির শিরোনাম হতে পারত ‘ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ঘাটতিতে ১২ ব্যাংক’। কিন্তু তা না করে এমন শিরোনাম করা হয়েছে যাতে করে ব্যাংক গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং পত্রিকার বিক্রি তথা পাঠক বাড়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইক-শেয়ার বাড়ে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

অন্যদিকে কিছুসংখ্যক ফেসবুকার ও ইউটিউবার তো আছেই যাদের ধ্যানজ্ঞান হচ্ছে  ‘যত বেশি ভিউ, লাইক, শেয়ার, ফলো, সাবস্ক্রাইব; তত বেশি প্রচার এবং পেজ ও চ্যানেলের আয় ততই বেশি।’ তাই তারা পাতালের মানুষকে চাঁদে নিয়ে যায়; ‘মমতাজ ভিলা’কে এমপি মমতাজের বাসা বানিয়ে অজ্ঞ মানুষের মাধ্যমে বিভ্রান্তি ও গুজব ছড়িয়ে নিজেদের পোস্ট, পেজ ও চ্যানেলকে ভাইরাল করার এবং টুপাইস কামানোর ধান্দা করে। বর্তমানে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলেরও নিজস্ব ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল আছে। যদিও সাধারণ মানুষ সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদকেই সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য মনে করে, তবুও কিছু কিছু সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সংবাদে বিশেষ করে শিরোনামে সংবাদের চেয়ে প্রচারকেই উদ্দেশ্য করা হয়। আর তাই কোনো কোনো বিষয়ের পজিটিভ অংশটি বাদ দিয়ে নেগেটিভ অংশটিকে সংবাদ করা হয়।

ব্যাংক একটি সংবেদনশীল খাত যেখানে মানুষের ‘বিশ্বাস’ হচ্ছে ব্যাংক ব্যবসার মূল পুঁজি। দেশের মানুষ কীভাবে গুজবের পিছনে ছুটে তার একাধিক সাম্প্রতিক নজির রয়েছে আমাদের কাছে। তাই ব্যাংক বিষয়ে সংবাদে গুজবের উপাদান বা সংবাদের বাড়াবাড়ি থাকা উচিত নয়। তাই যে ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন কয়েক হাজার কোটি টাকা, সে ব্যাংকটিকে ঋণের প্রভিশন বিবেচনায় ৫০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মুলধনের ব্যাংকের কাতারে ফেলে একই বিশেষণে বিশেষায়িত করে সংবাদ করাটা নিশ্চয় কাঙ্ক্ষিত নয়।

আমানতকারীরা যেসব উৎস হতে সুরক্ষা পেয়ে থাকেন, তার একটি হচ্ছে ঋণের বিপরীতে সংরক্ষিত প্রভিশন। তবে ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করার একমাত্র উদ্দেশ্য আমানতকারীদের সুরক্ষা নয়। কারণ, আমানতকারীদের নিত্যকার আমানত ঋণের প্রভিশন হতে পরিশোধ করা হয় না। কোনো ঋণ আদায় না হলে ব্যাংক যেন আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে সেজন্য সম্ভাব্য ক্ষতির বিপরীতে প্রভিশনের  ব্যবস্থা রাখা হয়। তাছাড়া আমানতকারীদের সুরক্ষার একমাত্র হাতিয়ারও ঋণের বিপরীতে সংরক্ষিত প্রভিশন নয়।

আমানতের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সুরক্ষানীতি রয়েছে; যেমন, প্রতিটি ব্যাংককেই তাদের ‘তলবি আমানত’ এবং ‘মেয়াদি আমানত’-এর সাড়ে ১৮ শতাংশ সিআরআর এবং এসএলআর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ, সোনা এবং সহজেই নগদায়নযোগ্য সিকিউরিটি আকারে জমা রাখতে হয়। একটি ব্যাংকের আমানত যদি ১০ হাজার কোটি টাকা হয়ে থাকে, তাহলে সিআরআর এবং এসএলআর হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এক হাজার ৮৫০ কোটি টাকা জমা থাকবে।

