অর্থনীতিইসলামী অর্থনীতি

সেক্যুলার অর্থ ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব-১

অর্থনীতি মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে একটি অপরিহার্য নিয়ামক শক্তি। জীবনের উত্থান-পতনে অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আমাদের গ্রহে যেদিন থেকে মানব প্রাণের স্পন্দন শুরু হয় ঠিক সেদিন থেকেই মানুষ অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলা করতে শুরু করে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও নবী হযরত আদম (আ)কে বেঁচে থাকার তাগিদে সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেই থেকে শুরু করে অদ্যাবধি মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের সংগ্রাম ও অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনা থেমে নেই। শুধুই অভাব অপনোদনে নয় বরং জীবনকে অধিকতর নিরাপদ ও সুখকর করার জন্য তথা জীবনের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির জন্য মানুষের এ প্রচেষ্টা আধুনিককালে আরও বেগবান হয়েছে।

বস্তুত, আর্থিক বিষয় ও ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের চিন্তার অবধি নেই। কি আয় করবে,কীভাবে আয় করবে, কি ব্যয় করবে ও কীভাবে ব্যয় করবে? তাছাড়া কী উৎপন্ন করবে কিংবা বন্টন ব্যবস্থা কী রকম হবে তাও আলোচনার বিষয় হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসে এ সব বিষয় এবং আরও অনেক বিষয় কেন্দ্রীয় আলোচনার বিষয় বস্তু হিসেবে পরিচিহ্নিত হয়ে আসছে। সমাজের কল্যাণ সাধনই এ সব কিছুর মুখ্য উদ্দেশ্য এটা আপাত দৃষ্টিতে বলা যায়। তবে কল্যাণের মৌলিক উপাদান ও অর্জনের বিষয়ে যথেষ্ট মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এখানে স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষত্রে প্রাধান্য কার সে বিষয়েও মতের ভিন্নতা লক্ষ্যণীয়। এক দল মানব সৃষ্ট মতবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট, অপর দল সৃষ্টি-কর্তাকে আইনের মূল উৎস হিসাবে পরিচিহ্নিত করতে বদ্ধপরিকর। তারপরও অভিপ্রায় লক্ষ্য ও কর্ম-কৌশলে একটি নির্মোহ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে সব সময়।

মূলত আঠার শতক থেকে বর্তমান নিয়ন্ত্রিত ধারার উন্মেষ ঘটে। যার মধ্য ত্রিধারার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও নিজস্ব চিন্তাধারা, মিল-অমিল ভিত্তির উপর প্রতিষ্টিত আলাদা আলাদা কৌশল অবলম্বনের বিষয় প্রণিধানযোগ্য। তবে অতি সম্প্রতি অর্থনীতিতে যে মন্দা ও তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে ও যার ফলে প্রত্যেকটি দেশেই বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকায় ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যে টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ও অনেকগুলো ব্যাংক দেওলিয়া হয়ে যাচ্ছে তা অর্থনীতিবীদ ও সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে। দেশগুলো অর্থনৈতিক ও বহির্দেশীয় ভারসাম্যহীনতা মোকাবেলা করছে। বর্তমানে এই দুই এর ব্যবধানকে কমিয়ে মৌলিক চাহিদা পূরণ, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয়-সম্পদ বন্টনে বৈষম্য হ্রাস করার একটি সমন্বিত কৌশল অবলম্বনের কথা বলা হচ্ছে। অপর পক্ষে, প্রচলিত অর্থ ব্যবস্থায় নৈতিক-ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্বীকার করার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ধর্মীয় অনুশাসনকে উপেক্ষা করা এ সকল মতবাদের অন্যতম লক্ষ্য। বস্তুত, এ সব অর্থ ব্যবস্থায় কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও শেষ পর্যন্ত ধর্মনিরেপক্ষতাবাদী তথা সেক্যুলার কর্ম পদ্ধতির উপর বর্তমান তিন ধারার অর্থনীতি প্রবর্তিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই তিন প্রচলিত অর্থ ব্যবস্থা হলো:
১। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা,
২। সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা ও
৩। দুই অর্থ ব্যবস্থার যুক্ত ফল বা মিশ্র অর্থনীতি।

পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা:
বিশেষজ্ঞদের মতে বস্তুত বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদ বলতে কিছুই নেই। দীর্ঘকাল ধরে পরিবর্তন পরিমাজর্নের ফলে নতুন নতুন পদক্ষেপ সংযোজিত হয়েছে ফলে পুঁজিবাদ তার আসল অবয়বে এখন আর নেই। এত পরিবর্তনের পরও পুঁজিবাদ ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের অনেক দেশই পরিবর্তিত ব্যবস্থার অনুশীলন করছে। তারা লাভ-লোকসান, পুুরস্কার ও ভাতা প্রদানে যোগ্যতা ও কর্মের সমন্বয়ের কথা বলছে। ব্যক্তি তার প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের একচেটিয়া সুবিধা বা সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণে এখানে বাধা নেই। অর্থাৎ জন স্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ কিংবা নিয়মতান্ত্রিকতার বাধ্যবাধকতা নেই। এভাবে সম্পদের পাহাড় গড়তেও সমস্যা নেই।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।
রিলেটেড লেখা

এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ টিবর সিটোভস্কি বলেন, “একদিকে প্রাণহীন বিশাল প্রাচুর্য, অন্যদিকে দারিদ্র বিশৃঙ্খলারই বহিঃপ্রকাশ”। এইচ জি ওয়েলস বলেন, “ক্যাপিটালিজম কী, তাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে, সে সর্ম্পকে আমাদের কারো স্বচ্ছ ধারণা নেই। আমরা শুধু বলব, এটি একটি কৃত্রিম ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা, একটি জটিল ঐতিহ্যগত প্রয়োগ, অনিয়ন্ত্রিত অর্জনেচ্ছু শক্তি এবং বিকৃত সুবিধা ও জীবনের অপচয়”। ডেলটনের ভাষায়, “পুঁজিবাদ ভোগবাদের ফসল, অমানবিক ও অন্যায্য এক সমাজ, সামাজিক বৈষম্য, মালিক–শ্রমিক, ভূস্বামী ও প্রজা এবং শাসক-শাসিতের মধ্যে দ্বন্দ”। এ অর্থ ব্যবস্থা দরিদ্র বিশ্বের অবস্থা পরিবর্তনে সক্ষম হয় নি এটা বাস্তবতা। এখানে ধনী আরও ধনী হওয়ার সূযোগ সৃষ্টি হচ্ছে আর গরিব দিন দিন ফতুর হয়ে যাচ্ছে।

সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা:
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পণ্যের উৎপাদন এবং বন্টনে হস্তক্ষেপ করে থাকে। এ হস্তক্ষেপের ফলে সর্বত্র একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করে। এ অর্থ ব্যবস্থায় সরকার সম্পদের মালিকানার অজুহাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ ও সমাধানে ব্রতী হয়। এক কথায়, ভূমি এবং মূলধন রাষ্ট্রের হাতে রেখে সরকার পরিচালনার চেষ্টা করে, এতে বহুমাত্রিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। ঢালাওভাবে জাতীয়করণের ফলে সর্বত্র বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করে। ব্যক্তি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ না থাকায় শ্রমিক শ্রেণি কর্মোদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে ও উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে।

মিশ্র অর্থনীতি:
এই অর্থনীতিতে অপর দুই অর্থ ব্যবস্থার সমন্বয়ের ব্যর্থ প্রয়াস চালানো হয়েছে। যার ফলে এখানেও একটি গোঁজামিল, বিশৃঙ্খল ও এলোমেলা অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। দ্বি-মুখী নীতির ফলে বাস্তবায়নযোগ্য কোনো একক নীতিই এখানে জোড়ালোভাবে প্রতিফলিত হয় না। এটি একটি বড় সমস্যা।

