ব্যাংক গ্রাহক

মৃত আমানতকারীর ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার মালিকানা জটিলতার সমাধান

মোশারফ হোসেনঃ একটি প্রচলিত ভুল ধারণা আছে, আমানতকারী মৃত্যুবরণ করলে ব্যাংকে/ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রেখে যাওয়া তার আমানতের মালিক হবেন তার ওয়ারিশরা। কিন্তু এ বিষয়ে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক বারংবার নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৮ পর্যন্ত সংশোধিত)’-এর আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল বিআরপিডি সার্কুলার নং-০৬ এবং ২০১৭ সালের ১২ জুন ডিএফআইএম সার্কুলার নং-০২-এর মাধ্যমে আবার বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, আমানতকারীর মৃত্যুর পর তাদের মনোনীত নমিনি বা নমিনিদেরই আমানতের অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

এ বিষয়ে ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৮ পর্যন্ত সংশোধিত)’-এর ১০৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ব্যাংক কোম্পানির কাছে রক্ষিত কোনো আমানত যদি একক ব্যক্তি বা যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির নামে জমা থাকে, তাহলে উক্ত একক আমানতকারী এককভাবে, বা ক্ষেত্রমতো যৌথ আমানতকারীগণ যৌথভাবে নির্ধারিত পদ্ধতিতে এমন একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে মনোনীত করতে পারবেন, যাকে বা যাদেরকে একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর আমানতের অর্থ দেয়া যেতে পারে।’

তাহলে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন মতে, এটা স্পষ্ট যে, আমানতকারীর মৃত্যুর পর নমিনিই হবেন মৃত আমানতকারীর ব্যাংকে থাকা আমানতের মালিক।

মৃত আমানতকারীর আমানতের মালিক নমিনি- এ বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিষ্কার হলেও নমিনির কাছ থেকে যাচিত কাগজপত্রের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বা ব্যাংক কোম্পানি আইনে নির্দিষ্ট না থাকার কারণে, অথবা কাগজপত্রের চাহিদায় ব্যাংকারের বাড়াবাড়ি কিংবা ধারণাগত অস্পষ্টতার কারণে এবং সর্বোপরি কোনো কোনো ব্যাংকারের অসহযোগিতার কারণেও ভোগান্তিতে পড়েন মৃতের নমিনি বা স্বজনরা।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

কারণ অধিকাংশ ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার কপি-পেস্ট করে নিজেরা সার্কুলার করেছে। অর্থাৎ তারাও কাগজপত্রের তালিকা নির্দিষ্ট করেনি। ফলে তাদের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ কাগজপত্রের তালিকা সম্পর্কে শতভাগ শিয়োর নন। ফলে ব্যাংকগুলো তাদের নিজেদের মতো করেই কাগজপত্র আদায় করে। তবে কেউ কেউ অপ্রয়োজনীয়ভাবে আদালতের সাকসেশন সার্টিফিকেটও চায়! একইসঙ্গে সাকসেসরদের কাছ থেকে অঙ্গীকার বা অনাপত্তিপত্রও (এনওসি) দাবি করে। অথচ নমিনিকে টাকা প্রদানের ক্ষেত্রে এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যাংকারদের পাশাপাশি আমানতকারী বা তাদের নমিনিরাও দ্বিধায় থাকেন। কারণ বেশিরভাগ ব্যাংকের ওয়েবসাইটেই নেই এ-সংক্রান্ত কোনো গ্রাহক নির্দেশিকা। তাই গ্রাহকরাও জানেন না, আমানতকারীর মৃত্যুর পর কীভাবে তার রেখে যাওয়া আমানত উত্তোলন করতে হবে।

আমি কয়েকটি বড় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সার্কুলার পড়েছি এবং তাদের প্র্যাকটিস সম্পর্কে জানি। আমার নিজের ব্যাংকের ব্যাপারও তো জানি। এ আলোকে নমিনি কীভাবে মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে রেখে যাওয়া টাকা উত্তোলন করবেন এবং নমিনিকে কী কী কাগজপত্র জমা দিতে হবে, তা এ লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করব।

