ব্যাংকার

পেশাগত কর্মদক্ষতা বনাম তোষামোদ

মোঃ জিল্লুর রহমানঃ আপনি যখন দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব পালন করবেন, বস বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশংসা পাবেন, তাতে আপনারই সহকর্মীদের মধ্যে কয়েকজন ঈর্ষান্বীত হতে পারে। ফলে, যে সহকর্মীর সঙ্গে আপনার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার কথা, সেই আপনাকে এড়িয়ে চলে, আর তার কারণ হল আপনার কাজের দক্ষতা। অপর দিকে মনযোগ দিয়ে কাজ না করলে ‍কর্মকর্তারা দু-কাথা শুনিয়ে দিতেও এক মুহূর্ত দেরি করে না। এ যেন ‘শাঁখের করাত’। বেশি কাজ দেখালে, অনেক সহকর্মী আপনার উপর কাজ চাপিয়ে দিয়ে নিজে ‘বাতাস খাওয়া’র তালে থাকবে। আবার নির্ধারিত সময়ের আগে কাজ শেষ করতে পারলে কারও কপালে প্রশংসার বদলে জোটে আরও বেশি কাজ, ফলে কাজ করার আগ্রহ কমতে থাকে ক্রমাগত।

তবে সব জায়গাতেই ‘অফিস পলিটিক্স’ নামে একটি কথা প্রচলিত আছে, পৃথিবীর যে দেশেই যান, যে ধরনের প্রতিষ্ঠানেই কাজ করুন না কেনো ‘অফিস রাজনীতি’ থাকবেই। উপযুক্ত কোনো কারণ ছাড়াই আপনার কোনো একজন সহকর্মী কর্মক্ষেত্রে আপনার উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাইবে, আপনার সম্পর্কে অন্যদের কাছে নেতিবাচক মন্তব্য করবে। তাই, এসবের সঙ্গে মোকাবেলা করার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে, নিজের গা বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় রাজনীতিটা আপনাকেও আয়ত্ত করতে হবে। নিজেকে প্রতারিত মনে হতে পারে: এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন, যেখানে আপনার কাজের কৃতিত্ব দেওয়া হবে অন্য কাউকে। যে পদোন্নতি ও স্বীকৃতি আপনার পাওয়া উচিত ছিল, তা হয়ত আপনার সহকর্মী পেয়ে যাচ্ছে। আপনার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে যারা তোষামোদ করছে তারাই পদোন্নতি পাচ্ছে, অপরদিকে আপনি বেশি কাজ করেও উন্নতির ছিঁটেফোঁটাও পাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতি কমবেশি সব প্রতিষ্ঠানেই ঘটছে প্রায়শই।

আরও দেখুন:
◾ চাকরিচ্যুত ব্যাংকারদের পুনর্বহালের দাবি বিডব্লিউএবির

জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলির মধ্যে একটি হল ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উভয় ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা। আমাদের প্রত্যেকের এমন কতগুলো গুণাবলী রয়েছে যা সমাজের সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তারপরও আমাদের মধ্যে কিছু দুর্বলতা রয়েছে যাকে শক্তিশালী করার জন্য ঢালাই করা দরকার। কোন মানুষই নিখুঁত নয়। জীবনে উন্নতির জন্য আমরা নানা পথ অবলম্বন করি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পেশাগত দক্ষতা আরেকটি হচ্ছে তোষামোদ। বিপরীত মেরুর দুটি ভিন্ন যোগ্যতা। একটি বহু কষ্ট সাধনার পর অর্জন করতে হয় এবং অপরটি বিনা পরিশ্রমে বিনা মেঘে অর্জিত হয়। এসব দক্ষতা বিকাশের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয় এবং এটি কার্যকর করার জন্য সেগুলিকে আরও তীক্ষ্ণ করতে হয়। মানব সম্পর্কের বিভিন্ন দিক এবং ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য দক্ষতাগুলি খুবই প্রয়োজন। কিন্তু কিছু মানুষ যখন বিনা পরিশ্রমে তোষামোদি করে কোন কিছু অর্জন করে তখন পেশাগত কর্মদক্ষতা সত্যিই মূল্যহীন মনে হয়!

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোনো কথা বা ঘটনাকে ভিন্ন রূপ দিয়ে অন্যকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াসে প্রকাশ করাকে এক কথায় চাটুকারিতা বলে অভিহিত করা যায়। এর সমার্থক শব্দ হলো তোষামোদি, মোসাহেবি, তৈল মর্দন ইত্যাদি। লক্ষ্য করা যায়, যিনি চাটুকারিতা করছেন, তিনি জেনে-বুঝেই করছেন এবং যার উদ্দেশ্য করছেন তিনি কখনো এটা বুঝতে পেরেও বিষয়টি বেশ উপভোগ করছেন এবং নিজের অজান্তে বিপদ ডেকে আনছেন। কারো অযথা বা মিথ্যা গুণাবলীর প্রশংসা করে সেই ব্যক্তির মাধ্যমে লাভবান হওয়ায় নির্লজ্জ ও ব্যক্তিত্বহীন প্রয়াস হলো চাটুকারিতা। বস বা বড় কর্তার কোনো ব্যর্থতা বা দোষ তোষামোদকারীর দৃষ্টিগোচর হয় না। সাধারণত উর্ধ্বতন বা দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অধস্তন ব্যক্তিদের তোষামোদের শিকার হন।

