ইসলামী ব্যাংকিং

ইসলামী ব্যাংকিং এর ইতিহাস পর্ব-৪

আসসালামু আলাইকুম। আশা করি আল্লাহর রহমতে সবাই ভাল আছেন। ১ম, ২য় ও ৩য় পর্ব নিশ্চয় আপনাদের ভাল লেগেছে। আজ আমরা জানব ইসলামী ব্যাংকিং এর ইতিহাস সংক্রান্ত বিষয়ের ৪র্থ পর্ব সম্পর্কে। আশা করছি সবার কাজে লাগবে। আর কথা না বাড়িয়ে চলুন ৪র্থ পর্বে।

প্রশাসন, আইন ও নিয়ন্ত্রণঃ
বিশ্বের মাত্র দুটি দেশে, ইরান ও সুদানে, সম্পূর্ণ ইসলামী ব্যাংকিং আইন ও কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ইসলামী ব্যতীত অন্য কোনো ব্যাংক পরিচালনার সুযোগ সেখানে নেই। এছাড়া অন্য সকল দেশে ইসলামী ব্যাংকের পাশাপাশি সুদী ব্যাংকও পরিচালিত হয়। তাই সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ভিন্নভাবে পরিচালনার জন্য পৃথক ইসলামী ব্যাংকিং আইনের প্রয়োজন।

মালয়েশিয়ায় ১৯৮৩ সনে ইসলামিক ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৮৪ তে তাকাফুল আইন করা হয়। এছাড়া সেন্ট্রাল ব্যাংক অব মালয়েশিয়া অ্যাক্ট ২০০৯ -এ ইসলামী অর্থব্যবস্থার সপক্ষে বেশ কিছু ধারা যুক্ত করা হয়। তন্মধ্যে শরীয়াহ বোর্ডকে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী কর্তৃপক্ষ ঘোষণা প্রদান অন্যতম। [১]

তাছাড়া মালয়েশিয়ায় সরকারী পর্যায়ে দুটো শরীয়াহ কাউন্সিল আছে। একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক – ব্যাংক নেগারায়। অপরটি এসইসি বা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনে। আবার কোর্টে মুয়ামালাত ডিভিশন আছে। যারা শরীয়াহ অনুযায়ী মুয়ামালাতের মামলাগুলো দেখেন। [২]

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

ইসলামী ব্যাংকিংয়ে শরীয়াহ বিভাগের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরীয়াহর আলোকে সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করাই এ বিভাগের মূল দায়িত্ব। যে কোনো প্রোডাক্ট বা পদ্ধতি উদ্ভাবনের শুরু থেকে প্রোডাক্টটির ডকুমেন্টেশন ও বাজারজাতকরণ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে শরীয়াহ রিভিউ, ও বাৎসরিক শরীয়াহ রিভিউ এ বিভাগ করে থাকে।

ইসলামিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে শরীয়াহ সুনিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ১৯৯১ সনে প্রতিষ্ঠিত হয় বাহরাইনভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন মানদণ্ড (শরীয়াহ, হিসাব ও নিরীক্ষা) প্রণয়নকারী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘আওফি’। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এর শরীয়াহ বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছে জাস্টিস মুফতী তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ।

বিশ্বের ৪৫ দেশের দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান আওফির সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, আইনি পরামর্শের প্রতিষ্ঠান, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

এ পর্যন্ত মোট ৮৮টি স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ড প্রণয়ন করেছে আওফি। তন্মধ্যে ৪৮টি শরীয়াহ, ২৬টি নিরীক্ষা, ৫টি হিসাব, ৭টি প্রশাসন ও দুটি নৈতিকতা সম্পর্কিত। নতুন মানদণ্ড প্রণয়ন করা ছাড়াও পুরনো মানদণ্ডসমূহ রিভিউ করে যথাযথ পরিবর্তন এনে থাকে আওফি। [৩]

মানদণ্ড প্রণয়ন ছাড়াও শরীয়াহ বিষয়ক জ্ঞানের জন্য সার্টিফাইড শারিয়াহ এডভাইজর এ্যান্ড অডিটর (CSAA) ও সার্টিফাইড ইসলামিক প্রফেশনাল একাউন্টেন্ট (CIPA) নামক দুটি কোর্স পরিচালনা করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। [৪]

আওফির পাশাপাশি মালয়েশিয়া ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বোর্ড (আইএফএসবি, প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৩) ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক মানদণ্ড প্রণয়ন করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত মোট ১৫টি মানদণ্ড প্রকাশ করেছে। [৫]

আইএসবি ছাড়াও মালয়েশিয়ায় উল্লেখযোগ্য আরো দুটো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ১. ইন্টারন্যাশনাল শারিয়াহ রিসার্চ অ্যাকাডেমি (ইসরা)। এতে দেশ-বিদেশের শারিয়াহ বিশেষজ্ঞ বা উলামায়ে কিরামের সমন্বয়ে মুয়ামালাত বিষয়ে গবেষণা করা হয়। [৬] ২. ইনসেইফ: এটি বিশ্বের একমাত্র সম্পূর্ণ ইসলামিক ফাইন্যান্স বিশ্ববিদ্যালয়। [৭]

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংঃ
বাংলাদেশে মোট ৮টি পরিপূর্ণ ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। ১৭টি ব্যাংকে রয়েছে ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো বা শাখা। ১৩টি ইসলামী ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৬টি তাকাফুল ও ৩টি অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরের ২১ শতাংশ মার্কেট শেয়ার ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের। গত ৪ বছরে ইসলামী ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মোট এ্যাসেট ও ডিপোজিট ২০১২ তে ১ ট্রিলিয়ন টাকা অতিক্রম করেছে। [৮]

