সুদ ও মুনাফা

ইভ্যালি কি সুদি লেনদেন করছে?

জনপ্রিয় ই-কমার্স প্লাটফর্ম ‘ইভ্যালির’ সাথে মোটামুটি সবাই পরিচিত। আমরা সবাই কম বেশি ‘ইভ্যালি’ থেকে পণ্য কিনে থাকি। আমরা যে পদ্ধতিতে ইভ্যালি থেকে পণ্য কিনি সেটা হচ্ছে আমরা টাকা আগে দেই আর পণ্য চুক্তিপত্রে পণ্যের নাম, ধরন, পরিমাণ, গুণাগুণ, মূল্য পরিশোধের সময় ও স্থান ইত্যাদি অনুযায়ী Delivery পাই। আর এ ধরনের বেচাকেনাকে ইসলামি শরীয়াহ্তে বাইয়ে সালাম বলে।

বাইয়ে সালাম মানে ক্রেতা মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করবে, আর পণ্য পরবর্তী সময়ে গ্রহণ করবে। আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। যেমন- ক্রেতা ১ হাজার টাকা নগদ দেবে। ৪ বা ৫ মাস পর বিক্রেতা ক্রেতাকে ৩ বা ৪ মণ ধান দেবে।

একটু বলে নেই। আরবি শব্দ সালাম অর্থ হস্তান্তর করা। যেহেতু এ ধরনের বেচাকেনায় টাকা অগ্রিম হস্তান্তর করা হয় আর পণ্য পরবর্তী সময়ে গ্রহণ করা হয়, তাই এই বেচাকেনাকে বাইয়ে সালাম বলে। এর আরেকটি নাম হলো বাইয়ে সলফ।

ইসলামি শরিয়তে বেচাকেনাতে সামান্য ধরনের অস্পষ্টতার কারণেও যেখানে বেচাকেনাকে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে বাইয়ে সালামকে পণ্য সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও শুধু গুণাগুণ জানা থাকার শর্তে হালাল সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণ ও সুবিধার দিকে লক্ষ্য রেখে। কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসে এর বৈধতার প্রমাণ রয়েছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।
রিলেটেড লেখা

আল্লাহ তা’আলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا تَدَايَنْتُمْ بِدَيْنٍ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى فَاكْتُبُوهُ অথার্ৎ হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ঋনের আদান-প্রদান কর, তখন তা লিপিবদ্ধ করে নাও এবং তোমাদের মধ্যে কোন লেখক ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লিখে দেবে; লেখক লিখতে অস্বীকার করবে না। (সূরা বাকারা-২৮২)।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় আসেন তখন মদীনাবাসী ফলে দু’ ও তিন বছরের মেয়াদি সালাম ব্যবসা করত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কোন ব্যক্তি সালাম ব্যবসা করলে সে যেন নির্দিষ্ট মাপে এবং নির্দিষ্ট ওজনে নির্দিষ্ট মেয়াদে সালাম করে। (সহীহ বোখারী-২২৪০, সহীহ মুসলিম-৪২০২)।

এখন আসি ইভ্যালি প্রসংগে। আমরা ইভ্যালি থেকে যদি চুক্তি অনুযায়ী Specific time এর মধ্যে পণ্য হাতে পেয়ে যাই তখন এটা বাইয়ে সালাম অনুযায়ী ঠিক আছে। কিন্তু ইভ্যালির সাথে আমাদের লেনদেন তখনই ইসলামি ক্রয় বিক্রয়ের নিয়ম নীতির পরিপন্থী এবং সুদযুক্ত হয়ে যাবে যখন আমরা নিম্নে উল্লেখিত পদ্ধতির যেকোন একটি গ্রহণ করব।

(১) ইভ্যালি থেকে একটি নির্দিষ্ট পণ্য ক্রয় করার পরে যদি তারা পণ্য না দিয়ে রিফান্ড দিতে চায় তাহলে রিফান্ড না নিয়ে যদি যে পণ্যের জন্য টাকা দিয়েছিলেন এই পণ্য না নিয়ে (যেহেতু এই পণ্য তারা দিবে না) অন্য পণ্য দিতে বলেন তাহলে কি অন্য পণ্য নেওয়া বৈধ হবে?