উপরোল্লিখিত তিন অর্থ ব্যবস্থার প্রতিটিতেই সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে বিবিধ সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে এক এক সময় এক এক বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। এভাবে এ সব মতবাদের অবয়ব মূল থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। তারপরও তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য গঠনমূলক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় নি। ধনী দেশগুলোতে প্রচুর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হলেও কাংখিত লক্ষ্য অর্জনে তথা সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে ও সামষ্টিক দারিদ্র বিমোচনে বিশ্বের অন্য দরিদ্র দেশের কথা দুরে থাক নিজ দেশেও তারা সফলতা অর্জন করতে পারে নি।

চীন, ভারত, রাশিয়া, আমেরিকা কিংবা ইউরোপে এ সময়ে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করছে। খোদ ভারতে চল্লিশ কোটি লোক দারিদ্র সীমার নিচে বাস করছে ও দেশটিতে বর্তমানে কোটি কোটি লোক বেকার। এখনও তারা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা মোকাবেলা করে সফলতা অর্জন করতে পারে নি, যার ফলে সে সব দেশে সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধ প্রবণতা হু হু করে বাড়ছে। আর্থিক অসঙ্গতি, বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রীস, ইটালী ও ফ্রান্সে ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকায় ব্যাংক ব্যবস্থা হুমকির মুখোমুখি। ব্যাংকগুলোর ‘স্ট্রেস ট্রায়াল’ চলছে সে সব দেশে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সে তাদের দেশের প্রেসিডেন্ট এর ভাষায় ‘মূমুর্ষ অবস্থায়’ নিপতিত হয়েছে। এ বিশৃংখল অবস্থা দেখে কিসের আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। বাস্তবিকই সেক্যুলার অর্থনীতির এ সব বিষয় হিসাবে নিলে ব্যক্তি স্বার্থ ও সমাজকল্যাণের পুঁজিবাদ-সমাজতান্ত্রিক মতবাদে যে যথেষ্ট শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। বাস্তব অবস্থা হলো, প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠায় এ সব ব্যবস্থা সে দিকে অমনোযোগিতার কারণে ও পারঙ্গমতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত বাজার ব্যবস্থার অদৃশ্য হাত সবকিছুকে সুবিধাবাদিতায় আড়ষ্ট করে ফেলেছে যা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ইউরোপীয় রেনেসাঁ আন্দোলন পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থাকে বিপুলভাবে প্রভাবান্বিত করে। খৃষ্টীয় বিশ্বাস সে যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। খৃষ্টান পাদ্রীদের অযৌক্তিক-অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড যুক্তিবাদী আধুনিক মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে। এ আন্দোলনের নায়কেরা খ্রীষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাসের বদলে যুক্তিকে প্রাধান্য দিতে থাকে। প্রকৃতই এ খ্রীষ্টীয় ধর্মে কোনো অর্থনৈতিক মতবাদ লক্ষ্য করা যায় না। তবে তারা তথাকথিত যুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব, আত্মার অমরত্ব ও পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টিতে ইন্ধন যুগিয়েছে। এদের মধ্যে ক্লাসিক চিন্তাবিদ লক, হিউম, বার্কলি ও ক্যান্ট অন্যতম।

এ সমস্ত নৈরাশ্যবাদী অর্থনীতিবীদ ও দার্শনিকদের মন্তব্য-বক্তব্য ও বানোয়াট প্রচারণার ফলে সামাজিক ডারউইনবাদের ধারণা আরও উস্কে দিলো, যেখানে বলা হলো অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম, তথা শ্রেণি সংগ্রাম এবং যোগ্যতমের বেঁচে থাকার অধিকার। এভাবে সামাজিক ডারউইনবাদ অর্থনীতিতে অনুপ্রবেশ করে নৈতিকতা ও ন্যায়নীতির চিরন্তন ধারা ও ধারণাকে পাল্টে দিলো। এই বক্তব্যের সার কথা হলো, অর্থনীতি তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হবে। নৈতিক মূল্যমান এখানে কোনো বিচার্য বিষয় নয়। এভাবে নৈতিকতা ও ন্যায়নীতির সংজ্ঞা ওলট-পালট হয়ে গেল। ধনীরা বিবেকের দংশন ও দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকল তথা মুক্তি পেল। দরিদ্র ও বেকার লোকদের অলস উদ্যমহীন ও অসৎ প্রবৃত্তির বলে মনে করা হলো।