বর্তমান সময়ে অফিস আদালত কর্মক্ষেত্রের সর্বত্র চাটুকারিতার ব্যাপক বিস্তার দেখা যায়। আজকাল যেন তোষামোদের প্রতিযোগিতা চলছে, যেখানে মানবিকতা, পেশাগত দক্ষতা ও নীতি-আদর্শ হয়ে যায় তুচ্ছ ব্যাপার। তোষামোদের সীমা এতই ছড়িয়ে পড়ে যে নিজের সুবিধা অথবা স্বার্থ আদায়ের জন্য নিজের প্রচেষ্টার পরও কখনো পরিবারের সদস্যদেরও বড়কর্তার সন্তুষ্টির জন্য নিয়োজিত করে সেখানে কোনো নৈতিকতা ও আদর্শ থাকে না। তোষামোদের কারণে কখনো অসামাজিক কাজও হয়ে থাকে। তোষামোদকারী তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য এতই বেপরোয়া হয়ে ওঠে ফলে অন্যের ক্ষতি করতেও দ্ধিধাবোধ করে না।

রাজনীতির ময়দানতো তোষামোদের স্বর্গরাজ্য। বক্তৃতায় মূল বক্তব্য থাকে সিকি ভাগ, বাকী তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে মঞ্চে উপবিষ্ট উচ্ছিষ্ট নেতা-নেত্রীদের গুণকীর্তন, মাহাত্ম্যবর্ণন। সভাস্থলে বিশেষণের একটি ঢল বয়ে যায়, শ্রোতারা বারংবার কেবল অতি বিশেষায়িত পরিচিতি শোনে। সরকার বদল হলেই দল বদল করেন এমন অনেক সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদের গল্প তো আমরা সবাই কম বেশি জানি। তাদেরকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, তারা কেন এত দলবদল করে, তাদের নির্লিপ্ত উত্তর, আমি তো একটাই দল করি, সরকারী দল; এখন সরকার বদল হলে আমি কী করব? সুতরাং রাজনীতির ময়দানের চাটুকারদের কোন দল বা আদর্শ নেই, তারা ক্ষমতার ও সুবিধার পিঠেভাগ চায়। তারা সব সময় দুধের সরটুকু খেতে চায়, মৌচাকের মধুই তাদের বড় পছন্দ!

রাজনীতিতে অনেক পালের গোদা আছেন যারা এদল ওদল করে বর্তমান অবস্থানে এসেছেন, তাদের অনেকের মুখেই ‘ভাজা মাছটি উল্টে খেতে পারিনা’ জাতীয় একটি মুচকি মুচকি হাসি দেখা যায়; ভিজে বেড়ালের এক একটি আদর্শ চেহারা। এসকল বক ধার্মিক আসলে জ্ঞানপাপী, দেশ ও জাতির শত্রু। তারা দেশের মানুষকে ভাবেন গোল্ডফিশ, যার মেমোরী অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, এ্যাকুরিয়ামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গেলে যে গোল্ডফিশ ভুলে যায় সে খাবার খেয়েছিল কিনা। না আমাদের জনগণ গোল্ডফিশ নন, তারা সরলবিশ্বাসী, বারংবার বিশ্বাস করে তারা ঠকেছেন, কিন্তু এখন সজাগ হয়েছেন। বিভিন্ন ‘জুজুড়’ ভয় দেখিয়ে বা সস্তা সেন্টিমেন্ট জাগিয়ে তাদের আর বিভ্রান্ত করা যাবে না।

নৈতিকভাবে উন্নত, সৎ, বিবেকবান মানুষ যে পদেই থাকুন কেন, তিনি সমাজ ও জাতির বড় সম্পদ। পেশাগত কর্ম দক্ষতাই তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাকে দিয়ে উপকার না হলেও অন্তত কারও ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে না। অপরদিকে নৈতিকতা বিবর্জিত তোষামোদি ব্যক্তি যতই উচ্চ আসনেই অবস্থান করুক না কেন, তিনি মােটেও শ্রদ্ধার পাত্র নন। পদমর্যাদার কারণে তাকে হয়তাে মানুষ সামনে কিছু বলে না কিন্তু পেছনে অন্তর থেকে ঘৃণা করে। তার দ্বারা উপকারের চেয়ে দেশ ও জাতির ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।

