খেলাপি ঋণ

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে ব্যাংকারের ভূমিকা

আজকে ব্যাংকারদের সৎ-সাহস, নৈতিকতা ও দক্ষতার অভাব, চাকরি হারানোর ভীতি এবং ‘বড়’ হওয়ার অতিলোভ ব্যাংকিং খাতের দুরাবস্থার জন্য বেশি দায়ী। দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রতিনিয়ত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে কার কী ভূমিকা রয়েছে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার অবকাশ আছে, যদিও সে বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যাংকার বা অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণ আমরা সচরাচর পাই না।

এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা হলে ঋণখেলাপিতে পরিণত হওয়ার মূল কারণ খুঁজে বের করা সহজ হতো এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারলে খেলাপি ঋণ আদায়ে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া যেত। ফলস্বরূপ ঋণখেলাপি হওয়ার প্রবণতা কমে যেত এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণও কমত।

ঋণ দিলে সব ঋণ আদায় হবে না। ঋণের ঝুঁকি আছে সব দেশেই; কোথাও কম, কোথাও বেশি। ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের ঋণ ফেরত দিতে আইনত বাধ্য। যদি ঋণগ্রহীতার ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকত, তাহলে হয়তো অধিকাংশ ঋণই আদায় হতো না। অনেক নিয়ম-কানুন মেনে ঋণ প্রদান এবং আইন-কানুনের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি, যা এই খাতকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

গ্রাম-গঞ্জের মানুষও এখন জানে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে স্বেচ্ছা খেলাপিঋণের পরিমাণ বেশি এবং এই ঋণের প্রায় পুরোটাই ফেরত না দেওয়ার জন্য নিয়েছেন তথাকথিত ঋণগ্রহীতারা। আজকের নিবন্ধে আলোচনা করতে চাই বর্ধনশীল খেলাপি ঋণে ব্যাংকারদের ভূমিকা কতটুকু, সেটা নিয়ে, যদিও সেই মূল্যায়ন করা বেশ জটিল কাজ।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।
ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। এই তথ্য দেখলে খেলাপি ঋণের হার সহনীয় মনে হতে পারে কারও কারও কাছে; কিন্তু এটি একটি খণ্ডিত তথ্য (ঠিক যেমন আমরা মাথাপিছু আয় নিয়ে বিভ্রান্ত হই)। কারণ প্রথমত এই তথ্য ব্যাংকিং খাতের খেলাপির প্রকৃত তথ্য প্রদান করছে না।

কেন করছে না- সেটার একটা চিত্র আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে গত সেপ্টেম্বরে। সেই প্রতিবেদন অনুসারে, খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র দ্বিগুণেরও বেশি। তাদের প্রতিবেদন অনুসারে, খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২৬ শতাংশ। এসবের মধ্যে আদালতের স্থগিতাদেশ, পুনঃতফসিল এবং বিশেষ অ্যাকাউন্টের ঋণও রয়েছে। এই পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় অর্ধেক, যা প্রায় সাতটি পদ্মা সেতুর ব্যয়ের সমান।

আর্থিক খাতের এই দায় কার- এমন প্রশ্ন করলে অনেকে বলবেন, এই খাতে তেমন কোনো সমস্যা নেই; যেমন গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সামনে এবিবি’র নেতারা বলেছেন। তাদের চোখে, দেশে ব্যাংক খাতে তেমন কোনো সংকট নেই; আছে কেবল সাফল্য আর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল অর্জন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের ব্যাংকি খাত অনেকদূর এগিয়েছে। বিশেষ করে গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতে ডিপোজিট বেড়েছে, রেমিট্যান্স আয়ে উল্লম্ফন ঘটেছে, বিনিয়োগ বেড়েছে। ঋণের পরিমাণও বেড়েছে বহুগুণ। ফলে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতাও বেড়েছে। এমনকি ছোট ও মাঝারি ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলার মতো সক্ষমতা রয়েছে দেশের প্রায় অর্ধেক ব্যাংকের। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলাপি ঋণও বেড়েছে, যে পরিমাণ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

ব্যাংকারদের মতে, সেটা নতুন কোনো সংকট নয়। খেলাপি ঋণ আগেও ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কথা ঠিক; কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের যে বৈশিষ্ট্য, তা সত্যিই বিরল এবং ব্যাংকের খেলাপি ঋণের এই অবস্থান নিয়ে যদি স্বয়ং ব্যাংকাররা স্তুতি ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, তাহলে এই খাতের প্রকৃত চিত্র আড়ালেই থেকে যাবে এবং বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নতি থেকে যাবে সুদূর পরাহত। এখন ঋণ খেলাপি বৃদ্ধিতে ব্যাংকারের ভূমিকা কতটুকু- এই প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই আসতে পারে।

একটি ঋণ প্রস্তাব সংগ্রহ, ঋণপ্রাপ্তির যোগ্যতা যাচাই, ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ, ঋণের বিপরীতে যে সিকিউরিটি (জমি, বিল্ডিং বা অন্য সম্পত্তি) দেওয়া হয়, সেটার পরিদর্শন ও মূল্যায়ন, কাগজপত্র ঠিক আছে কি না- সেটার পর্যবেক্ষণ, ঋণ প্রস্তাব তৈরি থেকে ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট এবং বড় প্রস্তাব হলে বোর্ড পর্যন্ত নিয়ে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করানো, তারপর ডকুমেন্টেনশন করে ঋণ বিতরণ করা- এই সব দায়িত্ব ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিজেরা করেন এবং কিছু কাজ, যেমন সম্পত্তির ভ্যালুয়েশন করানো, উকিলের আইনগত মতামত নেওয়া, ক্রেডিট রেটিং করানো ইত্যাদি তাদের সরাসরি তদারকিতে সম্পন্ন হয়।

