ব্যাংকার

এক অসহায় ব্যাংকারের আত্মসমর্পণ

নিস্তব্ধতার আঁধার ভেঙ্গে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে জানালার গ্রীলটাতে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনা খুঁজে ফিরি। বাড়ির কথা মনে হতেই আনমনা হয়ে টেলিভিশনের রিমোটটি হাতে একটার পর একটা চ্যানেল সার্ফিং করি।

চাকরির সুবাদে বাড়ি থেকে অনেক দূরে একা অবস্থান করে অসাধারণ একটা সময় কাটছে কোন ভাবেই বলা চলবে না। বসে বসে চিন্তার ভাজ কপালে ঠেকল। অন্ধকারময় সময় যেন আরও নি:সঙ্গতার আভাস দেয়।

টিক টিক করে ঘড়ির কাটাটি বেজেই চলল। নিষ্প্রাণ শহরের নিষ্প্রভ চেহারা আগে আর কখনো অনুধাবন করতে পারিনি। কখনো বসে বসে চিন্তিত মনে একা একা পাঁয়চারী করি কখনো বা মোবাইলখানা হাতে নিয়ে বার বার খবরের সর্বশেষ খবর জানতে চাই। বিষন্নতায় মনকে যখন আটকিয়ে রাখে তখন স্বেচ্ছাচারিতাও যেমন কাজে আসে না তেমনি সময়ের সুন্দর স্বপ্নগুলোও কেমন যেন অমলিন থেকে যায়।

জানালার অদূরে বাইরে করমচা গাছটাও কেমন যেন নেতিয়ে আছে! জীবনটাও কি তেমনিভাবে প্রোত্থিত থাকে? মনের অগোচরে গহীন নির্জনে জেগে থাকা রাস্তার ল্যাম্প পোস্টগুলির এক ঝিলিক আলোও রাতের নির্জনতার একাকীত্বকে দূর করতে পারেনি। যে কয়টি গাছ রাস্তার ওপাশে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে সবগুলোকেই অজান্তে বিষণ্নতার এক অহংবোধে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

রাতের নির্জনতার ভালবাসার টানেই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়ে মাঝ রাতে দু’ একজন বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে চা খাওয়ার উপলক্ষে রাস্তায় বের হয়ে চা খেয়ে আসতাম। চা খাওয়ার পর সিগারেট খাওয়ার ফ্যাশনটা আমাকে খুব কাছে টেনে নিতো বলেই তো ভাবতাম, পুরুষদের সিগারেট খাওয়া বুঝি তাদের স্মার্টনেসের একটা দারুণ অংশ। একাকীত্ব থেকে রক্ষা করতে একটা সিগারেট হাতে নিলাম।

রাত যতই ঘনিয়ে আসছে মনটা ততই কেমন যেন বেঁকে বসছে। যেহেতুে চাকরির সুবাদে অনেক দূরে অবস্থান করছি ,তাই হয়তো স্থবিরতা আরো ঘিরে ধরেছে। বাড়িতে বয়স্ক মা-বাবাকে রেখে দূরে অবস্থান করাটা অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকে গেছে। মাঝে মাঝে চিন্তা হয়, নিজের চাকরিটাকে সামলিয়ে চলতে গেলে অনেক কিছু থেকে দূরে থাকতে হয়। তাই হয়তো প্রতিদিনের চিরচেনা ভঙ্গিতে রাত জেগে জেগে রবীন্দ্র সঙ্গীতটুকুও আর শোনা হয় না।

একটি বাড়ির চারতলার চারটি রুমে চারজন থাকি।বর্তমানে আমি ছাড়া অন্যান্য চাকরিজীবিরা নিজের বাড়িতে তাদের অতি আপনজনের কাছে একান্ত নিরাপদ বোধের জন্যই চলে গেছেন। বর্তমান সময়ে আমার কাছে আমার রুমটাই যে নি:সঙ্গতার সবচেয়ে বড় সঙ্গী, নিরাপদ আশ্রয়স্থল! আট-দশদিন হল কাজের বুয়াটাও আসছে না। আগে দুবেলা রান্না হতো বলে দুবেলা খেয়েই দিন চালিয়ে নিতাম। বুয়া না আসায় স্তব্ধতা আরো একধাপ বেড়ে গেল বৈকি!