অর্থাৎ আপনি যদি একটি ৭০ হাজার টাকার স্যামসাং ফ্রিজ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেন এবং কিছুদিন পর তারা যদি বলে ৭০ হাজার টাকা রিফান্ড নিতে, এক্ষেত্রে আপনি যদি বলেন রিফান্ড নিবেন না আপনাদের স্টক এ অন্য মডেলের যে ফ্রিজ আছে সেটা দেন তাহলে অন্য ফ্রিজ নিয়ে ব্যবহার করা কি বৈধ হবে।

উত্তর হচ্ছে সালাম আকদ অনুষ্টিত হওয়ার পর উক্ত সালামের হস্তান্তরিত মূল্য দ্বারা রাব্বুল মাল ভিন্ন কিছূ সেই ব্যক্তি থেকেও ক্রয় করতে পারবে না, যার সাথে সালাম অনুষ্টিত হয়েছে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন, হয়তো তুমি তোমার সালাম আকদের মালকে ক্রয় করো অথবা মূল্যকে গ্রহণ করো। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাঃ এর কথার অর্থ হল, সালাম আকদ বাকী থাকাবস্থায় তুমি ঐ পণ্য ব্যতিত অন্য কিছু গ্রহণ করতে পারবেনা। আর সালাম আকদকে বাতিল করা অবস্থায় তুমি মূল্যকে গ্রহণ করতে পারবে। সালাম আকদে উল্লেখিত পণ্য মূল্যকে বদলানো যাবে না।

(২) আপনি ইভালি থেকে একটা বাইক অর্ডার দিয়েছেন যেটা আপনাকে ৩ মাস পরে দিবে। তারা আপনাকে ২ লক্ষ টাকার বাইক ১.৫ লক্ষ টাকায় দিচ্ছে। আপনি নিয়ত করেছেন যে তা পরে একজনকে ২ লক্ষতে বিক্রি করবেন। আপনার এই ব্যবসা হালাল হবে কি?

হ্যাঁ, আপনার এ জাতীয় ব্যবসা জায়েয হবে। আপনি ইভ্যালি থেকে মূল্যকে প্রথমে পরিশোধ করে যে মাল ক্রয় করেছেন, যা তিন মাস পর আপনাকে ডেলিভারি দেওয়া হবে, সেই পদ্ধতির ক্রয়-বিক্রয়ের নাম হল, বাইয়ে সালাম।

শরীয়তের দৃষ্টিতে বাইয়ে সালাম গ্রহণযোগ্য। তবে শর্ত হল, উক্ত বাইয়ে সালাম দ্বারা ক্রয়কৃত মাল হস্তগত হওয়ার পূর্বে অন্য কোথাও বিক্রি করতে পারবেন না। আপাতত বিক্রির নিয়ত রাখতে পারেন। তবে হস্তগত হওয়ার পূর্বে কারো কাছে বিক্রি করে টাকা আনতে পারবেন না। কারণ বাইয়ে সালাম পদ্ধতিতে কোন বস্তু অগ্রিম ক্রয় করার পর সে বস্তু ক্রেতা কর্তৃক হস্তগত করার পূর্বে অপরের নিকট বিক্রি করতে পারে না।

(৩) ইভ্যালি থেকে আপনি একটি বাইক ক্রয়ের জন্য যদি ৩ লক্ষ টাকা প্রদান করেন। কিন্তু তাদের শর্ত মোতাবেক তারা ৪৫ কর্ম দিবসের মধ্যে ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হয়ে এবং তারা স্বেচ্ছায় বাইকের বাজার মূল্য ৪ লক্ষ টাকার চেক প্রদান করে। এমতাবস্থায় আপনি কি চেক গ্রহন করতে পারবেন? বাড়তি টাকাটা কি আপনার জন্য সুদ হবে?

হ্যাঁ, অবশ্যই সুদ হবে এবং ক্রয় বিক্রয় শুদ্ধ হবে না। কারণ বাইয়ে সালামে মেয়াদান্তে বিক্রেতা ক্রেতাকে মালামাল সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে তার নিকট থেকে অগ্রিম প্রদত্ত মূল্যের অতিরিক্ত কিছু ক্রেতা কর্তৃক গ্রহণ করা যাবে না।

বিক্রেতা মালামাল ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলে ক্রেতা তার নিকট থেকে মালামালের মূল্য ফেরত নিতে পারে কিংবা তার হাতে মালামাল আসা পর্যন্ত বিক্রেতাকে সময় দিতে পারে। কিন্তু ক্রেতা মূল্যের অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করতে পারবে না। অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করলে তা সুদ বলে গণ্য হবে। যেহেতু ক্রেতার নিকট মালামাল সরবরাহের পূর্ব পর্যন্ত মালের মূল্য বিক্রেতার নিকট ঋণ হিসেবে থাকে। আর ঋণের উপর সময়ের ব্যবধানের উপর ভিত্তি করে কিছু আদায় করার অর্থ হচ্ছে সুদ আদায় করা।

