প্রবাসী ব্যাংকিং

প্রবাসীদের ঋণ শোধের সময়

বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির ধাক্কাটা প্রাথমিকভাবে কর্মসংস্থানের উপর পড়বে তার অনুমান আগেই করা হয়। করোনার প্রভাবে আমাদের মতো অর্থনীতির দেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো। মাসের পর মাস ধরে কঠোর লকডাউনের কবলে পড়ে ওসব দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও বন্ধ হয়। শিল্প-বাণিজ্য, পর্যটন, সকল সেবা এবং উৎপাদন খাতে স্থবিরতা চেপে বসে। ফলে সঙ্গত কারণে লকডাউন সময়ে শ্রমিকদের বসিয়ে রাখতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে অনেক দেশে। আর তাই বিভিন্ন মাধ্যমে খবর আসতে থাকে যে লকডাউন উঠে যাবার পর কাজ হারিয়ে বিদেশ থেকে ফিরতে বাধ্য হবেন বিপুল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক। শেষ পর্যন্ত সে আশংকাই বুঝি সত্য হতে চললো। করোনার প্রভাবে কর্মচ্যুত হয়ে প্রায় ৪৩ হাজার প্রবাসী দেশে ফিরেছেন মর্মে সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়। এ সংখ্যাটি অবশ্য স্বাভাবিক সময়ে দেশে আগত ও আটকে পড়া প্রায় ২ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের অতিরিক্ত।

পরিস্থিতির জটিলতায় স্বাভাবিক সময়ে ছুটিতে দেশে আসা প্রবাসীরাও পড়েছেন বিপাকে। তাদের অনেকের ছুটির মেয়াদ শেষ। অনেকের আবার ছুটি এবং ভিসা উভয়টির মেয়াদ শেষ। যাদের ভিসা এবং আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র ঠিক আছে তারা ফিরে যাবার ব্যাপারে আশাবাদী। এতদিন চাকরিদাতা কোম্পানি এবং ব্যক্তির তরফে তাদের বলা হচ্ছিল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদের ডাক পড়তে পারে। এমনই আশা-নিরাশার দোলাচলে যাপিত সময়ের পর প্রবাসীরা এখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখী। সৌদি আরবে কর্মরত শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরার ডেটলাইন ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ফিরতে না পারাদের এখন সময় আরো কঠিন।

শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে প্রথম বিরোধ বাধে বাংলাদেশ বিমান এবং সৌদি এয়ারলাইন্সের মাঝে শ্রমিকদের পরিবহণ নিয়ে। সৌদিয়া একাই সব যাত্রী বহন করতে চাইলে বাধ সাধে বিমান। সপ্তাহের ব্যবধানে উভয় এয়ারলাইন্সের সম্মতিতে সমঝোতমূলক সমাধান হয় যে, উভয়েই যাত্রি বহন করবে। প্রবাসী শ্রমিকরা আশ্বস্ত হয় এবং টিকেটের জন্য দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ বিমান এবং সৌদি এয়ারলাইন্স অফিসে। কিন্তু নানা অজুহাতে টিকেট প্রাপ্তিতে বিলম্ব ঘটে। অনিশ্চিত টানপোড়েনে আক্রান্ত হয়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকগণ প্রতিবাদ ‍শুরু করেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সক্রিয় হয় পররাষ্ট্র এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। অতঃপর কিছু লোকের হাতে টিকেট পৌঁছায় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি টাকায়।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

ইতিমধ্যে আটকে পড়া প্রবাসীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে নানা কারণে। আয় উপার্জন না থাকায় সঞ্চয় ভেঙে খেয়ে শেষ করে এখন ঋণের উপর চলছেন অনেকেই। কাতার প্রবাসী এমন একজনের সাথে কথা হচ্ছিল সেদিন। দেশে ছুটি কাটিয়ে যার ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ফেরার কথা। কিন্তু বিশ্বময় করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের কবলে তার যাত্রা বিলম্বিত হয়। এক মাস, দু’মাস করে অতিরিক্ত ছ’মাস কাটিয়ে দিলেন দেশে। এখন কর্মস্থলে ফেরার জন্য হাঁসফাস করছেন। কিন্তু যেতে পারছেন না। নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে না ফিরতে পারায় আয় উপার্জনহীন এ সময়ে হাতে থাকা সব সঞ্চয় শেষ করেছেন পারিবারিক খরচ মেটাতে। তদুপরি আরো লক্ষাধিক টাকা ঋণও করে ফেলেছেন। এখন চিন্তায় আছেন কোম্পানির ডাক পেলেও কাগপত্রাদি হালনাগাদের খরচসহ প্লেন ভাড়ার টাকা যোগাড় নিয়ে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

