বিবিধ

প্রাইজবন্ড এর টুকিটাকি

প্রণব চৌধুরীঃ হঠাৎ করে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিন বা বিদায় অনুষ্ঠানে যাবেন কিন্তু গিফট কেনার মত সময় বা সুযোগ আপনার হাতে নেই, এমন অবস্থায় সবচেয়ে সহজ সমাধান হচ্ছে উপহার হিসেবে ‘প্রাইজবন্ড’ কে বেছে নেয়া। ‘প্রাইজবন্ড’ আমাদের সমাজে সবার নিকট অতি সুপরিচিত একটি নাম যা সম্পর্কে আসলে নতুন করে কাউকে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। আমাদের আজকের আলোচনা, সবার নিকট সুপরিচিত এই ‘কাগুজে মুদ্রা’ সম্পর্কে। তো চলুন, শুরু করা যাকঃ

প্রাইজবন্ড আসলে এক ধরনের সুদিবিহীন বিনিয়োগ প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সরকার সরাসরি জনগণের নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করে। অর্থাৎ সহজভাবে বললে বিষয়টা এমন যে, আপনি ১০০ টাকা মূল্যের একটি প্রাইজবন্ড ক্রয় করলেন মানে হলো আপনি ঐ ১০০ টাকা সরকার কে ধার দিলেন। সরকার এর কোষাগারে টাকা জমা রাখার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রথম এই বন্ড চালু করা হয়েছিল। তখন এর মূল্যমান ছিল ১০ টাকা ও ৫০ টাকা। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালের ২ জুলাই হতে চালু করা হয় ১০০ টাকা মূল্যমান এর প্রাইজবন্ড।

১০০ টাকা মূল্যমান এর প্রাইজবন্ড চালু হওয়ার পর ৩১ জানুয়ারি, ২০১৫ হতে ১০ ও ৫০ টাকা মূল্যমান এর প্রাইজবন্ড বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। যদিও এটি সঞ্চয় অধিদপ্তরের একটি পণ্য কিন্তু এর পরিচালনা করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। শিশুসহ যেকোন বাংলাদেশী নাগরিক বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল শাখা, বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো এবং দেশের যেকোন ডাকঘর থেকে যেকোন সময় এই বন্ড ক্রয় করতে পারেন। বন্ড এর মালিক চাহিবামাত্র এর মূল্য সরকার দিতে বাধ্য থাকবে।

প্রাইজবন্ডকে অনেক সময় লটারি বন্ড বলা হলেও লটারি’র সাথে এর গুনগত পার্থক্য রয়েছে। লটারি যেমন একবার ‘ড্র’ হয়ে যাবার পর এর আর কোনো মূল্য (যদি আপনি লাটরি বিজয়ী না হয়ে থাকেন) বা মেয়াদ কোনটাই থাকে না, প্রাইজবন্ডের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সেরকম নয়। প্রাইজবন্ড এর ‘ড্র’ সম্পন্ন হয়ে যাবার পরেও এর মেয়াদ শেষ হয়ে যায় না। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, প্রাইজবন্ড এর ‘ড্র’ কয়েকবার হয়ে যাবার পরেও, প্রয়োজন অনুসারে তা ভাঙিয়ে সমমূল্যের টাকা নিয়ে আসা যায়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

‘ড্র’ এর প্রসঙ্গ যেহেতু চলেই আসল, তাহলে এই ‘ড্র’ নিয়ে আলোচনাটা সেরে ফেলা যাক-
প্রতি তিন মাস অন্তর (৩১ জানুয়ারি, ৩০ এপ্রিল, ৩১ জুলাই ও ৩১ অক্টোবর) অর্থাৎ বছরে চারবার প্রাইজবন্ড এর ‘ড্র’ অনুষ্ঠিত হয়। তবে উক্ত তারিখগুলোর কোনটিতে কোন সাপ্তাহিক ছুটি বা সরকারি ছুটি অথবা অন্য কোন কারণে প্রাইজবন্ড এর ‘ড্র’ অনুষ্ঠিত হতে না পারলে পরবর্তী কার্যদিবস এ তা সম্পন্ন করা হয়। প্রাইজবন্ডের ‘ড্র’ করে থাকে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারকে চেয়ারম্যান করে গঠন করা কমিটি।

প্রাইজবন্ড ক্রয় করার পর দুই মাস পার হলে তা ‘ড্র’ এর আওতাভুক্ত হয়। তো এই দুই মাস কখন থেকে গণনা করবেন সেটা নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম নেয়। প্রতিটি বন্ডের উপর তারিখযুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংক এর একটি সিল থাকে। সেই নির্দেশিত তারিখ হতে দুই মাস অতিক্রম হবার পর বন্ডটি ‘ড্র’ এর আওতাভুক্ত হবে। মনে রাখবেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এর ‘সিল’ না থাকলে সেই প্রাইজবন্ড কখনোই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবে না।

