ব্যাংক গ্রাহক

ব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহকের ভোগান্তি ও বিবেচ্য বিষয়

প্রচলিত আইনি কাঠামোর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকও গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নে এবং গ্রাহকদের অর্থের নিরাপত্তার স্বার্থে সময়ে সময়ে তফসিলি ব্যাংকগুলোর জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা ও বিধিবিধান জারি করে। এসব বিধিবিধান সংসদে পাস হওয়া আইনের সমতুল্য না হলেও তফসিলি ব্যাংকের ব্যাংকারদের কাছে তা ফরজে আইন (অবশ্য পালনীয়)। এসব নির্দেশনার অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ ব্যাংক চেক জালিয়াতি, নকল স্বাক্ষর, এমআইসিআর লাইন বিকৃতি ইত্যাদি সম্ভাব্য যে কোনো ধরনের জালিয়াতি প্রতিরোধে সব ব্যক্তি হিসাবের পাঁচ লাখ বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ টাকার ক্লিয়ারিং চেক এবং সব করপোরেট-এসএমই-ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের হিসাবের এক লাখ বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ টাকার ক্লিয়ারিং চেক স্বয়ংক্রিয় নিকাশঘর- Bangladesh Automated Clearing House (BACH)-এর মাধ্যমে নিষ্পত্তিকরণে বা অনার করার জন্য ‘পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন’ বা ‘গ্রাহক সম্মতিপত্র’ আবশ্যিকভাবে গ্রহণ এবং এ সংক্রান্ত রের্কড সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক করেছে।

‘পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন’ হলো চেকটির বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখপূর্বক চেকটি অনার করার জন্য গ্রাহকের সম্মতি-অনুমোদন। গ্রাহক যদি ‘পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন’ না দিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে পরিশোধকারী ব্যাংক Advice Not Received’ কারণ দেখিয়ে চেকটি ফেরত দিতে পারে। এই নির্দেশনার পরিপালন গ্রাহকের হিসাবের আর্থিক নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি ব্যাংকারকেও অনিচ্ছাকৃত জাল-জালিয়াতি হতে সুরক্ষা দেয়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনা শুধু ক্লিয়ারিং চেকের জন্য। বর্তমানে কোনো কোনো ব্যাংকে অতিরিক্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যে কোনো চেকের-নির্ধারিত অঙ্কের চেকের ওভার দ্য কাউন্টার পেমেন্ট (ক্যাশ পেমেন্ট) দেওয়ার ক্ষেত্রেও সংশ্নিষ্ট গ্রাহকের কাছ থেকে সম্মতি নিয়ে তারপর পেমেন্ট দিতে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বলতে গেলে, এই নির্দেশনা দ্য নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইন, ১৮৮১-এরও বাহুল্য। কারণ এই আইন অনুসারে, চেক হচ্ছে প্রাপককে-বাহককে চেকে উল্লিখিত টাকা পরিশোধের জন্য ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের নির্দেশনা তথা গ্রাহকের সম্মতি। তাই চেক দেওয়ার পরও আবার ‘পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন’ নেওয়া গ্রাহকের পেমেন্ট প্রক্রিয়াকে দীর্ঘ এবং ঝামেলাপূর্ণ করে, যা পরিপালন করা ব্যাংকারদের পক্ষেও দুস্কর। কারণ গ্রাহকরা এই পদ্ধতিকে বাড়াবাড়ি এবং হয়রানি মনে করে।

তাছাড়া ‘পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন’ বিষয়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় কিছু বিষয় স্পষ্ট করা হয়নি, যেমন-
১. কী কী উপায়ে ‘পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন’ নেওয়া হবে;
২. এই নির্দেশনা কি গ্রাহক স্বপ্রণোদিত হয়ে দেবেন, নাকি ব্যাংকার নিজেও গ্রাহকের কাছ থেকে তা নিতে পারবেন;
৩. আন্তঃশাখা লেনদেনের ক্ষেত্রে পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন গ্রাহক কার কাছে জমা করবেন;
৪. পেয়িং শাখার দায়িত্ব আছে কিনা- এসব বিষয় নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে কুমিল্লা শাখার (প্রকৃত শাখার নামটি ব্যবহার করা হয়নি) একটি চেক বনানী শাখায় (প্রকৃত শাখার নামটি ব্যবহার করা হয়নি) প্রেজেন্ট করা হলে, বনানী শাখা পেমেন্ট দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বাহককে বলল, কুমিল্লা শাখা থেকে ‘পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন’ মেইল করতে হবে অথবা কুমিল্লা শাখার ম্যানেজার ই-মেইলে রিকোয়েস্ট পাঠালেই তারা চেকটির পেমেন্ট দেবে।’

ইস্টার্ন ব্যাংক ও এইচএসবিসি ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে আমরা জানতে পারি, একজন গ্রাহক তিনভাবে ‘পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন’ দিতে পারেন-
১. ব্যাংকে গ্রাহকের রেকর্ডেড মোবাইল নাম্বার থেকে ব্যাংকের কন্ট্যাক্ট সেন্টারে বা শাখার (গ্রাহকের হিসাবটি যে শাখায়) নাম্বারে ফোন করে;
২. ইন্টারনেট ব্যাংকিং অপশনে গ্রাহকের নিজস্ব টংবৎ User Sign In ID ও Password দিয়ে লগ-ইন করে ই-মেইলের মাধ্যমে;
৩. প্রি-পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন ফরম পূরণ করে সংশ্নিষ্ট শাখায় (গ্রাহকের হিসাব যে শাখায় বা নিকটস্থ শাখায় বা পেয়িং শাখায়) জমা প্রদান করে। অর্থাৎ উপরোক্ত প্রথম উপায়মতে, গ্রাহক পূর্ব থেকে যদি পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন না দিয়ে থাকেন, তাহলে পেয়িং ব্যাংক (আন্তঃশাখা লেনদেনের ক্ষেত্রে পেয়িং শাখা) গ্রাহকের রেকর্ডেড মোবাইল ফোন নাম্বারে ফোন দিয়ে গ্রাহকের সম্মতি নিয়েও চেকের পেমেন্ট দিতে পারবেন।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