আমার কলিগ উত্তম দা বলতেন, সুন্দর করে রান্না করার মাঝেও একটা আর্ট থাকে। একবেলা খেয়ে দুবেলা ধারণের জন্য মিষ্টি আলু এক্ষেত্রে মোক্ষম অস্ত্র বলে চালিয়ে দেয়াকেই আর্ট বলে চালিয়ে নেই।

সকালে ব্যাংকে আসার পর মনে হলো এখনো কোন কোন মানুষের মাঝে টাকার মহত্ত্বটাই বেশি! এত করে সচেতনতার আবডাল বুঝানোর পরও নিজের অহংবোধটাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়! তা না হলে বর্তমান সময়ে এত এত লোকজনের ভীড় ঠেলে মাসিক ডিপিএস জমা দেবার জন্যও ব্যাংকে আসতে হয় কিংবা সাতশত বা পাঁচশত টাকার চেক দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা উঠাতে হয়।

মাঝে মাঝে এহেন কর্মকান্ড দেখে মনে হয় বাঙালী খুবই আত্মবিশ্বাস প্রবণ যাদেরকে অন্য কোন প্রজাতি ধাওয়া করার সাহস রাখে না! আমার মাথা সায় দিচ্ছে না। সকল পরিবেশ বিবেচনায় সকালবেলা থেকেই ব্যাংকের কাজেও তেমন একটা মন বসছে না। তাই, পত্রিকাটি হাতে নিয়ে অগোছালো মনটাকে সামলাতে চেষ্টা করি।

ছোট বেলা থেকেই পত্রিকা পড়ার অভ্যাস বলে টেলিভিশন তেমন কাছে টেনে নিতো না। কিন্তু ইদানীংকালে টেলিভিশনের খবরটা কিংবা মোবাইলের আপডেট তথ্য বারবার দেখার তাগিদ অনুভব করি।

পত্রিকা হাতে নিয়ে প্রিয় চশমাটা চোখে পড়তেই মনটা সায় দিচ্ছে না। প্রিয়জনের কত প্রিয় মুহূর্তগুলি এই পত্রিকায় সংযোজিত হতো। প্রেম ভালবাসার কতকথা পত্রিকার ওপিঠে ভেসে আসতো। বসন্তের বাতাবরণে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে শিমুল ফুলদল জড়ো হয়ে থাকতো কিংবা পলাশের ডালে ডালে ফাগুনের হাওয়া বয়ে যেত।

অফিস শেষে বাসায় ফিরি। আবারও কপালে চিন্তার ভাঁজ নেমে আসে। রুমে গিয়ে দেখি প্রয়োজনে অনেক কিছু ফুরিয়ে গেছে। তাই আবার বাইরে যেতেই হবে। বের হলাম মুদির দোকানের উদ্দেশ্যে, রাস্তায় তো মানুষের আনাগোনার কমতি নেই। মাছের বাজারে মাস্ক পরে কিছু চিংড়ী মাছ নিয়ে আসলাম। প্রতিদিনের অভ্যাসবশত বাহির থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত-পা ভাল করে ধুঁয়ে কাপড় চোপড় ধৌত করি।

যাই হোক, রান্না করার প্রস্তুতি। মোবাইলটা বেজেই চলল। ইদানীং মোবাইল ফোন রিসিভ করতে অনেকটা আতঙ্কের মাঝে সময় পার করি। ফোনের শব্দটা পেলেই আঁৎকে উঠি! রাতের বেলা কোথাও কোন বিষণ্ন শব্দের আঘাতে যেমন মনের মাঝে ভয় ধরিয়ে দেয় মোবাইলটা বাজলেও তেমনি হয়ে আসে।

হঠাৎ, ওপাশ থেকে সদা হাস্যজ্জ্বল বন্ধু মহীম অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে বললো, পরিবহন বন্ধ, বাড়ি আসবি কোনদিন? অথচ সে জানে না ব্যাংক আমাকে ছাড় দেয় না। ব্যাংকের কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারীদের নিয়ে কেউ এতটুকু চিন্তায় রেশ টানে না। না হলে এতজন ব্যাংকার ভাইরাসে আক্রান্ত তারপরও কোন সান্ত্বনা দেবার কেউ নেই। তারপর অত্যন্ত সহিষ্ণু কন্ঠে বললো, সেবার যেহেতু আসতে পারিসনি, তবে পয়লা বৈশাখের সময় চলে আসবি। কত সুন্দর করে মনটাকে সাজিয়ে রাখে সহজ সরলতার সান্নিধ্যে। তার কাছে হয়তো স্থবিরতা কিংবা নিস্তব্ধতার আওয়াজটুকু এখনো পৌছায়নি। দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে ফোনটুকু রেখে দিয়ে…

