ব্যাংকিং

প্রাচীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা মরক্কোয় যেভাবে গড়ে ওঠে

বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ‘বার্বার’ জনগোষ্ঠীর উত্পত্তি ও বিকাশ খ্রিস্টপূর্ব ছয় হাজার থেকে দুই হাজার অব্দের মধ্যে। আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি থাকলেও উত্তর আফ্রিকাই তাদের প্রধান আবাস। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে উত্তর আফ্রিকা মুসলিম শাসনাধীন হলে ‘বার্বার’ জাতি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ইসলাম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। তাদের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছিল বিশ্বের প্রথম ব্যাংকিং ব্যবস্থা।

ব্যাংক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন:
প্রাচীনকালে পাহাড় ও মরু প্রধান উত্তর আফ্রিকার অধিবাসীদের নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সংকটের সঙ্গে সংগ্রাম করে বাঁচতে হতো। তাই প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তাদের ভেতর। প্রত্যেক গোষ্ঠীর লোকেরা নির্ধারিত মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য জীবনোপকরণ জমা রাখত। স্থানীয় ভাষায় যাকে ‘আগাদির’ বলা হয়। ইংরেজিতে Granary বা শস্যভাণ্ডার বলা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু শস্যদানা রাখা হলেও পরবর্তী সময়ে তালিকায় যুক্ত হয় সব মূল্যবান বস্তু।

আরও দেখুন:
ব্যাংক কি বা ব্যাংক কাকে বলে?
ব্যাংকিং কি বা ব্যাংকিং কাকে বলে?

মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব:
বার্বারদের দ্বারা বিকশিত ব্যাংকিংব্যবস্থায় মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব দৃশ্যমান। যেমন স্থানীয় ‘আগাদির’ শব্দটি আরবি ‘আগদুরাতুন’ শব্দের বহুবচন। যার অর্থ পাথুরে কঠিন ভূমিতে কোনো কিছু নিক্ষেপ করা। আর এ পর্যন্ত মরক্কোতে যে কয়েকটি আগাদির আবিষ্কৃত হয়েছে তার সবই পাথর দ্বারা নির্মিত। দ্বিতীয়ত আগাদিরের দায়িত্বশীলকে বলা হতো ‘আমিন’, যা একটি ইসলামী পরিভাষা। ইসলামী রাষ্ট্রের ‘খাজাঞ্জি’ বা ট্রেজারারকে আমিন বলা হয়। এসব পরিভাষা দ্বারা প্রমাণিত হয় বার্বারদের মধ্যে ব্যাংকিংব্যবস্থা বিকাশে আরব মুসলিমরা বিশেষ অবদান রেখেছিল।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

স্থান ও সময়:
এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত আগাদিরগুলোর অবস্থান দক্ষিণ মরক্কোতে। প্রায় ১০টি আগাদিরের সর্বপ্রাচীনটি খ্রিস্টীয় দশম শতকে নির্মিত। সাধারণত নিরাপদ স্থানেই তা নির্মাণ করা হতো। পাহাড়ের চূড়া বা দুই টিলার মধ্যবর্তী সমতল ভূমি বেছে নেওয়া হতো আগাদির নির্মাণের জন্য।

উল্লেখ্য, উত্তর আফ্রিকা উমাইয়া শাসনামলে (৬৬১-৭৫০ খ্রি.) ইসলামী খেলাফতের অধীনে আসে। সুতরাং এ কথা বলা যায়, মুসলিম শাসনামলেই বিশ্বের প্রাচীনতম ব্যাংকিং ব্যবস্থা আগাদির গড়ে উঠেছিল।

নির্মাণশৈলী:
আগাদিরের নির্মাণশৈলী ও অবকাঠামো ছিল সুরক্ষিত দুর্গের মতো। একটি সামরিক দুর্গের মতোই কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল সেখানে। এগুলোর নির্মাণশৈলীও ছিল অসাধারণ।

যা কিছু জমা থাকত:
আগাদিরের যাত্রা শস্যভাণ্ডার হিসেবে হলেও ক্রমেই তা ‘ধনভাণ্ডারে’ রূপান্তরিত হয়। গবেষকদের দাবি, আগাদিরে শস্য থেকে শুরু করে দামি তৈজসপত্র, স্বর্ণ-রৌপ্য; এমনকি দলিলপত্র পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হতো। এককথায় যেকোনো মূল্যবান জিনিসই সেখানে রাখা হতো।

আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার সঙ্গে মিল ও অমিল:
আগাদির বিষয়ক গবেষক সাঈদ উফকির বলেন, ‘আমি প্রাচীন ভাণ্ডার আগাদির সম্পর্কে বলতে চাই, যা অত্র অঞ্চলে ব্যাংকের মতো। যেখানে গম ও যবের মতো শস্য সংরক্ষণ করা হতো। দলিলপত্র যেমন খাজনার রসিদ জমা রাখা হতো। অলংকারও রাখা হতো। বিশেষত রৌপ্য। তবে (আধুনিক ব্যাংকের মতো) বেশির ভাগ মানুষ দীর্ঘ সময় সেখানে পণ্য রাখত না। আগাদিরের ‘সংরক্ষণকক্ষে’র দায়িত্বশীলকে ‘লামিন’ (আরবি আমিন) বলা হতো। পরিচালনার জন্য ১০ বা ততোধিক সদস্যের একটি কমিটিও থাকত যাকে বলে ‘ইনফ্লাস’। এই কমিটিতে সব গোত্রের একজন করে প্রতিনিধি থাকত। আগাদির পরিচালনার আইন ও সেবাগ্রহণের শর্তাবলিগুলো কাঠের পাটাতনে লেখা থাকত। সংরক্ষিত পণ্যের বিবরণও লিখে রাখা হতো।’

আগাদির ও আধুনিক ব্যাংকিংয়ের উত্থান:
গবেষক অধ্যাপক খালিদ আল-আওয়াদ বলেন, “আমি বলতে চাই, এই রক্ষণাগারগুলো সম্ভবত সম্মিলিত ব্যাংকব্যবস্থার প্রথম উত্থান ছিল। কেননা আমরা সম্পদ সংরক্ষণের নিরাপদ স্থানকে ব্যাংক বলি। আধুনিক ব্যাংকগুলো তাদের নথিপত্র সংরক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত করেছেন। ব্যাংক ব্যবস্থার প্রাচীনতম লিখিত নথি হলো ‘আগাদির আগারিফ’-এর নথি, যা খ্রিস্টীয় ১৪৯২ অব্দে লেখা।

আমরা জানি, কোনো অঞ্চলে লেখার প্রচলন তখনই হয়, যখন অত্র অঞ্চলের মানুষ উন্নয়নের একটি পর্যায়ে পৌঁছে যায়। অর্থাৎ তারা সূচনাকাল থেকে স্থিতিকালে উপনীত হয়।” মরক্কোবাসীর দাবি ও প্রত্যাশা হলো বিশ্ব ব্যাংকিং ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ এ নিদর্শনগুলোকে ইউনোসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেবে।

সূত্র: আল জাজিরা, দ্য ন্যাশনসটাইমস, টেলার রিপোর্ট ও উইকিপিডিয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button