ইসলামী ব্যাংকিং

তারল্য ব্যবস্থাপনায় শরিয়াহভিত্তিক পদ্ধতি

ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়াঃ সম্পদ দিয়ে দায় পরিশোধ করার সক্ষমতা রক্ষা করে চলাই মূলত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তারল্য ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য। আর রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে, দেশের মুদ্রানীতি, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন সামষ্টিক-অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বাজারের তারল্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নের জন্য সরকার অনেকাংশেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করে থাকে। এর জন্য রয়েছে বিশেষ বিশেষ পদ্ধতি ও কৌশল।

যদি নীতিগত বা পদ্ধতিগত কারণে দেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্য ব্যবস্থাপনা ব্যাহত হয়, তাহলে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই অদক্ষ হয়ে পড়বে। একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি সাময়িকভাবে তারল্যঘাটতির সম্মুখীন হয়, তাহলে পুরো ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিই সংকটের সম্মুখীন হবে। এতে করে দেশের অর্থনৈতিক খাতে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে।

একটি প্রতিষ্ঠানের সাপেক্ষে বলা যায়, সম্পদ যদি তরল রূপে থাকে, তাহলে চাওয়া মাত্রই একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার দায় পরিশোধ করতে পারে। আর যদি ফিক্সড অ্যাসেট আকারে থাকে, তাহলে দায় পরিশোধ করতে বিলম্ব হয়। আবার সম্পদ যত বেশি তরল থাকবে, প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্জন করার ক্ষমতা তত কমে যাবে। সম্পদ যত বেশি বিনিয়োগ করা হবে, প্রতিষ্ঠানের উপার্জন তত বাড়বে।

আবার সব সম্পদকে বিনিয়োগ করে ফেললে, প্রতিষ্ঠান তার ডিমান্ড লায়াবিলিটিগুলো পরিশোধে ব্যর্থ হয়। তাই যে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো ব্যাংকের জন্যও তারল্যের একটি কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত তারল্যের মাত্রা বজায় রাখতে পারলেই ব্যাংকের প্রোফিটিবিলিটি যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি ব্যবসায়িক আস্থা বজায় রাখা সম্ভব হয়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

চাহিবামাত্র ব্যাংক দায় পরিশোধ করে বলেই, সাধারণ মানুষ ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখে। সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো সাময়িক তারল্য সংকটের সম্মুখীন হলে কলমানি থেকে সুদে টাকা এনে সে অভাব পূরণ করে নেয়। আবার দীর্ঘমেয়াদে তারল্য বাড়তি হলে ট্রেজারি বন্ড ও ট্রেজারি বিল কিনে, বাড়তি তারল্যকে বিনিয়োগ করে রাখে।

সাধারণ ব্যাংকগুলো কলমানি থেকে টাকা এনে দ্রুত দায় মিটিয়ে ফেলে; কিন্তু পদ্ধতিটি সুদভিত্তিক। এ ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে টাকা আনা হয়। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে কেনাবেচা বা অংশীদারী কারবারের মাধ্যমে একজনের অর্থ অন্য জনের কাছে যেতে পারে, অর্থের বিনিময়ে নয়। তারল্য বাড়তি হলে, ইসলামী ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বন্ড বা ট্রেজারি বিল কিনতে পারে না, কেননা সেগুলোও সুদভিত্তিক।

তারল্য ব্যবস্থাপনা ব্যাহত হওয়ার কারণে ইসলামী ব্যাংকগুলো অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কলমানির শরিয়াভিত্তিক বিকল্প হিসাবে ২০১১ সালে মুদারাবাহভিত্তিক ইন্টারব্যাংক ইসলামিক ফান্ড মার্কেট (আইবিআইএফএম) চালু করে।

এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি তারল্য ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ সরকার ট্রেজারি বন্ডের ইসলামি বিকল্প হিসাবে ২০০৪ সালে মুদারাবাহভিত্তিক গভর্নমেন্ট ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট বন্ড (বিজিআইআইবি) ইস্যু করে। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি তারল্য ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি দুইটি আর্থিকভাবে লাভজনক না হওয়ায়, ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদভিত্তিক বাজারের বিপরীতে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে।

ইসলামি অর্থনীতি ও বিনিয়োগ ব্যবস্থায় অনেক ধরনের বিকল্প পদ্ধতি রয়েছে। বিভিন্ন দেশ, কাল ও পরিস্থিতি সাপেক্ষে উক্ত পদ্ধতিগুলোকে সমন্বিত করে তারল্য ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত পদ্ধতি উন্নয়ন করা সম্ভব। পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি পদ্ধতি উন্নয়ন করা হয়েছে। তারল্য ব্যবস্থাপনায় উক্ত দেশগুলোর সাফল্য ও ব্যর্থতাকে পর্যালোচনা করে আমাদের দেশের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি উন্নয়ন করাই আমাদের লক্ষ।

একটি ব্যাংকের সাপেক্ষে, তারল্য ব্যবস্থাপনার সরলীকৃত চিত্রটি হচ্ছে, যখন কোনো ব্যাংকে তারল্য বাড়তি হয়, তখন সে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বা সরকারি তহবিল বা অন্য কোনো ব্যাংকে বিনিয়োগ করে, আর যখন তার বাড়তি তারল্যের প্রয়োজন পড়ে, সে বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেই তারল্য নিয়ে আসে।

এক্ষেত্রে বন্ড বা বিলের মতো কিছু ডকুমেন্টের মাধ্যমে অর্থের আদান প্রদানকে নিরাপদ করা হয়। যার কাছে উক্ত ডকুমেন্টগুলো থাকবে, তিনি পাবেন মেয়াদান্তে নির্দিষ্ট হারে সুদ; আর যিনি অর্থ নেবেন, তিনি মেয়াদান্তে ডকুমেন্টহোল্ডারদের উক্ত সুদ যোগাবেন, সেইসঙ্গে আসলও। এই হলো একটি সুদি ব্যাংকের সাপেক্ষে তারল্য ব্যবস্থাপনার সরল চিত্র। আমাদের লক্ষ হচ্ছে, এই লেনদেনগুলোর শরিয়াহ কাঠামো তৈরি করা।

এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, প্রথাগত তারল্য ব্যবস্থাপনায় তারল্যকে সময়ের সাপেক্ষে তিনটি ভাগে ভাগ করে দেখা যায়—
ক) স্বল্পমেয়াদি: ওভার নাইট থেকে এক মাস বা তার কম;
খ) মধ্যমমেয়াদি: এক মাসের অধিক থেকে অনধিক এক বছর;
গ) দীর্ঘমেয়াদি: এক বছর থেকে ২০/২৫ বছর।

এখানে উল্লেখ্য যে, একটি ব্যাংকের স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) হিসাব করার সময় ডকুমেন্টগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিভিন্ন মেয়াদের দায়ের বিপরীতে অ্যাসেটের বিন্যাসও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তাই তিনটি মেয়াদের জন্যই পৃথক পৃথক শরিয়াহভিত্তিক পদ্ধতি উন্নয়ন করতে হবে, যা হবে সহজে বাস্তবায়নযোগ্য এবং সুদবিহীন।

তবে সবচেয়ে বেশি করে যেটা নিশ্চিত করতে হবে, তা হলো উক্ত পদ্ধতিগুলো অবশ্যই আর্থিকভাবে লাভজনক হতে হবে, না হলে ইসলামী ব্যাংকগুলো কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে। লেনদেনের জন্য শরিয়াহসম্মত যে পদ্ধতিগুলো রয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতেই সুদবিহীন কার্যকর তারল্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তৈরি করতে হবে।

লেখকঃ ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া, ইসলামী ব্যাংকিং গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button