কিন্তু আন্তঃশাখা পেমেন্টের ক্ষেত্রে অনেক পেয়িং শাখা হিসাবধারীর শাখা থেকে লিখিত পে ইনস্ট্রাকশন চায়, যা পেমেন্ট প্রক্রিয়াটিকে অতিদীর্ঘ করে ফেলে, যা চেকের ড্রয়ার (চেকদাতা) এবং প্রাপক-বাহক উভয়কেই রাগিয়ে তোলে। এখানে যে শাখা চেকটির পেমেন্ট দিচ্ছে তাকে যেমন ‘পজিটিভ পে ইনস্ট্রাকশন’ পেয়ে চেকটির পেমেন্ট দিতে হবে, ঠিক তেমনি চেকটির উপযুক্ততা যাচাই করে চেকটির পেমেন্ট দিতে হবে। তাই এ ক্ষেত্রে হিসাবধারীর শাখা যদি হিসাবধারীর কাছ থেকে লিখিত কোনো পে ইনস্ট্রাকশন পেয়ে থাকে, তবেই কেবল সে পেয়িং শাখাকে অনুরোধ করতে পারে অথবা গ্রাহকের পূরণকৃত পে ইনস্ট্রাকশনটি স্ক্যান করে পেয়িং শাখায় ফরোয়ার্ড করতে পারে। তাছাড়া চেকটির গুণগত ত্রুটিও (যেমন স্বাক্ষর গরমিল, জাল চেক) থাকতে পারে, যা নিশ্চিত হওয়া পেয়িং শাখার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। হিসাবধারীর শাখা হিসাবধারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়ে ই-মেইল বা লিখিত আকারে পেয়িং শাখাকে নিশ্চিত করাটা কালক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই নয়।

আর সার্কুলারে স্পষ্ট নির্দেশনার অভাবেই এমনটা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর উচিত, বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কোনো নির্দেশনা বা সার্কুলার কপি পেস্ট না করে অস্পষ্ট বিষয়গুলো একটু ব্যাখ্যা করে নিজস্ব সার্কুলার জারি করা। অভিজ্ঞ ব্যাংকাররা কিংবা প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র ব্যাংকাররা হয়তো সহজেই বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনা বুঝতে পারেন; কিন্তু শাখা পর্যায়ের অনেক সাধারণ বা নবীন ব্যাংকারদের পক্ষে হয়তো তা অতটা বোধগম্য হয় না, গ্রাহকদের জন্য তো বটেই। তাই ক্লিয়ারিং চেক পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর উচিত, অভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা, গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো এবং স্পষ্ট ও সহজবোধ্য ভাষায় সার্কুলার এবং গ্রাহক নির্দেশিকা তৈরি করা।

ঠিক একইভাবে মানি লন্ডারিং, হুন্ডি এবং সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে ব্যাংক হিসাবে টিপির বাধ্যবাধকতার কারণেও গ্রাহকদের ভুগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। টিপি হচ্ছে গ্রাহক কর্তৃক ঘোষিত লেনদেনের অনুমিত মাত্রা। হিসাব খোলার সময় টিপিতে গ্রাহকের মাসিক সম্ভাব্য লেনদেনের একটি ঘোষণা নেওয়া হয়। যেসব ব্যাংক সিবিএস (কোর ব্যাংকিং সিস্টেম) ব্যবহার করছে, তাদের ব্যাংকিং সফটওয়্যারে স্বয়ংক্রিয় প্রোগ্রাম দিয়ে রাখার কারণে গ্রাহকের কোনো লেনদেন ঘোষিত টিপির সীমা লঙ্ঘন করলেই কম্পিউটার ওই লেনদেনটি অ্যালাউ করে না। ফলে চেকের ড্রয়ার এবং প্রাপক-বাহক দু’জনকেই পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। উল্লেখ্য, যদি গ্রাহকের লেনদেন বৃদ্ধির কারণে টিপির অনুমিত সীমা লঙ্ঘিত হয় কিংবা লেনদেনের ধরনে কোনো পরিবর্তন আসে, তাহলে গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে টিপির সীমা-ধরন বাড়িয়ে-বদলে নেওয়া যায়। কিন্তু ৫-৭ বছর আগে, যখন টিপি কম্পিউটারাইজড ছিল না (শুধু হিসাবের ফরমে উল্লেখ থাকত), খোলা হিসাবের টিপিতে লেনদেনের কী ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তা গ্রাহকের পক্ষে মনে রাখাটাও দুস্কর। ফলে বর্তমানে টিপি কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে অনেক গ্রাহককেই ভুগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। আন্তঃশাখা লেনদেনে টিপির ভুগান্তি যেমন রয়েছে, তেমনি গ্রাহক তার নিজের শাখাতেই টিপির বিড়ম্বনা পোহান। বিজ্ঞ ব্যাংকাররা গ্রাহক দুর্ভোগ লাঘবে এসব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করবেন, প্রত্যাশা করছি।

লেখকঃ মোশারফ হোসেন, ব্যাংক কর্মকর্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button