বিশেষ কলাম

রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বাস্তবায়ন চাই!

কে এম মাসুম বিল্লাহঃ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ব্যাংকিং খাতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের শরীরে রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে যেমন যাবতীয় প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন হয়ে থাকে, দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলোও একই ভূমিকা পালন করে থাকে। ব্যাংকিং পেশা অন্যান্য পেশার তুলনায় যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। এই পেশায় নিয়োজিত কর্মীদের যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়, রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর শাখাগুলোতে সবসময় ব্যস্ত ও কর্মমুখর পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। কর্মীদের যেনো দম ফেলানোর সময় থাকেনা। অফিস টাইম ৬টা পর্যন্ত হলেও ব্যাংকগুলোর শাখা বন্ধ হতে অনেক সময় রাত হয় যায়। তবে এতে ওভার টাইমের কোনো ব্যবস্থা নেই ব্যাংক কর্মীদের।

বিশ্ব ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু তার বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ভারসাম্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ভূমিকা অত্যন্ত জোরালো’। যোগ্যতা সমান এবং সেবার ধরন একই রকম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মীরা বেসরকারী ব্যাংকের তুলনায় প্রায় অর্ধেক বেতন পেয়ে থাকেন যা অত্যন্ত দুংখজনক।

আরও দেখুন:
ব্যাংকারদের সর্বনিম্ন বেতন বেঁধে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক

প্রায় দেড় যুগ আগ থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তাদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবি জানিয়ে আসছে। এছাড়াও চারটি বানিজ্যিক ব্যাংকও তাদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবি জানিয়ে আসছে অনেক দিন থেকে। ২০১৩-১৪ সালের দিকে কেন্দ্রীয় ও রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো তৈরীর উদ্যোগ নেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো এবং রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য অভিন্ন বেতন কাঠামোর প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিলো অর্থ মন্ত্রনালয়ে, প্রস্তাবিত কাঠামোতে জাতীয় বেতন স্কেলের তুলনায় এসব ব্যাংকারের বেতন-ভাতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছিলো।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এছাড়াও বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বেতন কাঠামো দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন বলে সংবাদ প্রচার করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত অজানা কারনে তা আটকে যায়। অথচ ২০১৩ সালের নভেম্বরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের জন্য স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো হবে। তৎকালীন অর্থসচিব ফজলে কবির এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমও তখন বলেছিলেন, ‘সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। প্রজ্ঞাপন হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার।’

রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়ায় তৎকালীন সময়ে মিডিয়াতে হতাশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তৎকালীন এই গভর্নর হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “ব্যাংকারদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো আনতে না পেরে খুবই দুঃখিত।’ তিনি জানিয়েছিলেন, ব্যাংকের জন্য আলাদা বেতন কাঠামোর প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করেছিলেন। আইন মন্ত্রণালয় থেকেও সে প্রস্তাব ভেটিং হয়েছিল। এর পরও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন হয়নি। এটি সবার জন্য দুঃখজনক। সরকারের উচিত হবে ব্যাংক খাতের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেতন ও সুযোগ সুবিধার পার্থক্য বৈষম্য তৈরী করছে। দুর্বল বেতন কাঠামোর জন্য নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার পর কয়েক মাস কাজ না করেই উচ্চ বেতনে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে চলে যাবার মত অবস্থা তৈরী হয়। অথচ তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সময়, শ্রম ও অর্থ সবই ব্যয় হয়। দক্ষ মানবসম্পদ পাওয়া এবং বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্যও দরকার এ খাতের জন্য আলাদা কাঠামো। রাষ্ট্রের আর্থিক খাতের বিভিন্ন সেবা পৌছে দিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আছে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন শাখা। বসার জায়গা বৃদ্ধিসহ বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোতে। ফলে গাদাগাদি করে কোনোরকমে বসে কাজ সারতে হয়, যেখানে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের উপযুক্ত পরিবেশও অনেক সময় থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে বেতন বৈষম্য যেনো চরম হতাশা তৈরী করে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মীদের মাঝে।

সর্বশেষ এ বছর ২০ জানুয়ারী বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় যেখানে বেসরকারি বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মীদের জন্য বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা, প্রারম্ভিক বেতন নির্ধারন করে দেয়া হয় যা এবছরের মার্চ মাস থেকে কার্যকরের কথা বলা হয়। বেসরকারি ব্যাংকের একজন পরিছন্নতা কর্মীর বেতন নির্ধারন করা হয় ২৪,০০০ টাকা! অত্যন্ত দুংখজনক হলেও সত্য যে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর একজন ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা ১৬,০০০ টাকা বেসিকে সর্বমোট ২৪,৭০০ টাকা পেয়ে থাকেন!

অন্য দিকে, প্রবেশনারী পিরিয়ড শেষে বেসরকারি ব্যাংকের একজন এসিস্ট্যান্ট অফিসারের বেতন ধরা হয় ৩৯,০০০ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলো তাদের দক্ষ কর্মীদের কতটুকু ধরে রাখতে সক্ষম হবে কিংবা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সাথে কতটুকু প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে সেটাই বড় প্রশ্ন! বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক অর্থমন্ত্রী কয়েকবার স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মীদের মধ্যে কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি করতে সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি পরলে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর এসব যৌক্তিক দাবি পূরন হবে বলে ব্যাংকারদের বিশ্বাস।

কে এম মাসুম বিল্লাহ, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button