বিনিয়োগ ও লোন

সাব প্রাইম মর্টগেজ ক্রাইসিস

ব্যাংকিং জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করা এবং সুনামি হয়ে আসা একটা ইভেন্ট “সাব প্রাইম মর্টগেজ ক্রাইসিস”| আমরা সকলেই কম বেশী এই সম্পর্কের অবগত| আমরা যারা অপেক্ষাকৃত নবীন তারা এটা সম্পর্কে অবগত হলেও এর পিছনের কারন ও প্রভাব সম্পর্কে হয়তো ততোটা পরিস্কার নই|

সাব প্রাইম মর্টগেজ আসলে কী?
সোজা কথায়, ব্যাংক বা ফিন্যান্সিয়াল ইনিসটিটিউশন বরোয়ার সিলেকশনের সময় কোন কম্প্রোমাইজ ব্যতীত হাই ক্রেডিট রেটিং এবং ফিন্যান্সিয়াল এবিলিটি সম্পন্ন বরোয়ারদের যখন লোন দেয়, তখন তাদের বলা হয় প্রাইম বরোয়ার| আর এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে লোয়ার ক্রেডিট রেটিং বা রিপেমেন্ট এবিলিটি সম্পন্ন বরোয়ারদের যখন লোন দেয় তখন তারা হয়ে যায় সাব প্রাইম বরোয়ার|

ইউএস ব্যাংকিং সিস্টেমে মর্টগেজ লোন বা হোম লোন প্রডাক্টটি একসময় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে| এই লোন প্রথম দিকে শুধু ভাল ক্রেডিট রেটিং সম্পন্ন লোকজনকেই দেয়া হতো| এরা ছিলেন প্রাইম বরোয়ার এবং তাদেরকে দেয়া লোনগুলো ছিল প্রাইম মর্টগেজ| ৯/১১ পরবর্তী সময়ে ইউএস ইকোনমিকে মজবুত রাখার লক্ষ্যে ফেডারেল রিজার্ভ টি-বিল এর বিপরীতে প্রদত্ত সুদের হার কমিয়ে ১% এ নামিয়ে আনে|

সে সময়ে ইকোনমিক স্লো ডাউনের কারনে ইউএস ব্যাংকিং সিস্টেমে প্রচুর অলস অর্থ জমা হতে থাকে| একদিকে কমার্শিয়াল ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এবং মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর কাছে অলস অর্থ যোগানের পরিমান বাড়তে থাকে, অন্যদিকে টি-বিলে বিনিয়োগ থেকে আয় কমে যায়|

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এমতাবস্থায়, অলস অর্থ বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন বাড়াতে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলো উপায় খুঁজতে থাকে| ফলাফল স্বরূপ প্রাইম মর্টগেজ থেকে সরে এসে ব্যাংকগুলো ‘সাব প্রাইম’ অর্থাৎ লো রিপেমেন্ট এবিলিটি সম্পন্ন লোকজনকে হোম লোন দেয়া শুরু করে|

এক্ষেত্রে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলোর ধারনা ছিল ইউএস মার্কেটে প্রপার্টির দাম কখনো পড়বে না| সাব প্রাইম বরোয়াররা যদি লোনের কিস্তি প্রদানে ব্যর্থ হন সেক্ষেত্রে প্রপার্টি অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দিয়ে তারা ইনভেস্টরদের দেনা পরিশোধ করতে পারবেন|

এই লোন বিতরন প্রক্রিয়ায় ক্ল্যায়েন্ট ছাড়া মূলত আরো চারটি পক্ষ ইনভলভড ছিল-
১) প্রপার্টি ব্রোকার
২) ল্যান্ডিং ব্যাংক
৩) ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ও
৪) মিউচুয়াল ফান্ড/পেনসন ফান্ড/ইনসুরেন্স কোম্পানি/আদার ইনভেস্টর|

