ব্যাংক গ্রাহক

গ্রাহক সেবার প্রাপ্তি ও একটি ব্যক্তিগত অভিব্যক্ত

দিনু প্রামানিকঃ আমি চাকুরী করি আমার প্রয়োজনে। আমার পরিবারের প্রয়োজনে। আমি চাকুরী করি বেতন পাই, আর এই বেতনটুকুর উপর আমার পরিবার তথা সবাই নির্ভরশীল। যেহেতু আমার পরিবার আমার উপর নির্ভরশীল সেহেতু আমি আমার কর্মে কখনও ফাঁকি দিই না। প্রত্যেকটি কাজ নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে করি। সততা, নিষ্ঠা এবং কঠোর পরিশ্রম দিয়ে সুষ্ঠভাবে সমাধান করার চেষ্টা করি এবং সকল কাজ বেশ সফলতার সাথেই করি।

আমার পেশাটা একটু ভিন্ন। পাবলিক থেকে টাকা সংগ্রহ করি এবং পুরনো ঋণ গ্রহিতাদেরকে তদারকির সাথে সাথে নতুন উদ্দোক্তা খূঁজে বের করি। অতঃপর প্রতিটা কাজ অত্যন্ত সর্তকতা এবং সততার সাথে করতে হয়। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান এর স্বার্থ রক্ষা এবং গ্রাহক সেবা অন্যতম।

এ লেখাটি আমার গ্রাহক সেবার ক্ষুদ্র একটা পার্ট। বছরখানেক আগের কথা, তখন অজপাড়াগাঁয়ের কোন এক শাখার শাখা প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলাম। রোজকার শত গ্রাহকের ভীড়ে একদিন একবৃদ্ধ কাঁপতে কাঁপতে লাঠি ভর করে আমার শাখায় প্রবেশ করল। তার পরনে ছিল ময়লা পুরানো পাঞ্জাবি, লুঙ্গি। আমি তাকে ডেকে আমার সামনের চেয়ারে বসালাম। টি বয়কে বললাম, একগ্লাস পানি দিতে, সাথে চা- বিস্কৃট যা সাধারণতঃ ভদ্র নামমাত্র কিছু গ্রাহকের জন্য বরাদ্ধ থাকে। বৃদ্ধ লোকটির হাতের থলিতে পুরানো, ছেঁড়া পলিথিন কাগজে মোড়ানো। তিনি অন্য এক প্রতিষ্ঠানের কিছু স্থায়ী আমানতের কিছু ব্লক বের করলেন। আমি বললাম, এগুলো আমি কি করব?

তিনি চা ভেজা বিস্কৃট খেতে খেতে কাঁপা গলায় আমাকে বুঝালেন, উমুক ব্যাংক আমার টাকা কাটতে কাটতে আর কিছুই দিচ্ছে না। আমি এবার ভাল করে সব ব্লকগুলো দেখলাম। একসময়ের ব্যাংক আমানত রেট এখন তিনভাগের এক অংশ। তাতে উনার যা লাভ আছে, ব্যাংক সার্ভিস চার্জ, ভ্যাট, এআইটি, আবগারী শুল্ক ও অন্যান্য চার্জ ডেবিট করার পর উনার হাতে নামমাত্র কিছু থাকতেও পারে, নাও পারে। কথার ছলে উনার পরিবারে কে কে আছে জানতে চাই এবং আমি আমার ফোনে উনার নির্ভরযোগ্য একমাত্র ছেলেকে ব্যাংকে আসতে বলি। কেননা, উনার বয়স এবং শারিরিক অবস্থা দেখে উনার টাকা রাখতে আমারই ভয় হচ্ছিল।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

আমাদের শাখাটি অজপাড়াগাঁয়ে হওয়ায় আশপাশে কোথায় সঞ্চয় পত্র বা তার চাইতে ভালো কিছু আমার মাথায় ছিল না। আপাতত তার এলাকার ইউপি সদস্যকে আমি ফোন দিয়ে একটি কৃষি কার্ড করে দেয়ার অনুরোধ করলাম এবং এরই প্রেক্ষিতে বৃদ্ধ লোকটিকে একটি কৃষি হিসাব খুলে দিলাম। কেননা, এখানে আবগারী শুল্ক মাফ করার ক্ষমতা আমার নাই। কিন্তু অন্যান্য চার্জ দিতে হয় না। তাছাড়া এ ধরণের হিসাবে নাই কোন ন্যূনতম জমানো উঠানোর বাধা নিষেধ। অতএব, আমার ব্যাংক হিসাবে মাসিক সর্বোচ্চ আমানতী স্কীম খুলে দিলাম।

মুরুব্বী এতেই খুশি। যাবার সময় কাঁপতে কাঁপতে আমার পাশে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আমার জন্য আর্শিবাদ করল। আমি যা করেছি, সব আমার প্রতিষ্ঠান এর জন্য। আমার নিজের জন্য। এটা আমার চাকুরীর প্রধান অংশ। কিন্তু এই কাজটাই করে যখন অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো সাধাসিধে মুরুব্বী নিজের খুশিতে একটুখানি মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে, এটাতে সত্যিই খুশিতে আমার চোখে জল এসে যায়।

ঠিক তেমন গতকাল, একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে আমার একজন স্নেহের সহকর্মী আমার কাছে নিয়ে এল। তিনি আমাদের শাখায় একটি হিসাব খুলতে চায়। আমি অনুরোধ করলাম, তৃণমুল সঞ্চয় হিসেব খুলে উনাকে এটার সুবিধা অসুবিধে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য।

যিনি তার সারাজীবন কাটিয়েছেন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে, সংসার ধর্ম, দেশ, জাতীকে সেবা করেছেন। এখন তিনি অবসরপ্রাপ্ত। এই চেয়ারে বসে আমি কিভাবে একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের হিসাবের চার্জ কাটতে পারি।

বিশ্বাস করুন, তৃণমূল হিসাবের সুবিধা অসুবিধা বুঝে এবং উক্ত হিসাব খোলার পর তিনিও যাবার সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়েছেন। আমার জন্য দোয়া করেছেন। আমার চোখে জল চলে এসেছে। এখনও দু’চোখে জল টলমল করছে। বড় আনন্দের এ জল। আমার চাকুরী জীবনে এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমি যা করেছি, সব আমার প্রতিষ্ঠান এর জন্য। আমার নিজের জন্য। এটা আমার চাকুরীর প্রধান একটা অংশ। আর এ কাজগুলি করে, যখন এসব সাদাসিদে মানুষের অপ্রত্যাশিত ভালবাসা কপালে জুটে যায় তখন আমার কর্ম, আমার প্রতিষ্ঠান আর আমার দ্বায়িত্বের প্রতি ভালবাসা আর সম্মান বেড়ে যায় বহুগুণ।

(মুখবন্ধঃ আট বছর আগের লেখা। টাইমলাইনে ভেসে উঠল। তাই, আমিও কোন রকম রঙ-ঢং না মেখে হুবুহু শেয়ার করলাম আমার প্রিয় গ্রুপ, পেজে আর প্রিয় অনলাইন প্ল্যার্টফর্মে।)

লেখকঃ দিনু প্রামানিক: নির্বাহী ব্যবস্থাপক, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button