অর্থনীতিক্ষুদ্রঋণ

ক্ষুদ্র ঋণ এবং কিছু ভাবনা

বিত্তহীন লোকদের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের কথা আজ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষকরে তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা আলোচিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ডঃ ইউনুসের মাধ্যমে দারিদ্রতা দূরীকরণে ক্ষুদ্র ঋণের বিষয়টি ব্যাপকভাবে গুরুত্ব পায়। বিভিন্ন সংস্থাগুলো ৮০ এর দশক হতে তাদের ক্ষুদ্র ঋণের কার্যক্রম শুরু করে। এখন প্রশ্ন হলো তাদের এ কার্যক্রম দারিদ্র বিমোচনে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

আজকে অনেকে প্রশ্ন তুলেন, সত্যি কি NGO দের ক্ষুদ্র ঋণ দ্বারা দরিদ্র জনসাধারণ উপকৃত হতে পেরেছে? আমরা যদি ঋণ বিতরণের ব্যবস্থাপনার দিকে লক্ষ্য রাখি, তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বর্তমান NGO রা হচ্ছে রবীন্দ্র যুগের কাবুলিওয়ালাদের মত। কাবুলিওয়ালারা ঋণ দেয় সুদ পাওযার জন্য। বর্তমানে NGO প্রতিষ্ঠানগুলো সেই কাবুলিওয়ালা, বেপারী, মহাজনদের স্থান দখল করেছে। যদিও তারা বলে থাকে, গ্রামীণ জনগণকে উৎপাদনশীল খাতে নিয়োগের মাধ্যমে তারা আর্থসামজিক উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। কিন্তু ভেবে দেখলে এটা সহজে বলা যায়, তারা কোন উৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রদান করে না।

গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, ব্র্যাক, প্রশিকা বা যে কোন NGO প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিতরণের দিকে আপনি নজর দিন। তারা মহিলাদেরকে বা পুরুষদের কোন গ্রুপ ছাড়া ঋণ প্রদান করে না। ৫ জন বা ৭জন বা ৮জনের গ্রুপ তৈরী করতে হয় ঋণ পাওয়ার জন্য। যদি কোন ব্যক্তি পালিয়ে যায় বা মারা যায়, তবে গ্রুপের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে সে ঋণ পরিশোধ করবে। অর্থাৎ NGO দের কোণ ঋণ মার যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এজন্যই NGO দের ঋণ পাওয়ার জন্য অন্যান্য ব্যাংকের মত জামানত দেয়ার প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে গ্রুপের অন্যান্য সদস্যরা হল সম্মিলিতভাবে এক অন্যের জামানত। অতএব এটা বলা যায় যে, ক্ষুদ্র ঋণ পাওয়ার জন্য NGO দের কোন জামানত দিতে হয় না, বক্তব্যটি মোটেই ঠিক নয় বরং গ্রুপের প্রতিটি সদস্য সম্মিলিতভাবে একে অন্যের জামানত।

এরপর মনে করেন একজন সদস্য ৫০০০ টাকা ঋণ পেল, যেখানে সুদের হার ১৫%। অর্থাৎ এ ঋণ সম্পূর্ণ ১ বছর হাতে রেখে পরিশোধ করলে তাকে সুদ হিসেবে বছরে ৭৫০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু ঋণ দেয়ার সময় বাধ্যতামূলক সঞ্চয় হিসেবে ৫০০ টাকা কেটে নিল। ফলে ঋণ গ্রহীতা পেল ৪৫০০ টাকা। কিন্তু তাকে সুদ দিতে হচ্ছে ৭৫০ টাকা। ফলে ৪৫০০ টাকার ভিত্তিতে ৭৫০ টাকা সুদ দেয়ার কারণে সুদের ১৫% হতে বেড়ে ১৬.৬৭% হয়। আবার ঋণ নেয়ার পরবর্তী সপ্তাহে ১ম কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। এভাবে ৫২টি কিস্তি পরিশোধ করতে হয়, যেখানে সুদ ও আসলে প্রতি কিস্তির টাকার পরিমাণ হল ১১১ টাকার মত।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

কিন্তু গাণিতিক নিয়মে ১৫% সুদ দিতে হলে পুরো ৫০০০ টাকা ১ বছর ঋণ গ্রহীতার হাতে থাকতে হবে। কিন্তু ২৬ কিস্তি দেয়ার পর তার কাছে ঋণের টাকা থাকার পরিমাণ অর্ধেকে চলে আসে, কিন্তু সুদ দিতে হয় পুরো ৫০০০ টাকার উপর। তাই NGO দের বাস্তব সুদের হার ১৫% হতে অনেক বেশি হয়। অর্থাৎ সুদের হারের দিক হতে NGO রা হল কাবুলিওয়ালাদের নতুন রূপ।

উপরের আলোচনায় দেখা যায়, ঋণ গ্রহণের পর ১ সপ্তাহ পর পর কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। যদি ১ সপ্তাহ পর পর কিস্তি পরিশোধ করতে হয়, তবে কিভাবে পুরো ৫০০০ (প্রকৃতপক্ষে ৪৫০০) টাকা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা যাবে? এক্ষেত্রে এ টাকার একটি অংশ কিস্তি পরিশোধের জন্য রেখে দিতে হয়। তাহলে দেখা গেল যে, ঋণ গ্রহীতরা ঋণের টাকা কোন উৎপাদনশীল খাতে লাগাতে পারে না। বরং এ টাকা ব্যবহৃত হয় ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে বা ক্ষুদ্র ব্যবসা খাতে। যদি ক্ষুদ্র ঋণের অর্থ উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ হত, তবে তা গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোতে একটি পরিবর্তন আনতে পারত। কিন্তু NGO দের ঋণ ব্যবস্থাপনার কারণে তা উৎপাদন খাতে কাজে না লেগে বরং ব্যবসা খাতে কাজে লাগে। ব্যবসা খাতের অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