পেশাগত দক্ষতা যেকোন কর্মের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে উন্নত করার জন্য যে পথই গ্রহণ করি না কেন, এটি মানুষকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যায়। যেকোন মানুষের পেশাগত দক্ষতা নির্ভর করে তার মেজাজ, কর্মশক্তি, ব্যক্তিগত বা পেশাগত লক্ষ্য এবং তার ঐকান্তিক ইচ্ছার উপর। এটি মানুষের লক্ষ্য অর্জনের পদ্ধতি, নিজেদের সম্পর্কে জ্ঞান এবং চারপাশের লোকদের সাথে সম্পর্ক গুলির উপরও নির্ভর করে। উচ্চ লক্ষ্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও জীবনে বড় হওয়ায় ইচ্ছা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কোনো উদ্দেশ্য সাধনের পন্থা ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন হয়। অনেকের কাছে পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি অনেক কষ্টকর বিষয়। অনেকে আবার ধৈর্যশীল নয়। তাই সাফল্য পেতে তারা অনেক সহজ পদ্ধতির সন্ধান করেন এবং চাটুকারিতাকে বেছে নেন। বিশেষ করে অযোগ্য ব্যক্তিরাই বেশি চাটুকার প্রকৃতির হয়।

বড়কর্তা জানেন না কিংবা বুঝতে পারেন না তোষামোদকারীর তোষামোদ বা প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি নিজের ও প্রতিষ্ঠানের কত ক্ষতি সাধন করছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চাটুকারদের কারণে নিজের ব্যক্তি ও কর্মজীবনে বিপদ ডেকে আনেন। যখন নিজের ভুল বুঝতে পারেন তখন অনেক বিলম্ব হয়ে যায়। চাটুকারিতার কারণে অযোগ্য ব্যক্তি যোগ্য পদে বসতে পারে ফলে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় এবং কাজের মান খারাপ হয়। চাটুকারিতার দোষে মেধাবীদের মেধার বিকাশ ঘটে না। চাটুকারিতার ফলে প্রকৃত পরিশ্রমী, সৎ ও আদর্শবান ব্যক্তিগণ কোনঠাসা হয়ে অনেক সময় কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। চাটুকারিতার প্রভাবে বিবেক, মনুষ্যত্ব নষ্ট হয় এবং মানুষের মাঝে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি হারিয়ে যায়।

চাটুকার কর্মদক্ষতা নয়, উপর অলার সুনজরে থাকাই হল চাকুরীতে টিকে থাকা, পদোন্নতি আর সুযোগ সুবিধা লাভের বড় উপায়। ফলে আমাদের জনশক্তির একটি বিপুল সময়, মনোযোগ আর মেধা অপচয় হয় তোষামোদের মত একটি অপ্রয়োজনীয়, অনুৎপাদনশীল কাজে। কাজ না করে ঘন্টার পর ঘন্টা ‘বস’-এর কক্ষে বসে থাকা, তাকে নিরন্তর প্রশংসার বৃষ্টিতে ভিজানো ও মাথা-নাড়ার সংস্কৃতি আমাদের পিছিয়ে পড়া অর্থনীতিকে আরো পিছিয়ে দিচ্ছে। আমাদের প্রশাসন, ব্যবসা বাণিজ্য, অফিস আদালত, রাজনীতির অঙ্গন সর্বত্র ভরে আছে এইসব দুধের মাছিতে। একটি দল ক্ষমতাসীন হলেই মৌসুমী সমর্থকদের রীতিমত ঢল নামে, অফিসে নতুন বস আসলেই চাটুকারীতার জোয়ার বয়ে যায়। কে কত বড় সমর্থক, তার নির্লজ্জ মহড়া, বেহায়া প্রতিযোগিতা চলে। এরা জানে ক্ষমতাবানদের ভিতরকার সেই চিরন্তন দুর্বলতা – তারা তোষামোদে গলে যান।

শুধু প্রতিষ্ঠানের স্বার্থই গুরুত্বপূর্ণ: অপ্রিয় সত্য হল, কর্মক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থের মূল্য নেই বললেই চলে, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থটাই বড়। এই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সিদ্ধি করতে গিয়ে আপনাকে কর্ম ঘণ্টার অতিরিক্ত সময় দিতে হচ্ছে কিনা তা নিয়ে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই মাথাব্যথা থাকে না, হয়ত প্রশংসাটুকুও জুটবে না। বরং, একদিন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কয়েক ঘণ্টা আগে অফিস থেকে বের হতে চাইলেই অফিসের নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দেওয়া হবে। আসলে কোনো মানুষই দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। প্রত্যেকের নিজ ধর্মের প্রতি সম্মান রেখে নিজের ব্যক্তিত্ববোধ জাগ্রত এবং পারস্পারিক ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়াতে হবে। সব সময় ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে সমষ্টিগত স্বার্থ ও মানুষের কল্যান চিন্তা করতে হবে। সুতরাং প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজের চরিত্রকে আগে বদলাতে হবে। তোষামোদ নয়, পেশাগত কর্ম দক্ষতাকে মূল্যায়ণ করতে হবে।

মোঃ জিল্লুর রহমান, ব্যাংক কর্মকর্তা ও ফ্রিল্যান্স লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button