তাছাড়া চেক গ্রহন করার মানে হচ্ছে মাল হস্তগত হওয়ার পূর্বে কারো কাছে বিক্রি করা। হাদিসে এসেেছ, যা তোমার নিকট নেই তা বিক্রয় করো না। সুনানে তিরমিজী, হাদিস নং ১২৩২, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৫০৩।

এছাড়াও কোন কোম্পানি যদি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থের বিনিময়ে তারচেয়ে দেড় বা দু গুণ পণ্যের ডিসকাউন্ড কার্ড বা গিফটকার্ড বিক্রি করে একটা শর্তের মাধ্যমে যে এতদিন পর আপনি এই গিফটকার্ড ব্যবহার করে শপিং করতে পারবেন, তাহলে এই গিফটকার্ড কিনে রাখা জায়েজ হবে কিনা? না হলে এটা সুদের আওতায় পড়বে কিনা!

উদাহরন হিসেবে ধরুন, ক কোম্পানি দশ হাজার টাকার গিফটকার্ড ছাড়ল। এমনি সময়ে তার দাম দশ হাজারই। কিন্তু অফারে এই কার্ডটি তিন হাজার টাকা এখন। এই কার্ড ৪৫/৫০ দিন পর ব্যবহার করে আপনি দশ হাজার টাকার পণ্য ক্রয় করতে পারবেন। তাহলে এই কার্ড তিন হাজার টাকা দিয়ে কেনা সঠিক হবে কিনা?

উত্তর হলো- না, জায়েয হবে না। কেননা এখানে নির্দিষ্ট কোনো পণ্যর আলোচনা নাই। অথচ বাইয়ে সালাম জায়েয হওয়ার অন্যতম শর্ত হল, পণ্যর নাম, ধরন, পরিমাণ, গুণাগুণ উল্লেখ থাকা।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে এখানে আল গারার এর সম্ভাবনা আছে। ইসলামি পণ্ডিতগণ বাইয়ুল গারার-এর সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন। নিম্নে তা প্রদত্ত হলো:
(ক) আল্লামা কাসানী রাহ. বলেন: ‘‘গারার হচ্ছে এমন একটি অনিশ্চয়তা, যাতে হওয়া এবং না-হওয়া উভয় দিক বিদ্যমান।’’ [বাদায়ে‘উস সানায়ে‘উ, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৩৬৬]

(খ) আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন: ‘‘বাইয়ুল গারার ঐ কারবারকে বলা হয় যাতে পণ্য বা সেবা পাওয়া যাবে কিনা তা অনিশ্চিত অথবা চুক্তিভুক্ত ব্যক্তি নিজে তা যোগান দিতে অক্ষম অথবা যারা পরিণাম অজানা’’ [যাদুল মা‘আদ, খণ্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ৭২৫]।

(গ) কারো কারো মতে, বাইয়ুল গারার হলো: ‘‘যে কোনো কারবারের চুক্তির মধ্যে অনিশ্চয়তা।’’ যেমন, পুকুরে বা নদীতে মাছ কেনা-বেচা, আকাশে উড়ন্ত পাখি বেচা-কেনা ইত্যাদি।

মোটকথা, যাতে হাসিল হওয়া বা না-হওয়ার অনিশ্চয়তা রয়েছে তাই হচ্ছে আল-গারার। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী যে ব্যবসায় এ গারার পাওয়া যাবে তা অবৈধ ও নাজায়িয। আল্লামা ইবন কুদামাহ তার ‘আশ-শারহুল কাবীর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইবরাহীম হারবীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, কোনো লোক যদি এ শর্তে মোরগ ভাড়া নিতে চায় যে, এ মোরগ তাকে সালাতের সময় ঘুম থেকে জাগাবে তবে এ ধরনের কারবার জায়িয হবে কি না? তিনি উত্তর দিলেন, না। কারণ এটি অনিশ্চিত কারবার। হতে পারে কখনো কখনো মোরগ ডাকবে না, আবার কখনো সালাতের সময়ের আগে ডাকবে বা পরে ডাকবে, আবার কখনো হয়তো তার মুখ থেকে ডাক বের করার জন্য প্রহারের প্রয়োজন হবে ইত্যাদি। সুতরাং নানাবিধ অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা থাকায় এ ধরনের চুক্তি জায়িয নেই। [খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৩১৯]।

আসুন, যা করি ভেবে চিন্তে করি। আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তাওফিক দান করুক। আমিন।

কার্টেসিঃ এমএএস আইবিবিএল

আরও দেখুন:
ব্যাংকের সুদ ও রিবা কি এক জিনিস?
সুদ কী? ইসলামে সুদের ভয়াবহতা!
রিবা বা সুদের তাৎপর্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button