কিন্তু আমাদের দারিদ্রতা দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণ। আমাদের উৎপাদন খাত হতে ব্যবসাখাতে পূজি বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ঘটিয়েছি, যা ঋণ গ্রহীতার আর্থিক আয়ের বৃদ্ধিকে শোষণ করে নিয়েছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। একজন দরিদ্র ব্যক্তি ৫০০০ টাকা ঋণ নিয়ে ফেরি ব্যবসা (সব্জি বা মাছ বা অন্যকিছু) শুরু করল। যেহেতু ফেরি ব্যবসার মাধ্যমে পণেরে প্রাপ্যতা সহজলভ্য করে তুলে সেহেতু চাহিদার পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণ ব্যতীত এ ধরনের চাহিদা বৃদ্ধি পণ্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি ঘটায়।

ফলে NGO কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক আয়ের যে বৃদ্ধি ঘটে, তার একটি অংশ মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যায় এবং অপর অংশ নিঃশেষ হয় সুদ প্রদানের মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হল, দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক আয়ের বৃদ্ধির পেছনে NGO দের ভূমিকা কতটুকু? গ্রামীণ অর্থনীতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, সেখানে মহিলারা ধানের কলে বা ক্ষুদ্র কারখানায়, পুরুষরা একই পেশায় বা অনেকে রিক্সা চালিয়ে আয় উপার্জন করে।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধানের কল বা ক্ষুদ্র কারখানা হওয়ার পিছনে কারণ হল প্রতিটি সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে অবকাঠামোর উন্নয়ন, গ্রাম পর্যায়ে বিদ্যুত পৌঁছে যাওয়া ইত্যাদি। আর এ সমস্থ কার্যক্রমের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তার মাধ্যমে সৃষ্ট আয়ের একটি অংশ NGO রা সুদের মাধ্যমে নিজেদের পকেটে নিয়ে যাচ্ছে। যদি গ্রামে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ না হত, তবে এক গ্রাম হতে আরেক গ্রামে মানুষ পায়ে হেটে যেত, রিক্সায় যেত না। কিন্তু রাস্তা-ঘাট হওয়ায় রিক্সা চলে এবং যে রিক্সা চালায় সে প্রতি সপ্তায় ১৩০ টাকার মত কিস্তি NGO দের প্রদান করছে।

পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ঋণ নিলে সে কিস্তির পরিমাণ আরও বেশি হবে। অর্থাৎ সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের সুফল সুবিধাবাদী NGO রা কিস্তির মাধ্যমে দরিদ্র লোকদের নিকট হতে নিয়ে যাচ্ছে। যদি সরকারের কাজের মাধ্যমে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ না হত বা বিদ্যুত না আসত তবে NGO রা এসমস্ত দরিদ্র লোকদের ঋণ প্রদান করত না, কারণ তা পরিশোধের কোন সুযোগ থাকত না। পূর্বে দরিদ্র জনগণের ঋণের পরিমাণ কম ছিল। এখন তারা গ্রামীণ ব্যাংক হতে ঋণ নিয়ে সে ঋণ পরিশোধ করে আশা হতে ঋণ নিয়ে, আশার ঋণ পরিশোধ করে ব্র্যাক হতে ঋণ নিয়ে, ব্র্যাকের ঋণ পরিশোধ করে প্রশিকা হতে ঋণ নিয়ে, প্রশিকার ঋণ পরিশোধ করে প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছে যাওয়া কণ্যা সন্তানের নামে নতুন ঋণ নিয়ে। এরা সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধের জন্য এবং রাতের বেলায় একটু সুখ করে ঋণের টাকায় কেনা টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখে।

ঋণের টাকায় মেয়ের জামাইকে যৌতুক দিল, বিয়ের পর শুরু হল কঠোর পরিশ্রম, যৌতুকের টাকা সুদসহ পরিশোধ করা। NGO দের আগমণে যৌতুকের (যেমন খাট, টেবিল চেয়ার, সাইকেল) পরিমাণ বেড়ে গেল, কারণ ছেলেপক্ষ বলে ঋণ নিয়ে যৌতুক দিয়ে দাও। আজ গ্রামীণ দরিদ্র জনসাধারণের প্রায় সবাই ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ। আমাদের দরিদ্র জনসাধারণের মাথাপিছু আয়ের একটি অংশ NGO দের পকেটে চলে যায়। তাই সরকারকে নজর দিতে হবে তার উন্নয়নমূলক কাজের সুফল যাতে দরিদ্র জনসাধারণ ভোগ করতে পারে। আর এজন্য NGO দের কার্যক্রম সরকারকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

এক্ষেত্রে ডঃ ইউনুস কোন সমস্যা নয়, বরং সমস্যা হল তার ক্ষুদ্র ঋণের বেড়াজাল। ডঃ ইউনুসের মত পূজিপতিরা জানেন দরিদ্র লোকদের বড় অংকের ঋণ প্রদান করলে ঋণের টাকা ফেরত আসবে না। এক্ষেত্রে তাদেরকে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে তা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা সুদ সহ ১০০% হলে, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প একটি লাভজনক প্রকল্প হবে। তাই ডঃ ইউনুস সমস্যা নয়, সমস্যা হল গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, প্রশিকা, টিএমএসএস, ব্র্যাক ইত্যাদি সংস্থার কার্যক্রম।

লিখেছেনঃ আবু নিশাত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button