এছাড়াও ব্যাংকের নিয়মিত ঋণে সর্বনিম্ন ০.২৫ শতাংশ হারে এবং খেলাপি ঋণে সর্বোচ্চ ১০০ শতাংশ হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়, যা মোট অংকে বড় ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তাদের বর্তমান ঋণের অংক বিবেচনায় ৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার কম নয়। একাধিক বড় ব্যাংকের প্রত্যেকটির পরিশোধিত মূলধনও ২ হাজার কোটি টাকা থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা করে। এছাড়াও রয়েছে তরল ও স্থায়ী সম্পদ যেখান থেকে আনুপাতিক হারে আমানত দাবি পরিশোধ করার বিধান আছে ব্যাংক কোম্পানি আইনে।

আগেই বলেছি, আমানতকারীর টাকা ব্যাংক ঋণের  নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) থেকে পরিশোধ করে না,  আদায়কৃত ঋণের অর্থ থেকে প্রদান করে। সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় হতে। আয়ের অংশ থেকে ব্যাংকের ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এ আয়ের একটি অংশই আমানতী গ্রাহকদের স্বার্থে আলাদা তহবিলে (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ করা হয়, যা গ্রাহকদের জন্য বাড়তি পাওয়া। কারণ আমানতকারীদের প্রায় সমস্ত টাকাই ব্যাংকের দেয়া ঋণের টাকা থেকেই পরিশোধ সম্ভব।

একটি তথাকথিত ভুঁইফোড় কো-অপারেটিভ সোসাইটি বা এমএলএম কোম্পানি জনগণের কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করে, কিন্তু ৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে বাকি ৯৫ কোটি টাকা নিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। কিন্তু ব্যাংকের ক্ষেত্রে এমনটা সম্ভব নয়। কারণ ব্যাংক কোনো হায় হায় কোম্পানি নয় যে হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে। আর যদি সরকারি সিদ্ধান্তে অবসায়িত হতেও হয়, ব্যাংকের ঋণ আদায়যোগ্য এবং আদায়কৃত ঋণ হতেই আমানতকারীদের প্রায় সমস্ত পাওনা পরিশোধ সম্ভব।

কারণ, ব্যাংক তার গ্রাহকের আমানতের শতকরা ৮৫ থেকে ৯০ টাকা ঋণ দেয় এবং এ ঋণগুলো কারো আঙুলের ইশারায় বা মুখের কথায় দিয়ে দেয় না। ব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-নীতি এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ঋণগ্রহীতাকে আইনে বেঁধে তারপর এ ঋণগুলো বিতরণ করে থাকে। এজন্য ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য, এবং ব্যাংক গ্রাহকদের আমানতের যে অংশটি ঋণ হিসেবে দিয়ে থাকে তা অফেরতযোগ্য নয়। ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলেও ব্যাংকের ঋণ ফেরত আসবে।

ব্যাংক আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের মধ্যস্থতাকারী। ব্যাংক আমানতকারীর আমানতকে ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে সুদ আয় করে। এই সুদ আয় হতে আমানতকারীদেরকে সুদ প্রদান করে। তাই যে টাকা ঋণ দেওয়া হয়, আমানতকারীদের সুরক্ষা চিন্তা করে সেই টাকার সমপরিমাণ অর্থ কোনো অলস তহবিলে রেখে দেওয়া ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। আর আমানতকারীরা ব্যাংককে আমানত বিনামূল্যে দেয় না। আয়ের উদ্দেশ্যেই ব্যাংকে জমা রাখে। ব্যাংকও আয়ের উদ্দেশ্যে আমানতকে ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করে ঝুঁকি নেয়। তাহলে আয় করতে গিয়ে কিছুটা ঝুঁকি তো আমানতকারীকেও নিতে হবে অবশ্যই।

একটি ব্যাংকের ব্যালেন্স সিট ও আয় বিবরণীতে সম্পদ-দায় এবং আয়-ব্যয়ের অনেক নির্দেশক  থাকে। একটি নির্দেশকের উপর ভিত্তি করে পুরো ব্যালেন্স সিট বা আয় বিবরণী নিয়ে ঢালাও মন্তব্য চলে না। কোনো একটি নির্দেশক শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি অন্য আরেকটি নির্দেশক দুর্বল হতে পারে–এটা অস্বাভাবিক নয়। আবার সব নির্দেশকেই যদি ‘ক্রিস্টাল ক্লিয়ার’ মান চাই তাহলে ব্যাংককে হতে হবে ঐশী প্রতিষ্ঠান। আর তাহলেই হয়ত ব্যাংকের একটি টাকাও খেলাপি হবে না। কিন্তু ব্যাংক ঐশ্বরিক কোনো প্রতিষ্ঠান নয় বলে এমনটা সম্ভব নয়। তাই ব্যাংকের ঋণের একটা অংশ অনাদায়ী হবে, কিছু সূচকে প্রত্যাশিত মান থাকবে না–এটা স্বাভাবিক।