২০০১ সনে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকসমূহের কেন্দ্রীয় শরীয়াহ বোর্ড ‘সেন্ট্রাল শরীয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ’। গবেষণা, প্রশিক্ষণ, ফাতওয়া ইত্যাদি নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৯ সনে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ‘গাইডলাইন্স ফর ইসলামিক ব্যাংকিং’ নামে ব্যাংকগুলোর জন্য একটি পৃথক গাইডলাইন প্রকাশ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক মালয়েশিয়া-ভিত্তিক আইএফএসবির সদস্যপদও গ্রহণ করেছে।

এসবই আশাব্যঞ্জক খবর। তবে এখনো বাংলাদেশে কোনো পৃথক ইসলামিক ব্যাংকিং আইন তৈরি হয় নি। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকেরও ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ভিন্ন নজরদারী ও নিয়ন্ত্রণ সেভাবে নেই।

অপরদিকে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে পারদর্শী গড়ে তোলার জন্য এখনো কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন ব্যাংকের নিজস্ব কিছু শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে। অথচ যে কোনো ব্যবস্থাকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।

উপসংহারঃ
বাংলাদেশে আইন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সামনে যাওয়ার পথ বিপদসংকুল হয়ে উঠছে। পারদর্শী ও সচেতন ব্যক্তিদের অভাব ছাড়াও এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শরীয়াহ বিশেষজ্ঞদের অভাব প্রকট।

প্রতি বছর এ দেশে হাজার হাজার ছাত্র কওমী মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা শেষ করা সত্ত্বেও ফিকহুল মুয়ামালাত ও আধুনিক অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে পারদর্শী আলিমের সংখ্যা হাতে গোনা। অল্প কিছু ইফতা বিভাগ আধুনিক মুয়ামালাতের বিষয়ে স্বতন্ত্র বিশেষায়িত শিক্ষা দিচ্ছে।

ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা প্রতিটি মুসলিমের ঈমানের দাবী। আর ঈমান বাঁচানোর কাজ উলামায়ে কিরামই বেশি করে থাকেন। তাই এ সেক্টরে উলামায়ে কিরামের সবচেয়ে অগ্রগামী হওয়া সময়ের দাবী।

মসজিদের খুতবায়, দৈনিক-সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকায় লেখনীতে, বিভিন্ন বয়ানে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। সকল ইফতা বিভাগে এ বিষয়ে স্বতন্ত্র গবেষণা, মুতালায়া ও তামরীনের পাশাপাশি ছাত্রদেরকে বাস্তবে ব্যাংকগুলোর অবস্থা যাচাইয়ে পাঠানো যেতে পারে।

বেফাকসহ সকল বোর্ডের সিলেবাসে আধুনিক মুয়ামালাতের ওপর লিখিত বই ওপরের ক্লাসে পাঠ্যবই করা যেতে পারে। পাকিস্তানের জামিয়াতুর রশীদে ইফতা বিভাগে অধ্যয়নকারী একই সাথে মুফতী ও এমবিএ ডিগ্রী লাভ করে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে অবদান রাখেন।

অনুরূপভাবে সাধারণ মানুষের জন্যও আধুনিক মুয়ামালাত বুঝার কোর্স চালু করা যেতে পারে। মুফতী তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহর পরিচালনায় দারুল উলূম করাচীতে ব্যাংকার ও সাধারণ মানুষের জন্য কোর্স পরিচালিত হয়। দারুল উলূম করাচীতে এজন্য স্বতন্ত্র একটি বিভাগ রয়েছে, ‘সেন্টার ফর ইসলামিক ইকনমিক্স’ নামে। [৯]

শরীয়াহ বোর্ডের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন দক্ষ উলামায়ে কিরাম। এ জায়গাটায় বর্তমানে যোগ্য লোকের প্রচণ্ড অভাব। ফলে শরীয়াহ লঙ্ঘন হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।

ঈমান ও আমল হেফাজতের অন্য সকল ক্ষেত্রের ন্যায় এ জায়গাটারও হক উলামায়ে কিরামের। বর্তমানে রিবামুক্ত অর্থনীতি চিন্তা করতে গেলে এ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। তাই সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে উলামায়ে কিরাম যেন এই সেক্টরের নেতৃত্ব দেন, সেই দোয়া ও প্রত্যাশা করছি।
সমাপ্ত। ভাল থাকবেন। আল্লাহ হাফিজ।

তথ্যসূত্রঃ
১. ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম – ইন্টারন্যাশনাল শারিয়াহ রিসার্চ অ্যাকাডেমি – পৃ:৬৪৭
২. আই.এফ.এন এশিয়া ফোরাম ২০১৩, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া, অক্টোবর ২০১৩
৩. আই.এফ.এন এশিয়া ফোরাম ২০১৩, ড. খালদি আল ফাকিহ-র প্রেজেন্টেশন, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া, অক্টোবর ২০১৩
৪. বিস্তারিত দেখুন: www.aaoifi.com
৫. বিস্তারিত দেখুন: www.ifsb.org
৬. ওয়েবসাইট: www.isra.my
৭. ওয়েবসাইট: www.inceif.org
৮. আই.এফ.এস.বি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ সেমিনারে প্রেজেন্টেশন, মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান, সেপ্টেম্বর ২০১৩
৯. দেখুন: www.cie.com.pk

[একটি স্মারকে প্রকাশিত, অনলাইন থেকে সংগৃহীত]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button