‘ড্র’ এর পালা শেষ। এবার পুরস্কার জিতে নেয়ার পালা। তবে পুরস্কার জেতার পূর্বে প্রাইজবন্ড এর সিরিজ সম্পর্কে ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান জেনে নেয়া যাক-
দেশে বর্তমানে ৬৪ টি সিরিজের প্রাইজবন্ড প্রচলিত আছে। তার মানে হলো, একই নাম্বার ৬৪ টি সিরিজেই চালু আছে। সাধারণত, প্রতিটি সিরিজে ১০ লক্ষ পিস করে প্রাইজবন্ড থাকে এবং প্রতিটি প্রাইজবন্ড এর নাম্বার ৭ সংখ্যার হয়ে থাকে যার প্রথম সংখ্যাটি শূন্য দিয়ে শুরু হয়। সেই হিসাবে, বর্তমানে দেশে সর্বমোট প্রাইজবন্ড এর সংখ্যা হলো ৬ কোটি ৪০ লক্ষ পিস।

বাদ দিন পরিসংখ্যান। পুরস্কার এর দিকে যাই এবার-
প্রাইজবন্ডে প্রতিটি সিরিজের জন্য ৪৬টি পুরস্কার রয়েছে। সব মিলিয়ে ৬৪টি সিরিজের প্রতিটির জন্য ৪৬টি করে মোট ২ হাজার ৯৪৪টি পুরস্কার। প্রথম পুরস্কার ১টি ৬ লাখ টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার ১টি ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা, তৃতীয় পুরস্কার ২টি ১ লাখ টাকা করে, চতুর্থ পুরস্কার ২টি ৫০ হাজার টাকা করে এবং পঞ্চম পুরস্কার ৪০টি ১০ হাজার টাকা করে। অর্থাৎ প্রতিটি সিরিজে সর্বমোট ১৬,২৫,০০০ টাকার পুরস্কার।

পুরস্কার তো জিতে গেলেন। এবার পুরস্কার এর অর্থ দাবী করার পালা-
প্রাইজবন্ড এর পুরস্কার এর অর্থ দাবী করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেকোন অফিস অথবা তফসিলি ব্যাংকের যেকোন শাখায় অথবা যেকোন পোস্ট অফিসে যেয়ে মূলবন্ড সহ নির্দিষ্ট ফরম (পিবি-২৩) যথাযথভাবে পূরণ করে আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। আবেদন করার পর যাচাই-বাছাই শেষে, সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে বিজয়ীকে পে-অর্ডার এর মাধ্যমে পুরস্কার এর অর্থ বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

তবে মনে রাখবেন, ‘ড্র’ এর তারিখ থেকে ২ বছরের মধ্যে পুরস্কার দাবি করতে হয়। এই ২ বছর, বিজয়ী নাম্বারটি আর কোনো পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবে না; মানে এই নাম্বারটি পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে অনুষ্ঠিত ‘ড্র’ এর লিস্টে যাবে না। ‘ড্র’ এর ২ বছর পর পুরস্কার তামাদি হয়ে যায় এবং সে অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।

তবে জেনে রাখা ভালো, প্রাইজবন্ড এর পুরস্কার হিসেবে অর্জিত অর্থ করমুক্ত আয় নয়। মানে হলো, পুরস্কার হিসেবে অর্জিত সম্পূর্ণ অর্থই আপনার হাতে পাবেন না। এর থেকে কিছু অংশ সরকার কেটে রেখে দিবে। আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ এর ৫৫ ধারার নির্দেশনা অনুযায়ী, ১ জুলাই, ১৯৯৯ থেকে প্রাইজবন্ড পুরস্কার এর অর্থ থেকে ২০ শতাংশ হারে উৎসে আয়কর কর্তন করার বিধান রয়েছে।

ছেঁড়া কিংবা বিকৃত প্রাইজবন্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের যেকোন অফিসে জমা দেওয়া যায়। বিনিময় যোগ্য হলে দাতাকে সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়। বিনিময় অযোগ্য হলে দাতাকে মৌখিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়।

আরেকটি কথা, প্রাইজবন্ড হচ্ছে একটি ‘Bearer’ বন্ড, তাই এর বাহকই এর মালিক। ফলে এটি আপনার নিকট হতে হারিয়ে গেলে বা চুরি হয়ে গেলে আপনি সেটা প্রমাণাদি সহ দাবী করলেও বিনিময়মূল্য প্রদান করার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ বন্ড যার হাতে, টাকা কিংবা পুরস্কারও তার হাতে!

আজ তাহলে এ পর্যন্তই। চেষ্টা করেছি ছোট পরিসরে সবগুলো পয়েন্ট তুলে ধরতে। কিন্তু তাও লেখাটি বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই আর কথা বাড়াচ্ছি না। সকলের সুস্থতা কামনা করছি। হ্যাপি ব্যাংকিং।

লেখকঃ প্রণব চৌধুরী, ম্যানেজার, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, গোলাপগঞ্জ শাখা, সিলেট।

আরও দেখুন:
প্রাইজ বন্ড কী? প্রাইজ বন্ড কোথায় পাওয়া যায়?
প্রাইজ বন্ড সম্পর্কিত কিছু সাধারন প্রশ্ন ও উত্তর
ইসলামে প্রাইজ বন্ড কি হালাল নাকি হারাম?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button