এবার চলমান গুজবের কেন্দ্রবিন্দুতে আসা যাক।  সম্প্রতি ‘আমানত সুরক্ষা আইন, ২০২০’ এর খসড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছিল, যাতে করে অংশীজনেরা আইনটির উপর নিজেদের মতামত কিংবা পরামর্শ দিতে পারেন। তবে এই আইনের শুধুমাত্র একটি বিষয়ই বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছে, আর সেটি হচ্ছে- ‘ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে গ্রাহকের হিসাবে এক কোটি টাকা থাকলেও এক লাখ টাকার বেশি পাবেন না।’

চলুন দেখি, ‘আমানত সুরক্ষা আইন ২০২০’ এর খসড়ায় আসলে কী বলা হয়েছে। ‘তহবিল এর দায়’ বিষয়ক ধারা-৭ এর (১) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের আদেশ হলে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ওই অবসায়িত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক আমানতকারীকে তার বীমাকৃত আমানতের সম পরিমাণ (যা সর্বাধিক এক লাখ টাকা অথবা সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত টাকার বেশি হবে না), তহবিল হতে প্রদান করবে। ৭ এর (২)  উপধারায় বলা হয়েছে, অবসায়িত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনও আমানতকারীর একাধিক হিসাব থাকলে ওই হিসাবে যদি একত্রে এক লাখ টাকার বেশি স্থিতি থাকে তবুও তাকে সর্বাধিক এক লাখ টাকা কিংবা সরকারের পুর্বানুমোদনক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত টাকার বেশি পরিশোধ করা হবে না। তবে পরে বিমার অর্থ ১ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখানে শুধু বীমার অর্থ পরিশোধ নিয়ে বলা হয়েছে, আমানতকারীর সম্পূর্ণ দায় পরিশোধ পদ্ধতি নিয়ে বলা হয়নি। অথচ গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে যে, এটাই আমানতকারীদের দায় পরিশোধের একমাত্র আইন, একমাত্র পদ্ধতি ও একমাত্র উৎস।

এবার বলুন তো এই আইনটি কি নতুন কোনো আইন? না, এটি পুরনো আইন–নতুন নামে, কিছু পরিবর্ধন-পরিমার্জন করে ২০০০ সালের ‘ব্যাংক আমানত বীমা আইন, ২০০০’ কে নতুনভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মূলত আরও অনেক আগে ১৯৮৪ সাল থেকেই আমানত বিমা স্কিম চালু হয়েছে। ২০০০ সালের আইনেও বীমাদাবি বাবদ প্রত্যেক আমানতকারীকে এক লক্ষ টাকা পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান ছিল। বর্তমান আইনেও তা-ই প্রস্তাব করা হয়েছে। তিন যুগ আগে চালু হওয়া বিধান নিয়ে এতদিন কোনো কথা হয়নি, আজ এতো কথা হচ্ছে কেন?

নিশ্চয় প্রচারের প্রসার ঘটেছে এবং গ্রাহকদের সচেতনতা বেড়েছে বলেই। কিন্তু সচেতনতার পাশাপাশি অনিশ্চিত এবং অখ্যাত উৎসের সংবাদে আস্থা দেখানোর কারণে গুজবতাড়িত হচ্ছেন অনেকেই। এতদিন গ্রাহকরা যে ব্যাংকে টাকা রেখেছে তারা কি সরকারের কোন গ্যারান্টির বিপরীতে টাকা জমা রেখেছে। না, ব্যাংকের উপর আস্থাই গ্রাহকদের সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি। তাহলে হঠাৎ করেই গ্রাহকরা ব্যাংক বন্ধে তাদের আমানতের সব টাকা সরকারকেই ফেরত দিতে হবে মর্মে নিশ্চয়তা চাচ্ছেন কেন? বুঝাই যাচ্ছে, গ্রাহকের ৫০ বছরের আস্থায় গুজবের ভাইরাস ঢুকেছে।

