ইসলামী ব্যাংকিং

সুকুক: বিনিয়োগ এবং অর্থায়নের বিকল্প উৎস

ড. মো. বখতিয়ার হাসানঃ ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার সময় আর্থিক বাজারগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং এ সময় প্রায় সব প্রচলিত আর্থিক সম্পদের ওপর অভূতপূর্ব নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। এ সময় স্বর্ণ ও বিদেশী মুদ্রার (সুইস ফ্র্যাঙ্ক এবং ডলার) মতো বৈচিত্র্যময় এবং নিরাপদ গতানুগতিক সম্পদ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে তারা আর্থিক সংকটের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এসব সম্পদের বিকল্প কিছু খোঁজ করছিল।

যেহেতু ইসলামিক আর্থিক সম্পদগুলো শরিয়াহ আইন দ্বারা পরিচালিত হয় এবং কিছুটা রক্ষণশীল প্রকৃতির, তাই এটি ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার সময় গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে প্রচুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। যে কারণে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামিক ফিন্যান্স খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যা তাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি (প্রায় ১৪%) দেখলেই বোঝা যায়। ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী ইসলামিক আর্থিক সম্পদ ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসলামিক ফিন্যান্সের এমন প্রবৃদ্ধি শুধু মুসলিম দেশেই নয়, অমুসলিম দেশেও হচ্ছে। এমনকি গত বছরও সুকুকের অভাবনীয় সাফল্যের কারণে ইসলামিক ফিন্যান্স ১১.৪ শতঅংশ বেড়েছে, যা অবাক করার মতো।

আমি সম্প্রতি ইসলামিক ফিন্যান্স নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা করেছি এবং এর ফলাফলগুলো ইঙ্গিত দেয় যে ইসলামী বাজারগুলো, বিশেষত সঙ্কটের সময়, প্রচলিত বাজারগুলোর তুলনায় তুলনামূলকভাবে ভালো পারফরম্যান্স করেছে। সুতরাং ইসলামিক আর্থিক সম্পদগুলোর যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা প্রত্যাশিত। প্রচলিত আর্থিক বাজারে মুসলিম বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করার আগ্রহ থাকলেও, তারা তা করতে পারেনি। কারণ, শরিয়াহ্ আইন অনুযায়ী সুদ, জুয়া, ও ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

এ সমস্যাগুলোর বড় সমাধান হিসেবে সুকুক বা ইসলামিক বন্ড আবির্ভূত হয়। চুক্তি এবং অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে সুকুক ও প্রচলিত বন্ডের মধ্যে পার্থক্য আছে। ইসলামিক শরিয়াহভিত্তিক বন্ড সাধারণত ‘সুকুক’ নামে পরিচিত। সুকুক একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে সিলমোহর লাগিয়ে কাউকে অধিকার ও দায়িত্ব দেওয়ার আইনি দলিল। প্রচলিত বন্ডে ইস্যুকারীর ঋণের দায়বদ্ধতার উপস্থাপন করে, অপরপক্ষে সুকুক কোন সম্পত্তির মালিকানা নির্দেশ করে। সাধারণত সুকুকধারীরা সম্পদের মালিকানা লাভ করেন এবং মুনাফা পান। সুকুক ইস্যুকারী চুক্তি অনুসারে মেয়াদ শেষে ফেস ভ্যালুতে বন্ড কিনতে বাধ্য থাকে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

সুকুক ছাড়ার দিক থেকে বর্তমানে মালয়েশিয়া বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। এছাড়া বাহরাইন, কাতার, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সুকুক ব্যাপকভাবে প্রচলিত। মুসলিম দেশের পাশাপাশি অমুসলিম দেশেও এখন সুকুক চালু আছে। সুকুকের মধ্যে নৈতিক উপকরণও আছে, কারণ শূয়োরের মাংস, অ্যালকোহল, জুয়া, পর্নোগ্রাফি এবং তামাকের মতো কার্যকলাপের সাথে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সুতরাং এটি মুসলিম এবং অমুসলিম উভয় বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয়।

সুকুকের আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে, যা অমুসলিম বিনিয়োগকারীদের কাছে এটিকে জনপ্রিয় করে তুলতে সাহায্য করেছে-
প্রথমত, এটি প্রচলিত বন্ডের চেয়ে বিশেষত সংকটকালীন সময়ে, বেশি মুনাফা দেয়। পূর্ববর্তী গবেষণার মতো, আমার সাম্প্রতিক গবেষণায়ও এটি প্রমাণিত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সাধারণত এটি ধরে নেওয়া হয় যে, উচ্চ মুনাফাজনিত সম্পদের উচ্চ ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে, তবে সুকুক আশ্চর্যজনকভাবে প্রচলিত বন্ডের চেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্বাভাবিক ও সংকটকালীন উভয় সময়ে সুকুক প্রচলিত বন্ডের তুলনায় বেশি ঝুঁকি সমন্বিত মুনাফা অর্জন করেছে।