প্রক্রিয়াটা ছিল অনেকটা এরকম
প্রপার্টি ব্রোকার ক্ল্যায়েন্ট যোগাড় করে ল্যান্ডিং ব্যাংকের কাছে দিবে| ল্যান্ডিং ব্যাংক এর সাথে মুনাফা এ্যাড করে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে দিবে| ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এরপর প্রপার্টি ডকুমেন্টসহ লোনটি কিনে নিয়ে একটা পোর্টফলিও বক্স তৈরি করবেন| তারপর বক্সটি তিনটি রিক্স ক্যাটাগরিতে (সেইফ, ওকে, রিস্কি) ভাগ বা স্লাইস করে ৩% থেকে ১০% রিটার্ন এ মিউচুয়াল ফান্ড/পেনসন ফান্ড/ইনসুরেন্স কোম্পানি সহ অনান্য ইনভেস্টরদের কাছে বিক্রি করবে| যে যার রিক্স এ্যাপেটাইট অনুযায়ী স্লাইস গুলোতে বিনিয়োগ করবে|

এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংক এবং ইনভেষ্টররা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামাতে থাকে| সবাই মজা পেয়ে যান, এমতাবস্থায় বাড়ী কেনার মনো বাসনা সম্বলিত সবাইকে ধরে এনে লোন দেয়া শুরু হয়| উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রহিতা যখন লোনের কিস্তি প্রদানে ব্যর্থ হন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলো প্রপার্টি সেলের উদ্যোগ নেন| ফলশ্রুতিতে প্রপার্টি মার্কেটে দামের ধস নামে|

অন্যদিকে, প্রাইম বরোয়ার যারা নিয়মিত কিস্তি দিয়ে যাচ্ছিলেন তারা দেখতে পেলেন, যে বাড়ী তারা ৩ লক্ষ ডলারে কিনেছিলেন সেটা মাত্র ৯০ হাজার ডলারে পাওয়া যাচ্ছে| যে পরিমান ঋৃনের অর্থ তাদের এখনো পরিশোধ বাকী তার চেয়ে অনেক কম অর্থে একই রকম বাড়ি তারা ইচ্ছে করলে কিনতে পারছেন| তাই তারাও কিস্তি দেয়া বন্ধ করে প্রপার্টি সারেন্ডার করা শুরু করলেন| ফলাফল, লেম্যান ব্রাদার্স এর মত ওয়ার্ল্ডের ফোর্থ লার্জেস্ট ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়া|

বাংলাদেশ ইকোনমিতে এখন যে পরিমাণ ব্যাংকের উপস্থিতি এবং যে পরিমান অলস অর্থ ব্যাংকগুলোতে জমা হচ্ছে তাতে প্রাইম বরোয়ারদের অর্থ প্রদানের সুযোগ নাই বললেই চলে, এখন যাদের ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে তাদের সিংহভাগই সাব প্রাইম বরোয়ার| ফলাফল, এনপিএল আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাওয়া এবং মর্টগেজ প্রপার্টির দাম অবিশ্বাস্য হারে কমে যাওয়া| সামনের দিনগুলোতে এই অবস্থার উন্নতির সুযোগ কম বরং আরো অবনতি হবার সকল উপাদান বিদ্যমান|

তাই আমরা যারা এই সময় বি.এম বা আর.এমের দায়িত্বে আছি তাদের সামনের দিন গুলো আরো কণ্টকাকীর্ণ এতে সন্দেহ নাই| যতোটা সাবধানে পা ফেলে রেসে টিকে থাকা যায় আমাদের সেই চেষ্টাই করতে হবে| জানি, বলাটা যত সোজা করাটা ততোটাই কঠিন| টার্গেট এর অসহনীয় বোঝা মাথায় নিয়ে অতি সাবধানী হবার লাক্সারি আমাদের কতটুকু আছে? সেটাও ভাববার বিষয়|

সৌজন্যেঃ আশরাফুল আমিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button