তবে এই গুজবের ভাইরাস সংক্রমণের পিছনে কিছু ব্যাংকারদের ভূমিকাও কিন্তু কম নয়। অনেক ব্যাংকারকে দেখছি অন্য ব্যাংকের মন্দ সংবাদগুলো   গর্বের সাথে শেয়ার করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। কেও কেও মিথ্যা রটনাও ছড়াচ্ছে অন্য প্রতিযোগী ব্যাংক সম্পর্কে। নিজের ব্যাংককে বড় করতে গিয়ে অন্য ব্যাংক সম্পর্কে গর্হিত ও অসত্য তথ্য দিয়ে পুরো ব্যাংক খাতকেই ডুবিয়ে দিচ্ছেন এভাবে কোন কোন ব্যাংকার।

ব্যাংক অবসায়িত বা বন্ধ হওয়া ছেলেখেলা নয়। মন চাইল আর কয়েকশ কোটি নিয়ে ব্যাংক খুলে বসলাম, কয়েকদিন পর ব্যবসা গুটিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম– এর নাম ব্যাংকিং নয়। আমরা ফারমার্স ব্যাংকের ক্ষেত্রে কী দেখেছি? পত্রিকা ও টেলিভিশনসংবাদে কত শিরোনামই  না দেখলাম- চেকের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না ফারমার্স ব্যাংক। কেও কেও বলেছেন ফারমার্স ব্যাংকের মরে যাওয়াই উচিৎ। কিন্তু বাস্তবে কী দেখেছি? সরকার এবং একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান ফারমার্স ব্যাংকের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, ব্যাংকটিকে তার সংকটময় সময় পার হতে সহায়তা করেছেন। ফারমার্স ব্যাংক ধীরে ধীরে হলেও ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করছে।

আর ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার জন্যই কি ব্যাংকগুলো একের পর এক শাখা, উপশাখা, এজেন্ট আউটলেট, কালেকশন বুথ, এটিএম বুথ স্থাপন করছেন এবং নিত্যনতুন সেবা ও প্রযুক্তির পরিসর ও উৎকর্ষ  বাড়িয়ে চলেছেন? কয়েকদিন আগেই তো বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের তালিকাভূক্তি হল। এসব কি ব্যাংকিং ব্যবসার প্রসার নির্দেশ করে নাকি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়–ভেবে দেখবেন নিশ্চয়।

বাংলাদেশে এখনো কোনো ব্যাংক বন্ধ, দেউলিয়া বা অবসায়নের ঘটনা ঘটেনি। কোনো ব্যাংকের অবস্থা খারাপ প্রতীয়মান হলে  বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা করে। এরপরও কাজ না হলে প্রশাসক বসিয়ে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেন। এমডির অপসারণ, পর্ষদ ভেঙে দেওয়া, ব্যাংকের নামের পরিবর্তনও করতে দেখা যায়। তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করা ও সরকারিভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে অধিগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। সবকিছু ব্যর্থ হলে আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষেই কেবল একটি ব্যাংকের অবসায়ন হতে পারে। এরপর ব্যাংকের সম্পদ ও দায় হিসাবের জন্য নিয়োগ হয় অবসায়ক, যিনি ব্যাংকের সম্পদ হতে পরিশোধ করবেন আমানতকারীদের পাওনা।

পরিশেষে বলতে পারি, আমানত বীমা  আমানতকারীদের আমানত পরিশোধের একমাত্র ও সবচেয়ে বড় উৎস নয়। সরকারি সিদ্ধান্তে কোন ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলেও আমানতকারীদের টাকা একাধিক উৎস হতে পরিশোধ করা হবে। তার একটি হচ্ছে আমানত বীমা ট্রাস্ট। এখান থেকে প্রত্যেক আমানতকারী দুই লক্ষ টাকা করে ফেরত পাবেন। এতে যদি আমানতকারীর পুরো টাকা পরিশোধ না হয়, বাকি টাকা ফেরত পাবেন বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষিত সিআরআর, এসএলআর, নিরাপত্তা সঞ্চিতি থেকে। এতেও সমস্ত আমানতদাবি পরিশোধ না হলে বাকি টাকা পরিশোধ করা হবে ব্যাংকের তরল ও স্থায়ী সম্পদ বিক্রি করে।