আমানতকারীর মৃত্যুর পর তাদের স্বজনদের প্রথম কাজ হচ্ছে, ব্যাংকে এসে ম্যানেজারের কাছে আমানতকারীর মৃত্যুর খবরটি অবহিত করা। এরপর জানতে হবে, মৃত আমানতকারী হিসাব খোলার সময় বা জীবদ্দশায় পরবর্তীকালে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তিনি কাকে নমিনি করে গেছেন, সেই নমিনির নাম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নমিনির নামটি স্বজনরা আগে থেকেই জানেন, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যদেরই (যেমন স্ত্রী, স্বামী বা সন্তানদেরই) সাধারণত নমিনি করা হয়। কিন্তু নমিনির নাম জানা থাকলেও নমিনি ব্যক্তিটি নিজে বা স্বজনদের কেউ ব্যাংকে গিয়ে বেটার শিয়োর হতে হবে। নমিনির নাম নিশ্চিত হওয়ার পর, নমিনি ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা উত্তোলনের পদ্ধতি ও কাগজপত্রের তালিকা জেনে নেবেন।

নমিনিকে প্রথমত হিসাবধারী গ্রাহকের মারা যাওয়ার সপক্ষের দলিল; দ্বিতীয়ত, নমিনির নিজের মনোনয়ন ও পরিচিতির সপক্ষের কাগজপত্র জমা দিয়ে হিসাবের স্থিতি দাবি করতে হবে। যেমন-

এক. হিসাবধারী গ্রাহকের মৃত্যু, হিসাব নম্বর ও নমিনির নিজের নমিনেশন (মনোনয়ন) উল্লেখপূর্বক অর্থ উত্তোলনের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থাপক বরাবর নমিনির আবেদন।
দুই. স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বা পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর প্রদত্ত আমানতকারীর মৃত্যু সনদপত্র (ডেথ সার্টিফিকেট) [হাসপাতালে বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে সরকারি ডাক্তার বা রেজিস্টার্ড ডাক্তার বা সিভিল সার্জন কর্তৃক প্রদত্ত মৃত্যু সনদপত্রও লাগতে পারে]।
তিন. প্রবাসে মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃক স্বাক্ষরিত মৃত্যু সনদপত্র।

চার. নমিনির জাতীয় পরিচয়পত্র/পাসপোর্ট/জন্মনিবন্ধন সনদ (স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক সত্যায়িত)। জন্মনিবন্ধন সনদ দাখিল করলে সঙ্গে অন্য যেকোনো একটি গ্রহণযোগ্য ছবিযুক্ত আইডিও (যেমন স্কুল/কলেজের রেজিস্ট্রেশন সনদ বা প্রফেশনাল আইডির কপি) জমা দিতে হবে।
পাঁচ. নমিনির পরিচিতির সপক্ষে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিয়মমতে ব্যাংকের দুজন সম্মানিত গ্রাহক অথবা ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তা অথবা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/পৌরসভার মেয়র/সিটি করপোরেশনের কমিশনার প্রদত্ত সনদপত্র।
ছয়. নমিনির নিজ নামের পূর্ণ স্বাক্ষরযুক্ত সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি (স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক সত্যায়িত)।

সাত. ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য দুজন সাক্ষীর (অন্তত একজন ব্যাংক গ্রাহক বা গ্রহণযোগ্য কোনো সম্মানিত ব্যক্তি হবেন, আরেকজন ব্যাংক কর্মকর্তাও হতে পারেন) স্বাক্ষরসহ উপযুক্ত মূল্যের নন-জুডিশিয়াল/অ্যাডহেসিভ স্ট্যাম্পে নমিনি কর্তৃক ইনডেমনিটি বন্ড প্রদান।
আট. মৃত গ্রাহকের হিসাবের অব্যবহৃত চেকবই, ডেবিট কার্ড (সঞ্চয়ী হিসাবের) বা মূল আমানত রসিদ (এফডিআর, ডাবল বেনিফিট স্কিম, মান্থলি ইনকাম স্কিম প্রভৃতি হিসাবের ক্ষেত্রে) ফেরত প্রদান।
নয়. মৃত গ্রাহকের হিসাবে স্থিত অর্থের পরিমাণ ম্যানেজারের বিজনেস ডেলিগেশনের ঊর্ধ্বে হলে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন।

দশ. নমিনিকে অর্থ প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট শাখায়/ব্যাংকে মৃত আমানতকারীর কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঋণ নেই-এ মর্মে ব্যাংকারকে নিশ্চিত হতে হবে। যদি ঋণ থেকে থাকে, তাহলে নমিনিকে টাকা প্রদানের আগে তা সমন্বয় করে নিতে হবে।
এগারো. অধিকতর স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে নমিনির ব্যাংক হিসাব খুলতে হতে পারে। নতুবা মৃত ব্যক্তির হিসাবের স্থিতি নমিনির নামে পে-অর্ডারের মাধ্যমে প্রদান করা যাবে।
বারো. নমিনি কর্তৃক টাকা গ্রহণকালে ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য যেকোনো একজন ব্যক্তির (সাধারণত ব্যাংকের গ্রাহক) উপস্থিতিতে নমিনির শনাক্তকরণ নিশ্চিত করতে হবে।