পুঁজিবাদের আর এক নাম বস্তুবাদ। বস্তুবাদে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা প্রনিধানযোগ্য। এ দর্শনের মূল কথা হলো বস্তুই মহাবিশ্বের মৌলিক সৃষ্টির ভিত্তি। কোনো উন্নততর উদ্দেশ্য লক্ষ্য বা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারা কর্তৃক মহাবিশ্ব চালিত নয়। তাদের বক্তব্য হলো, প্রত্যেক কিছুকেই বস্তুর ভিত্তি ও প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা করতে হবে। তাদের মতে সম্পদ, দৈহিক ভোগ ও ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য সুখ হচ্ছে সর্বোচ্চ বিষয়, যা মানুষ অর্জন করতে পারে। লক এর ভাষায় মানব চরিত্র হলো ‘টেবুলা রাসা’ অর্থাৎ, যার কোনো চরিত্র বলতে কিছুই নেই। মার্কস, ফ্রয়েড, ওয়াটসন প্রমুখ অর্থনীতিবিদ মানুষের মনকে পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত বলে অভিহিত করেছেন। এ সব অর্থ পূজা ও লোভ-লালসার নিন্দা জানিয়ে কুরআন ঘোষণা করছে, “তোমাদেরকে বেশি বেশী অর্থ সম্পদ সঞ্চিত করার চিন্তাা চরমভাবে নিমগ্ন করে রেখেছে। কবরে পা দেয়া পর্যন্ত এ চিন্তায় তোমরা বিভোর থাক। কখনও নয় অতি শ্রীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। (সূরা আত তাকাসুর: ১-৩)

এ সব মতবাদে ধর্মীয় মূল্যবোধের স্বকীয় শক্তিকে অস্বীকারের ফলে ধর্মীয় অনুশাসনকে দুর্বল করার ব্যর্থ প্রচেষ্ঠা চালানো হয়। যার ফলে স্রষ্টার সৃষ্টি সকল মানুষের সমতার ধারণাটি ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। বস্তুবাদে ধর্মীয় অনুশাসন মানার বাধ্যবাধকতা না থাকায় নৈতিকতার বিষয়টি এখানে শিথিল হয়ে পড়ে। অপরদিকে, দার্শনিক টয়েনবি বলেন, ‘আসল কথা হলো ধর্ম মানুষের মাঝে সামাজিক দায়িত্বানুভূতিকে ধ্বংসের পরিবর্তে বৃদ্ধি করে থাকে’। তার সাথে তাল মিলিয়ে এরিয়েল ডুরান্টও জোরালোভাবে বলেন, ‘ধর্মের সাহায্য ব্যতিরেকে কোনো সমাজ উচ্চ নৈতিক মান বজায় রাখতে পেরেছে ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই’। দুঃখের বিষয়, ইসলামকেও এখানে অন্যান্য ধর্মের সাথে গুলিয়ে ফেলার মিথ্যা প্ররোচনা সৃষ্টি হয়। অথচ প্রচলিত অর্থে ইসলাম ইহুদী,হিন্দু কিংবা খ্রীষ্টান ধর্মের মত কোনো ধর্ম নয়। বরং, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ বলেন, ‘আমার নিকট একমাত্র মনোনীত ও গ্রহণযোগ্য জীবন বিধান হচ্ছে ইসলাম’। অর্থনীতিসহ জীবনের সকল দিক ও বিভাগের বাস্তব, কল্যাণকর ও সুন্দর ব্যাখা রয়েছে ইসলামে যা চিন্তাশীল মানুষের মন-মননকে জাগিয়ে তোলে ও আলোড়িত করে।