এবার আসি আমানত তুলে ফেলা গ্রাহকদের লাভ-ক্ষতি প্রসঙ্গে। কোনো কোনো ব্যাংকার গ্রাহকদের আমানত তুলে ফেলাকে ব্যাংকের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন। কারণ, তাদের মতে বর্তমানে ব্যাংকের অধিকাংশ আমানতই ৮ থেকে ১২ শতাংশের উচ্চ সুদে নেয়া আমানত। গ্রাহকরা এখন আমানত তুলে নিয়ে গেলে গুজবের শেষে আবার তা ব্যাংকেই ফেরত আসবে। তখন ব্যাংক ৫ থেকে ৬ শতাংশ হারে তা আবার জমা রাখবে। এতে করে ব্যাংকের  ৩ থেকে ৬ শতাংশ সুদ সাশ্রয় হবে।

যে সকল গ্রাহকগণ আমনত তুলে নিজের ঘরের সিন্ধুকে জমা রাখছেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, যদি এই গুজব আরো কয়েকদিন বা দীর্ঘ সময় ধরে চলে, তাহলে হয়তো সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণাও আসতে পারে যে, ‘৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট অবৈধ, এবং আদেশ  জারি হতে পারে- যাদের কাছে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট আছে, তারা সেগুলো অর্থের উৎস প্রমাণ করা সাপেক্ষে ব্যাংকে জমা দিতে পারলেই তা বৈধ বলে গণ্য হবে।’ আর এমনটা না হলেও আপনার অর্থের জন্য ব্যাংকই এখনো শ্রেষ্ঠ ও অদ্বিতীয় বিকল্প। গুজবের পিছন ছুটে ব্যাংক হতে টাকা উত্তোলন করে বাসায় রেখে নিজের অর্থ ও জীবন- উভয়কে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন না। তাছাড়া ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নিজেদের পেট ভারী করতে ভুঁইফোর প্রতিষ্ঠানগুলোও এই গুজব ছড়াতে পারে। তাই ভুঁইফোর কোনো প্রতিষ্ঠানে অর্থ ঢেলে স্বর্বসান্ত হবেন না।

আরেকটি কথা, ব্যাংক যখন ঋণ দেয় তখন কত কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজই না গ্রহণ করে থাকে। কোটি কোটি টাকা  মূল্যমানের ফ্ল্যাট, বাড়ি, জমিজমা বন্ধক নেয়- তারপর ঋণ দেয়। আর আমানতকারী যখন ব্যাংকে টাকা রাখে, তখন মাত্র দুইজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর সংবলিত একটি কার্বনাইজড স্লিপ নিয়ে নিশ্চিন্তে চলে যায়, কোনো সাক্ষী-প্রমাণের বালাই ছাড়াই। এখানে কি সরকারি গ্যারান্টি বলে আমানতকারী এতটা নিশ্চিত? না, এখানে আমানতকারীর গ্যারান্টির নাম ‘ব্যাংকের উপর অবিচল আস্থা’। এত আস্থার প্রতীক যে ব্যাংকগুলো, সে ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখতে গেলে আজ আপনাকে পুরো টাকা ফেরতের নিঃছিদ্র সরকারি অঙ্গীকার লাগবে কী কারণে? একবার ঠান্ডা মাথায় ভাবুন।

আরও দেখুন:
ব্যাংক কি বা ব্যাংক কাকে বলে?
বাণিজ্যিক ব্যাংকের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা

ব্যাংকারদের জন্য শেষ কথা, গুজবতাড়িত মানুষকে যুক্তির ঢালি খুলে বুঝালেও লাভ হয় না। তাই গুজবকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলেও ফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কয়েকদিন পর গুজব নামক ভাইরাসটি এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়বে। সবই আগের মত হয়ে যাবে। সত্যিই যখন কোনো ব্যাংক দেউলিয়া বা বন্ধ হচ্ছে না, তাই গুজব পরবর্তীতে মানুষ বুঝতে পারবে যে, তাদের ধারণা বা তাদেরকে যা বুঝানো হয়েছে তা সঠিক নয়। ফলশ্রুতিতে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা আরো বেড়ে যাবে। যদিও সাময়িক কিছু আমানত বেরিয়ে যাবে, তবুও ব্যাংকারদের দুশ্চিন্তার কিছু আছে বলে মনে হয় না।

লেখকঃ ব্যাংকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button