বিকেল চারটা ছুঁইছুই অবস্থা। ভাবলাম, থাকনা, অগোছালো রান্নাটা না হয় রাতের জন্যেই রেখে দিই।এভাবেই হয়তো প্রতিটা দিন ভাতের বদলে মুড়ি খেয়ে সময়টুকু পার করে দিই।

সন্ধ্যা সাতটা। রান্নার জন্য প্রস্তুতি, লবণ দানিতে এতটুকু লবণও নেই। উপায়ন্তর না দেখে আবারো বাইরে বের হই, কি আশ্চর্য, সব মুদির দোকান বন্ধ! বেচারা এক আগন্তককে জিজ্ঞাসা করতেই তেলে বেগুনে রেগে উঠে বলে উঠল, আপনি জানেন না পাঁচটার পর সব দোকান বন্ধ। উনার কথায় মনে হলো, কোন মন্দিরের ভেতরে জুতো নিয়ে প্রবেশ করলে যে পাপ হয় আমি সে পাপাটুকুই করে ফেললাম! হয়তো জানে না, আমি ইদানং খবর পড়তে ভালোবাসি না। কারণ, সংবাদপত্রে ভাইরাসজনিত খারাপ খবরের সংখ্যাই বেশি থাকে।

যাই হোক, খালি হাতে বাসায় ফিরি। আঞ্চলিকতার উৎকর্ষে পারদর্শী বলে সেদিন চিংড়ী মাছ আর লতা রান্না করে খেয়েছিলাম। তরকারীর আবরণটা দেখলে হয়তো আঁচ করতে পারা যায় স্বাদের পরিতৃপ্তির ঘাটতি শুধু লবণেই নয়,সবদিক দিয়ে অপূর্ণতা থেকেই যায়! ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টাকে সংবরন না করার নিমিত্তেই রসালো রান্না বলে চালিয়ে দিয়েছি।

ক্ষণিকের তরে আবারো ভাবি, হয়তো আমাদের ব্যাংকও বন্ধ হবে। তবেই বাড়িতে গমণ করতে পারবো। চোখ দুটিতে ঘুমের কোন আভাস না থাকায় বিছানায় ঘুমাতে যাওয়া যে বৃথা চেষ্টা তা-ই বার বার মনে হচ্ছে। আবারও মোবাইল বেজে উঠল। চিরচেনা কন্ঠে বৃদ্ধ মার কন্ঠে শুনতে পাই ‘কখন ছুটি পাবি’। এদিকে আদরের ছোট খোকাটি অভিমান করে বসে আছে। অতি অভিমানে ফোনে কথা বলতে চাইছে না। ধৈর্য্যের তর সইতে না পেরে বললাম কয়েকদিনের মাঝে চলে আসব। ফোনটা রেখে দিয়ে বুকটা ধরফর করতে লাগলো। আবারও অনুভব করি নি:সঙ্গতার আওয়াজ।

তাই; হয়তো ভাবি, ফেইসবুকে সকল ব্যাংকাররা যেভাবে নিজের ব্যাংককে বন্ধ রাখার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে, হয়তো শীঘ্রই কিছু দিনের জন্য হলেও বন্ধ হবে ব্যাংকারদের স্বার্থে নয়, সমাজের স্বার্থে। তখন হয়তো বাড়ী যাওয়া যাবে। পরক্ষণেই ভাবি, গণপরিবহণ বন্ধ থাকলে যাওয়া কি আর হয়ে উঠবে। আবার ভাবি, থাকনা কয়টা দিন! তারপরও যদি পৃথিবী স্বাভাবিকতায় সচল হয়ে আসে।

হয়তো অনেকে সুস্থ হয়ে উঠবে। পৃথিবী আবার আগের গতিতে শাণিত হবে। অনেক ব্যাংকারের প্রাণ যাবে। ইতোমধ্যে কয়েকজন আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।

আবার নিরাশ হয়ে ভাবি, হয়তো ব্যাংকারদের মাধ্যমে সমাজে সংক্রমণ ছড়ায় না। তাই হয়তো ব্যাংক বন্ধ করার ঘোষণাই আসবে না। এ আমার সরল বিশ্বাস, হয়তো আবার এক কিশোর যুগল হাত ধরাধরি করে প্রেম করবে। জানালার ওপাশে নারিকেল গাছটার ঝিরঝিরি বাতাসও বইবে। শুধু আমার মত ব্যাংকারদের আর্তনাদে কেউ সাড়া দেবে না…!

অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক। প্রিন্সিপাল অফিসার, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, বন্দর বাজার শাখা, সিলেট। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button