বিশেষ কলাম

ট্রান্সফার: কী বার্তা দিয়ে যায়?

নুরুল ইসলাম খলিফাঃ কর্মজীবনে ট্রান্সফার একটি অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ। একেবারেই বিশেষ ও সীমিত দু’য়েকটা ক্ষেত্র বাদ দিলে, চাকুরী জীবনে বদলী বা ট্রান্সফার নেই এমনটা বিরল। একজন আমাকে বলেছিলেন যে, গোরস্তানের পাশে বসবাস করলে লাশ দেখা যেমন অনিবার্য, তেমনি চাকুরী করলে ট্রান্সফার বা বদলী হওয়াও অবশ্যাম্ভাবী। ট্রান্সফার মানে দায়িত্ব বা কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগ্যতা ও দক্ষতার বিকাশ সাধন হয় , অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হয়। এভাবেই একজন কর্মী আস্তে আস্তে বৃহত্তর দায়িত্বের উপযুক্ত হয়।

প্রায় ৪৫ বছরের কর্মজীবনে হাই স্কুলের শিক্ষকতার সাড়ে চার বছর বাদ দিলে বাকী চার দশকেরও বেশি সময়ে অনেক বার এই ট্রান্সফারের মুখোমুখী হয়েছি। বহু সহকর্মীদেরকে বিদায় দিয়েছি, নতুনদেরকে বরন করেছি, সবক্ষেত্রেই তো ট্রান্সফার একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। ট্রান্সফারের চিঠি হাতে এলে কেউ খুশী হয়, কেউ কষ্ট পায়, কেউ হাসে আবার কেউ কাঁদে। কিন্তু একটি কমন বিষয় হচ্ছে যে, কর্মস্থল পরিবর্তনের মুহুর্তে একটি বিষাদের অনুভূতি আচ্ছন্ন করে ফেলে হৃদয় মনকে। যেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য নিজেই হয়তো অনুরোধ করেছি, আবার সেখান থেকে বিদায় নেয়ার সময়ে চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছে; হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়েছে।

আরও দেখুন:
নতুন জায়গায় বদলিঃ অনুজ ব্যাংকারদের উদ্দেশ্যে দু’টি কথা

প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা, প্রতিটি আসবাবপত্র যেন আমাকে ভীষনভাবে আকর্ষন করতো। যাওয়ার সময়ে সেগুলো জীবন্ত হয়ে যেন সামনে দাঁড়াতো এবং কথা বলতো, ‘আমদেরকে তুমি ছেড়ে যাচ্ছো?’ হৃদয়ের কোন তন্ত্রীতে যেন টান পড়তো বুঝতে পারতাম না; কিন্তু একটা অব্যক্ত বোবা কান্না চেপে ধরতো গোটা অস্তিত্বকে। কখনও এক শাখা থেকে অন্য শাখায় যোগদান করে নিজেকেই অচেনা লাগতো। মনে আছে একবার এক শাখা থেকে বদলী হয়ে নতুন জায়গায় দু’তিন রাতে একা একা কেঁদেছি অথচ সেখান থেকে বদলী আমার প্রত্যাশিত ছিল। এমনটা সম্ভবত শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, বোধ করি প্রায় সকলেরই হয়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

কর্মজীবনের এই ট্রান্সফার কি আমাদেরকে কোনো বার্তা দেয়? আমার মনে হয় একটি কঠিন এবং শাশ্বত বার্তাই দেয় এই ধরনের ট্রান্সফার। সেটি হচ্ছে চূড়ান্ত ট্রান্সফার বা ইন্তেকালের বার্তা। ইন্তেকাল মানে নাকি স্থানান্তর যার মানে তো বদলীই হয়। পার্থক্য এই যে, কোনো কোনো ট্রান্সফার আমাদের অনুরোধে হয়; ইন্তেকাল আমাদের অনিচ্ছায় হয় যেমনটা কোনো কোনো ট্রান্সফারের বেলায়ও হয়। ট্রান্সফার আমার পিছনের সকল ক্ষমতা, প্রভাব মুছে দেয়; আমার অবস্থান পুরোপুরি বদলে দেয়। পুরানো কর্মস্থলে গেলে মনে হতো এই টেবিলে বসেই আমি কত সিদ্ধান্ত দিয়েছি, কত নির্দেশ দিয়েছি; অথচ এখন আমি এখানে মেহমান। আমাদের জীবনের সাথে অনেকটাই মিল রয়েছে। নিজের ঘর, নিজের বাড়ি অথচ একটা মাত্র হুকুমে সব কিছুই বদলে যায়। পার্থক্য হচ্ছে, সাময়িক এই বদলীর পরে আমরা কথা বলি, হাসি-কাঁদি কিন্তু চূড়ান্ত বদলীর পরে আমরা নিথর, নীরব ও নির্বাক হয়ে যাই।

আজকে ভোরে এক প্রাক্তন সহকর্মীর সাথে কথা বলছিলাম যিনি এক শাখা থেকে দূরবর্তী আরেক শাখায় বদলী হয়েছেন। বলছিলেন, ‘স্যার! নিজের মালামালগুলো যখন গোছাচ্ছিলাম, তখন বার বার মনে হচ্ছিল এই জিনিসগুলো আসলে আমার কতটুকু প্রয়োজন ছিল? কেন এই বাহুল্য আয়োজন? ক্ষণস্থায়ী আমরা আমাদের এই জীবনে এত কিছু জড়িয়ে নিলাম কেন?’ বললাম, ‘সবই প্রয়োজন আছে, শুধু মনে রাখতে পারলেই হলো যে, আমার অবস্থানটি খুবই সাময়িক।’ আরও বললাম, ‘আপনার ঐ চেয়ারেই আমি প্রায় পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসেছিলাম। আজ আমি আমার নিজের ঘরে; কাল না হয় পরশু আমি হারিয়ে যাবো চোখের আড়ালে। কাজেই আমরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যেন মনে রাখতে পারি, এটি আমার অনন্ত জীবনের পাথেয় হতে পারে; আবার আমার জন্য তা মহা বিপদের কারনও হতে পারে। চুড়ান্ত সত্য হচ্ছে যে আমার এই অবস্থান ও মর্যাদা ক্ষণস্থায়ী। এটি আমার জন্য একটি পরীক্ষা; পাশ করবো না ফেল করবো সেটি আমার উপরই নির্ভর করে।’

বছরের শুরুতে ব্যাংকের অনেক কর্মীই ট্রান্সফার হয়েছেন। নতুন কর্মস্থলে সকলের কল্যাণ কামনা করছি; তাদের চলার পথ সুগম হোক, সুন্দর হোক। সফলতার ফুল ফসলে ভরে উঠুক তাদের জীবন! সততা, নিষ্ঠা ও আমানতদারীর সাথে দায়িত্ব পালনের তাওফিক দিন আল্লাহ! ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যকে উচ্চকিত করার মধ্য দিয়ে পার্থিব জীবনের পাশাপাশি অনন্ত জীবনের সাফল্যও তাদের পদচুম্বন করুক এই প্রত্যাশা থাকলো!

লেখকঃ নুরুল ইসলাম খলিফা, সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও সাবেক প্রিন্সিপাল, ট্রেইনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button