অনেক ক্ষেত্রে আমানতকারীরা হিসাব খোলার সময় নাবালক কাউকে নমিনি করেন। তবে এসব ক্ষেত্রে নাবালকের পক্ষে স্থিতি গ্রহণের জন্য অন্য আরেকজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নাম দিতে হয়। তাই এসব হিসাবের নমিনি নাবালক থাকাবস্থায় যদি হিসাবধারী গ্রাহক মৃত্যুবরণ করে থাকেন, তাহলে নাবালক নমিনির পক্ষে প্রাপ্তবয়স্ক সেই ব্যক্তিটি অর্থ উত্তোলনের জন্য যোগ্য হবেন।

নাবালক নমিনির পক্ষে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি মনোনীত করা না থাকলে নাবালক নমিনির পক্ষে তার স্বাভাবিক অভিভাবক (বাবা/মা) মৃত ব্যক্তির হিসাবের স্থিতি গ্রহণ করবেন। নাবালক নমিনির বাবা/মা না থাকলে, আইনগত অভিভাবক (লিগ্যাল গার্ডিয়ান) অর্থ উত্তোলনের জন্য যোগ্য হবেন। এভাবে নির্ধারিত স্বাভাবিক/আইনগত অভিভাবককে অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে ‘ন্যাচারাল/লিগ্যাল গার্ডিয়ানশিপ সার্টিফিকেট’ গ্রহণ করতে হবে। এই গার্ডিয়ানশিপ সার্টিফিকেট দুজন কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে নেয়া যেতে পারে-স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা আদালত, অথবা উভয়ের কাছ থেকেই। ব্যাংকের পলিসি/সার্কুলার মতে, যে কর্তৃপক্ষের সার্টিফিকেট প্রযোজ্য হয়, সেখান থেকেই নাবালক নমিনির গার্ডিয়ানশিপ সার্টিফিকেট ম্যানেজ করে দিতে হবে।

আরও দেখুন:
ব্যাংকে রেখে যাওয়া মৃত ব্যক্তির আমানত কে পাবে?
ব্যাংক গ্রাহকের মৃত্যুতে উত্তরাধিকারী ও নমিনী কর্তৃক টাকা উত্তোলনের নিয়ম

উল্লেখ্য, গ্রাহকের মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্তির পরক্ষণেই ব্যাংকারকে মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্তির সময় ও উৎস রেকর্ডকরণসহ মৃত গ্রাহকের হিসাবকে ‘ডিসিজড অ্যাকাউন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত/মার্কড করতে হবে ব্যাংকের সিবিএস ও অ্যাকাউন্ট ফরম-সবখানেই এবং এই হিসাবের কোনো চেক পরিশোধ করা যাবে না, এমনকি উপস্থাপিত চেক গ্রাহকের মৃত্যুর আগে ইস্যুকৃত হলেও। নমিনির লিখিত আবেদন প্রাপ্তির পর তার জমাকৃত কাগজপত্রগুলোর, বিশেষ করে ডেথ সার্টিফিকেটের সত্যতা যাচাই করে এবং প্রয়োজনে আমানতকারীর সর্বশেষ ঠিকানায় সরেজমিনে গিয়ে আমানতকারীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে।

মনে রাখতে হবে, সার্কুলারের বাইরে কাগজপত্র দাবি করাটা বা অপ্রাসঙ্গিক কাগজপত্র চাওয়াটা শুধু হয়রানিই নয়, কিছুটা অপরাধও বটে। কারণ মৃত ব্যক্তির স্বজনরা মৃতের ব্যাংক-ব্যালেন্স নিয়ে উল্লাস করতে নয়, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হঠাৎ থমকে যাওয়া পরিবার নামক চালকশূন্য রেলগাড়িটার গতি ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় জ্বালানির জোগান দিতে এবং পারিবারিক বিভিন্ন দায় মেটাতেই সেই অর্থ উত্তোলন করতে চায়। তাই এক্ষেত্রে আইনি ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি ব্যাংকারের কাছ থেকে মানবিক ব্যাংকিংও কাম্য।

মোশারফ হোসেনঃ ব্যাংক কর্মকর্তা, ফ্রিল্যান্স লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button