পুঁজিবাদে বন্টন ব্যবস্থা স্বচ্ছ নয়, সমতাভিত্তিক কিংবা ন্যায়সংগতও নয়। এক কথায়, সম্পদের সুষম বন্টন ব্যবস্থা এখানে উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপস্থিত। এমনকি বাধাবন্ধনহীনভাবে সম্পদের পাহাড় গড়তেও সমস্যা নেই এ পদ্ধতিতে। এখানে মুনাফার স্তুপকে স্ফীত করে তুললেও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের অপরিহার্য প্রয়োজন মেটানের কোনো বাধ্যবাধকতা কিংবা জরুরি ব্যবস্থা নেই। এ সময় কিছু সংখ্যক মানুষ তথা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের হাতে সীমাহীন অর্থ ও সম্পদ আবর্তিত হতে থাকে। অভাবী ও ভাগ্যাহত মানুষের ন্যুনতম অধিকার প্রাপ্তিও তখন অনিশ্চিত থাকে। প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন ও বন্টনে পুঁজিবাদে কড়াকড়ি নেই। এ ক্ষেত্রে এ মতবাদ সমাজে ন্যায় নীতি প্রদর্শনে সমর্থ হয় নি। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অর্থ সম্পদ যেন কেবলমাত্র তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়।’ (সূরা হাঁশর: ৭)। বস্তুত বন্টন ব্যবস্থায় অদক্ষতা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। উপরন্তু, নৈতিকতার বালাই না থাকায় ধনীরা ‘টাকা যার জগৎ তার’ মনোভাবে পরিচালিত হয়। ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজে গরিবদের অধিকার স্বীকৃতির পরিবর্তে তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হয়। পুঁজিবাদে অত্যাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয় চাহিদাকে আলাদাভাবে দেখার অবকাশ নেই। যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি, ঘাটতি ও মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়ে সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।

এ দুই ব্যবস্থা অগ্রাধিকার নির্ণয়ের চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বিত্তশালীদের কদর এখানে সবচেয়ে বেশী। এটি অনেকটা তেলা মাথায় তেল দেয়ার মতই। মানবিক বিষয়টা মূখ্য বিষয় নয়। এ মানসিকতার কারণেই ধনী রাষ্ট্রগুলো গরিব রাষ্ট্রগুলোর জন্য তেমন কিছু করছে না। অথচ এটা তাদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল। তাদের আচরনে প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যেক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার ও অগ্রাধিকার নির্ণয়ে পুঁজিবাদ আন্তরিক নয়, যার ফলে গরিব বিশ্ব দূর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক টানাপোড়নে জর্জরিত। বস্তুত ‘দারিদ্র বিমোচন’ এর নামে গরিব দেশগুলোকে শোষণ করা হচ্ছে, এ রকম দাবি উড়িয়ে দেয়ার মত নয়। বরং এটা দিবালোকের মত সত্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

ভারত-আমেরিকা-ইসরাইল তিন অক্ষশক্তি এবং চীন, রাশিয়া ও ইউরোপ সারা পৃথিবীর প্রায় ৮৫% প্রতিরক্ষা ব্যয় সংগঠিত করছে। এমন কি ঐ সমস্ত দেশ বাকী বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে। যার ফলে ঐ সব দেশ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার এ খাতে অপচয় করছে। তারা এভাবে রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্টত্ব বজায় রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নিজেরা নামছে ও অন্যদের নামিয়ে সীমাহীন দূর্ভোগ ও যুদ্ধবিগ্রহ লাগিয়ে অমানবিক কর্মের জন্ম দিচ্ছে। এশিয়া আফ্রিকায় যখন ভয়াবহ দুর্র্ভিক্ষ চলছে তখন তারা সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অর্থ-সম্পদ অপচয়ের উল্লাসে মেতে উঠেছে। অথচ এ সন্ত্রাসবাদ তারাই সৃষ্টি করছে এমন অভিযোগও রয়েছে যা চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। এতে মনে হয়েছে দরিদ্র বিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন লোকের সীমাহীন দারিদ্রের ব্যাপারে তাদের লোক দেখানো প্রবণতা আছে তবে প্রকৃত মাথা ব্যথা নেই, যা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। অথচ এ সব গরিব লোকদের জন্য ধনী দেশগুলোর অনেক দায়িত্ব ছিল।