মার্চে দেশে আসা আরেক প্রবাসীও ইনবক্সে বলছিলেন তার দুঃখের কথা। তার ছুটি, ভিসা এবং আকামার মেয়াদ সবই শেষ। হাতে টাকা নেই বলে সুযোগ পেলেও এসব নবায়ন করে তার পক্ষে আর প্রবাসে ফেরা সম্ভব নয়। তদুপরি আয় উপার্জনহীন এ দুঃসময়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানালেন অকপটে। অনার্স গ্রাজুয়েট এই প্রবাসী জীবিকার প্রয়োজনে দেশের ভেতরই এখন যেকোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ চান। বিনয়ের সাথে অনুরোধ করেন যেনো সম্ভব হলে আমি তাকে এক্ষেত্রে কিছুটা সহযোগিতা করি। এর বাইরেও ব্যাংকে সাক্ষাৎ করতে আসা আটকে পড়া প্রায় প্রতিটি প্রবাসী তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে শংকার কথা জানান অকপটে।

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথম জনশক্তি রফতানি শুরু হয়। প্রথম ১৪ হাজার জনের প্রথম দলটি কাজের সন্ধানে মধ্যেপ্রাচ্যে যায়। সেবছরই তাদের মাধ্যমে দেশে পাঁচ কোটি ডলার রেমিটেন্স প্রবেশ করে। এরপর থেকে প্রতিবছর বিদেশগামীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একই সাথে মধ্যেপ্রাচ্যের বাইরেও এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকাসহ বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্র বিস্তৃতি হয়। পর্যায়ক্রমে বিদেশগামী মানুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এক সময় তা কোটি ছাড়ায়। তবে ছিয়াত্তরের সেই প্রথম যাত্রার পর থেকে এ যাবৎ প্রবাসীদের এতবড় ধাক্কার মুখোমুখী হতে হয়নি আর।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি৷ বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পযর্ন্ত এক কোটিরও বেশি বাংলদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন৷ তারা সবমিলিয়ে দুই লাখ ১৭ হাজার মিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন৷

নিজের এবং পরিবারের ভাগ্য গড়ার নেশায় দেশের মায়া ত্যাগ করে প্রবাসীরা বিদেশে বিভূঁইয়ে জীবনের সোনালী অধ্যায়টুকু নিঃশেষ করে দিচ্ছেন তিলে তিলে। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মরুভূমি, মালয়েশিয়ার বিপদসংকুল পাম বাগান কিংবা ইউরোপ আমেরিকার হিমশীতল পরিবেশে কাজ করা প্রবাসীদের রাতদিন খেটেখুটে উপার্জিত অর্থ তাদের পারিবারিক জীবনে যেমন স্বাচ্ছন্দ আনে তেমনি জাতীয় উন্নয়নে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রবাসীদের সেই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদেরকে বলা হয় রেমিটেন্স যোদ্ধা। কিন্তু সেটা কাগজে কলমেই। দেশে কিংবা বিদেশে তারা ন্যূনতম সম্মানিতও নন কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের ৭৫ শতাংশই আছেন মধ্যপ্রাচ্যে৷ এককভাবে শুধু সৌদি আরবেই আছেন ২০ লাখ বাংলাদেশি৷ আরব আমিরাতে আছেন অন্তত ১৫ লাখ৷ এছাড়া কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইনের গড়ে তিন থেকে চার লাখ বাংলাদেশি আছেন৷ একে তো করোনা তার ওপর জ্বালানি তেলের দাম একেবারেই কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে নানা সংকট তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়বে প্রবাসীদের উপর।

বাংলাদেশে ব্যাংকের গবেষণা তথ্য মতে, ৪৭% অভিবাসী টাকা ধার করে বিদেশে যায়। আবার ৪১% যায় জমি/ভিটেমাটি বিক্রি করে কিংবা বন্ধক দিয়ে। সে অর্থে প্রবাসীরা স্বদ্যোগী কর্মসংস্থানকারী (Self Employed)। নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজনে পথ খুঁজতে গিয়ে দালালের হাত দিয়ে বিদেশে যাওয়ায় বেড়ে যায় অভিবাসন ব্যয়। প্রতারিতও হন অনেকে। রাষ্ট্র সেখানে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করলেও নিরুপায় অভিবাসন প্রত্যাশীরা এসব মেনেই বিদেশে পাড়ি জমান।

তবে বর্তমানে প্রবাসীরা যে অভূতপূর্ব সংকটে পড়েছেন তা থেকে সহজ উত্তরণের পথটি রাষ্ট্রই তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে কাযর্কর যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করতে হবে। আর আটকে পড়া অভিবাসীদের কাগজপত্র নবায়ন এবং বিমান টিকেটের বাড়তি খরচের চাপে না ফেলে ভর্তুকি ব্যয়ে কর্মস্থলে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তাতে হয়ত গত চুয়াল্লিশ বছর ধরে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে ভুমিকা রাখা প্রবাসী তথা রেমিটেন্স যোদ্ধাদের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে।

লেখকঃ মোঃ মোসলেহ উদ্দিন, কবি, প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার। [প্রকাশিত এই লেখাটি লেখকের একান্তই নিজস্ব। ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখা ও মতামতের জন্য ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ দায়ী নয়।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button