তৃতীয়ত, সুকুকে বৈচিত্র্যমূলক সুবিধাও আছে। কারণ, এটি প্রচলিত বন্ড থেকে আলাদা এবং এর মূল্য প্রচলিত বন্ডের বিপরীত দিকে উঠানামা করে। বিনিয়োগকারীরা এটিকে তাদের পোর্টফোলিওগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করলে বৈচিত্র্যায়ন সুবিধা পেতে পারে, কারণ আর্থিক মন্দার সময় প্রচলিত বন্ডের মূল্য কমে গেলে সুকুকের মূল্যবৃদ্ধি পায়, ফলে আর্থিক ক্ষতি এড়ানো যায়। ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে সুকুক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

বিগত দুই দশকে আমরা বেশ কয়েকটি আর্থিক সংকট দেখেছি, যেমন- ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকট, ১৯৯৮ সালের আর্জেন্টাইনীয় সংকট, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা, ২০১০ ইউরোপীয় সার্বভৌম ঋণ সংকট এবং বর্তমানে করোনাভাইরাস সংকট। এ সংকটগুলো আর্থিক বাজারগুলোতে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল, যার দরুন বিনিয়োগকারীরা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বাজারে বিনিয়োগকারীরা সর্বদা এমন সম্পদ খোঁজেন, যা উপরের সংকটগুলো দ্বারা কম প্রভাবিত হয়। পূর্ববর্তী গবেষণার পাশাপাশি আমার সাম্প্রতিক গবেষণায়ও দেখা যায় যে মন্দার সময়কালে আর্থিক ঝুঁকি দ্বারা সুকুক প্রচলিত বন্ডের তুলনায় কম প্রভাবিত হয়েছে। সুতরাং বিশেষত অমুসলিম বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে, সুকুককে একটি নতুন নিরাপদ বিনিয়োগের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

যাই হোক, নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ৮০ বিলিয়ন টাকার সুকুক বাংলাদেশে প্রথম ইস্যু করা হয়। দীর্ঘ জল্পনা কল্পনা শেষে অবশেষে এটি বাংলাদেশে চালু হয়। যদিও এটি প্রাথমিকভাবে সরকার ইস্যু করেছে, প্রাইভেট সংস্থাও এটির সুবিধা নিতে পারে। সুকুক ইস্যুর মাধ্যমে বাংলাদেশ মূলত দুভাবে উপকৃত হতে পারে-

প্রথমত, বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি অনেকগুলো মেগা অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার জন্য বিপুল পরিমাণ তহবিলের প্রয়োজন। এছাড়া বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প সরকারের পাইপলাইনে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান এসব মেগা প্রকল্পের অর্থায়ন করা সরকারের পক্ষে একা সম্ভব নয় বা প্রচলিত বন্ডের মাধ্যমেও সম্ভব নয়। এছাড়া সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে বর্তমানে দেশে শরিয়াহভিত্তিক কোনো উপকরণও নেই। ফলে বাংলাদেশের এই জাতীয় অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর অর্থায়নে সুকুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। আবার ঘাটতি অর্থায়ন সুকুকের মাধ্যমে করা হলে সরকারের ঋণের বোঝাও হ্রাস পাবে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার উচ্চ অস্থিরতা, স্বল্প তরলতা এবং কম স্থিতিস্থাপকতার মতো অনেক সমস্যায় জর্জরিত। ফলে বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সুকুক এই ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে, কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে সুকুক আর্থিক বাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য বৈচিত্র্যমূলক সুবিধা প্রদান করতে পারে। এছাড়াও এটি মন্দার সময় প্রচলিত বাজারে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

এগুলো ছাড়াও সুকুক বাংলাদেশের ব্যাংকখাতের বোঝা কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বেসরকারি খাত তাদের বড় প্রকল্পগুলোর অর্থায়নের জন্য ব্যাংকখাতের ওপর অত্যধিকভাবে নির্ভর করে, যা সুকুক ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব।

বাংলাদেশে ইসলামিক অর্থায়নের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ইসলামী ব্যাংকিং ব্যতীত অন্য কোনো ইসলামিক আর্থিক পণ্য বিকাশ করতে পারেনি। যদিও ২০১৪ সালে ঢাকা স্টক একচেঞ্জে ইসলামিক সূচক চালু হয়েছিল, তবে উপযুক্ত প্রচারের অভাবে এটি খুব বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। সুতরাং আমাদের দেশে সুকুককে আকর্ষণীয় করার জন্য, এর সুবিধাগুলো বিনিয়োগকারীদের জানাতে হবে। পরিশেষে আমরা আশা করি যে সুকুক অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন ও বিনিয়োগের কার্যকর বিকল্প উৎস হিসেবে পরিণত হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যথাযথ ভূমিকা রাখবে।

লেখকঃ ড. মো. বখতিয়ার হাসান, সভাপতি, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button