প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সমাজ মদ, জুয়া ও বেশ্যাবৃত্তির পিছনে হাজার কোটি ডলার নষ্ট করছে। অতি সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমান বিশ্বের মাত্র কয়েকজন ধনী লোকের সম্পদের পরিমান প্রায় ২০৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার আর যার মাধ্যমে বিশ্বের সকল দরিদ্র মানুষের ৪ বার অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। ইসলাম এ রকম সীমাহীন সম্পদ অর্জনের প্রচেষ্ঠাকে গ্রাহ্য মনে করে না উপরন্তু যাকাত প্রথার মাধ্যমে একে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। নিবন্ধটি আপনি পড়ছেন ব্যাংকিং নিউজ বিডি ডটকম-এ। অপরপক্ষে ইসলাম লাগামহীন ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়কে গ্রাহ্যতা দেয় নি, অশ্লীলতা ও জেনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এ সব হারাম কাজে ব্যয় করাও হারাম করা হয়েছে। কুরআন এগুলোকে অপচয় বলে আখ্যা দিয়েছে ও বলছে ‘অপচয়কারী শয়তানের ভাই’। অর্থাৎ, শয়তানের মত অপচয়কারীরাও দোজখের বাসিন্দা হবে।

নিউটনের সুত্রের মত অর্থনীতিকে গাণিতিক উপায়ে সমাধান করতে গিয়ে বিশ্ব জনমত সম্পর্কে যান্ত্রিকতার ধারণাকে সমাজ বিজ্ঞানের উপর অর্পণ করা হয়েছে। জড় পদার্থের মত মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো মানুষ কেবল ব্যক্তি স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হবে। জেভনস্ এর ভাষায় মানুষের সমগ্র আচরণ স্বীয় স্বার্থ ও উপযোগিতা দ্বারা যান্ত্রিকভাবে পরিচালিত। এড্যাম স্মীথ এর মতে অদৃশ্য হাত সমাজের স্বার্থ রক্ষা ও নিশ্চিত করবে। তাছাড়া এখানে নৈতিক মূল্যবোধের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করেছে। তাদের মতে অর্থনীতিতে মানবিকতা বা আদর্শিক মতবাদের কোনো স্থান নেই। এ মতবাদকে পজিটিভিজম বলা হয়। পুঁজিবাদের তিক্ত ফল এই যে পশ্চিমা বিশ্ব নিজের আখের ঘোচানোর ব্যবস্থা করেছে সব সময়।

এভাবে দরিদ্র বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠীকে দাসানুদাসে পরিণত করা হয়েছে। এ সব বিবেকহীন কর্মকাণ্ডের জন্য ইংল্যাণ্ডের টমাস কার্লাইল, রাস্কিন ও চার্লস ডিকেন্স এবং আমেরিকার হেনরী জর্জ এর মত বিশ্ব বিখ্যাত চিন্তাবিদগণ ‘লেইজেস ফেয়ার’ (যেমন চলছে তেমন চলুক) নীতির স্বার্থপর মতবাদকে সাংঘাতিকভাবে আক্রমন করে কলম যুদ্ধ চালিয়ে যান। কার্লাইল অর্থনীতিকে ডিসমিসাল সাইয়েন্স তথা ‘ব্যক্তি স্বার্থ সমাজ স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্থ করে না’ মতবাদের বিরোধিতা করেন। হেনরী জর্জ বিত্ত ও দারিদ্রের বৈপরিত্যকে নিন্দা করেন। এখানে সমতাভিত্তিক বন্টন ব্যবস্থার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। উপরন্তু, সমাজে বৈষম্যমূলক বিতরণ ব্যবস্থা প্রবর্তিত। এখানে বিত্ত বেসাতির মালিক উচ্চ শ্রেণির অঙ্গুলী হেলোনীতে অর্থনীতি চলে। স্যামুয়েল্সন স্বীকার করে বলেন, ‘সম্পদ ও আয় বন্টনের নীতি ও তত্ত্ব এখনো স্থীতিশীলতা লাভ করে নি’। (চলবে)

লেখকঃ এম ওসমান গনি: বিশিষ্ট ব্যাংকার, লেখক, গবেষক ও কলামিষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button