তাই যখন কোনো ঋণ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়, তখন তার দায় মূলত ব্যাংকারদের দিকে যায়; কারণ গ্রাহক খুঁজে বের করা, ভালো গ্রাহক হিসেবে চিহ্নিত করা, ঋণ বিতরণ করা থেকে আদায় করা পর্যন্ত দায়িত্ব ব্যাংকারের। তাই দায়িত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।

যেসব ভুল ব্যাংকার করে থাকেন
✔ যোগ্য গ্রাহক চিহ্নিত না করে ভুল গ্রাহক চিহ্নিত করা।
✔ গ্রাহকের ব্যবসা ভালোভাবে অ্যাসেস করতে ব্যর্থ হওয়া।
✔ গ্রাহকের ব্যবসার ধরন বুঝে চলতি পুঁজি থেকে শুরু করে অন্যান্য ঋণ প্রয়োজনীয়তা পরিমাপ করতে না পারা।
✔ কলাটেরল হিসেবে ত্রুটিমুক্ত জমি বা অন্য সম্পদ না নিয়ে ত্রুটিযুক্ত সিকিউরিটি বন্ধক নেওয়া।
✔ ঋণের সব ডকুমেন্টেশন ঠিকমতো না করা।
✔ গ্রাহকের চালাকি, যেমন আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতির বা মালামালের ওভার বা আন্ডার ইনভয়েসিং ধরতে না পারা।
✔ গ্রাহকের ফান্ড স্থানান্তরের ওপর নজর না রাখা।
✔ একজন বড় গ্রাহককে হ্যান্ডেল করতে না পারা।
✔ ব্যাংকিং সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকা।
✔ ঋণের পর্যাপ্ত মনিটরিং না করা।
✔ গ্রাহকের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ না রাখা।
✔ তাছাড়া অন্যায় ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে মিলে টাকা আত্মসাৎ করলে ঋণ খেলাপি হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে ব্যাংকার তার দায়িত্ব কোনোভাবে অস্বীকার করতে পারেন না।

আমাদের দেশে ব্যাংকিংয়ে যেটার প্রকট অভাব, সেটা হচ্ছে সুশাসন। সরকারি ও বেসরকারি- উভয় ব্যাংকেই বোর্ড গ্রাহক নির্ধারণ ও ঋণ অনুমোদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ব্যাংকের নিয়োগেও তাদের সিদ্ধান্ত সবকিছু। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা এক প্রকার হাতের পুতুলে পরিণত হয়, যদিও অল্প কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। ফলে যেসব ঋণ খেলাপি হয়, তার একটা বড় অংশ প্রেস্ক্রাইবড ঋণ, যে ঋণ না দিয়ে ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট পারে না: চাকরি থাকবে না, না হয় শাস্তি হবে, পদোন্নতি হবে না, শাস্তিমূলক বদলি হবে।

ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট মাথা নত করেন অবলীলায়। মাথা যার উঁচু, মেরুদণ্ড যার শক্ত, তিনি কাজ করতে পারবেন না- এই হলো বাস্তবিক অবস্থা। সেটি সরকারি বা বেসরকারি- সব ব্যাংকেই।

সচেতন মহল মনে করে, এখানেও ঋণ খেলাপি হওয়ার জন্য ব্যাংকাররাই দায়ী। যদি তারা মাথানত না করে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেন, তাহলে ব্যাংকিং সেক্টরে যে অরাজকতা, যে ঋণের পাহাড় অনাদায়ী হয়েছে- তা হতো না; হলেও সেটা সহনীয় পর্যায়ে থাকত। আজকে ব্যাংকারদের সৎ-সাহস, নৈতিকতা ও দক্ষতার অভাব, চাকরি হারানোর ভীতি এবং ‘বড়’ হওয়ার অতিলোভ ব্যাংকিং খাতের এই দুরাবস্থার জন্য বেশি দায়ী- সবাই হয়তো স্বীকার করবেন না; তবে স্বীকার না করলেও বাস্তবতা সে রকম।

প্রশ্ন আসবে, দোষ শুধু ব্যাংকারদের? উত্তর হচ্ছে, না; শুধু ব্যাংকাররা নন, দোষ পুরো ব্যবস্থার, দোষ সুশাসন-জবাবদিহিতা-সততা-দক্ষতা-ন্যায়বিচার ইত্যাদির অভাব এবং দেশে অপরাধের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া সংস্কৃতির। তবে সর্বস্তরের ব্যাংকাররা যদি মেরুদণ্ড শক্ত করে সৎ, দক্ষ ও সাহসী হতে পারেন, এই খেলাপির শিকল থেকে দেশের ব্যাংকি খাত ধীরে ধীরে বের হয়ে আসবে; না হলে যে তিমিরে আছে, সেই তিমিরে পড়ে থাকবে, অথবা আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।

লেখকঃ সাইফুল হোসেন, কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল। [প্রকাশিত এই লেখাটি লেখকের একান্তই নিজস্ব। ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখা ও মতামতের জন্য ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ দায়ী নয়।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button