আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা সমাধান জরুরি
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদঃ বাংলাদেশের আর্থিক বাজারে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে ভূমিকা রাখার কথা তা রাখছে না। পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী যখন এসব প্রতিষ্ঠানের আরো সক্রিয় হওয়ার কথা, এখন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দিন দিন বড় হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে কয়েকটি আলোচিত আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে এসেছে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অথচ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় শক্তির জায়গাটাই হলো মানুষের আস্থা। এই মুহূর্তে কভিড-উত্তর দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং উন্নয়ন যাত্রা অব্যাহত ও টেকসই করতে এসব প্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান মূলত ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান—এই দুই ভাগে বিভক্ত। ব্যাংকের বাইরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একাংশকে নন-ব্যাংকি ফিন্যানশিয়াল ইনস্টিটিউশন (এনবিএফআই) বলা হয়, যেটাকে আমরা ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলছি। এর বাইরে আরেকটি হচ্ছে পুঁজিবাজার। আমরা সাধারণত ব্যাংকিং খাত নিয়েই বেশির ভাগ কথা বলি।
কারণ আমাদের ব্যাংকিং খাতে নানা সমস্যা রয়েছে। অর্থবাজারে এর বিশাল প্রভাব বলে আমরা এই খাতের অনিয়মগুলো নিয়ে বিচলিত বোধ করি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের পুঁজিবাজারও মোটামুটি কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বন্ড মার্কেট ও শেয়ার মার্কেট—দুটি এখন পর্যন্ত যথেষ্ট উন্নত নয়। তবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে আমাদের মনোযোগ খুব কম। অথচ অর্থবাজারে এর ভূমিকা বিশাল।
অন্যান্য দেশে এনবিএফআই প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থবাজারে যথেষ্ট ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে পারছে না। আমাদের দেশে এনবিএফআইয়ের অস্তিত্ব অনেক দিক থেকেই আছে। আমাদের প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮১ সালে আইপিডিসির মধ্য দিয়ে। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্স দিয়ে থাকে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৪-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর মতোই আমাদের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর রেগুলেটরি বডি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে এখন ৩৪টা আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান নানা রকম সমস্যায় জর্জরিত। বিশেষ করে আমানতের টাকা নিয়ে সেটার বিপরীতে সুদ ও মূল জামানত পরিশোধ করা।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
ফলে জনগণের বিশাল অঙ্কের টাকা আটকে আছে বছরের পর বছর। বড় কথা হলো, এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি বা তহবিল তছরুপের মাধ্যমে লুটপাট হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা হন্যে হয়ে ঘুরছে তাদের পেছনে। এমনকি ইদানীং অনেক গ্রাহক আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকও নানা ধরনের অ্যাকশন নিচ্ছে। তাতে আমানতকারীদের উদ্বেগ কমছে না। ফলে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সার্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এটা মোটেও কাম্য নয়।
দেশে ব্যাংকবহির্ভূত ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটা সরকারি, ১৯টি স্থানীয় মালিক এবং ১২টি যৌথ মালিকানাধীন। অর্থাৎ মালিকানাটা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। তবে তাদের অভিন্ন সমস্যা হলো, তাদের বড় আকারের অর্থ নেই। এরা সাধারণত ব্যাংকের মতো ডিপোজিট নিতে পারে না বা ব্যাংকের মতো নগদ অর্থ আদান-প্রদান করতে পারে না। এর সর্বোচ্চ এবং প্রধান অর্থের উৎসটা হলো এফডিআর। ন্যূনতম তিন মাসের কমে তারা আমানত সংগ্রহ করতে পারে না। আর বিনিয়োগ হচ্ছে এদের প্রধান আয়ের উৎস। ব্যাংকের মতো এরা এলসি খোলা বা এজাতীয় কিছু করতে পারে না।
এনবিএফআইয়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রধানত এদের আয় স্বল্প. কার্যপরিধিও সীমিত। প্রথমত, এরা লিজ ফিন্যান্সিং ও ব্রিজ ফিন্যান্সিং করে থাকে। তারপর রিয়েল এস্টেটে তারা কাজ করে থাকে। এদের কাজ খুব সীমিত এবং ব্যাংকের সঙ্গে এদের প্রতিযোগিতা আছে, ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পেরে ওঠা কঠিন। দ্বিতীয়ত, সাবসিডির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তারা মার্চেন্ট ব্যাংকিং এবং ব্রোকারের কাজ তারা করে থাকে। তৃতীয়ত, তাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো তারল্য সংকট। কারণ তিন মাসের কম মেয়াদি আমানত তারা নিতে পারে না।
কিন্তু পাশাপাশি তারা যে ঋণগুলো দেয় সেটা আবার স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদিও আছে, যেমন—গৃহঋণ, গাড়ি বা অন্য কোনো অ্যাসেট কেনায় ব্যবহার করা ঋণ। তাদের তারল্যের সংকটের সঙ্গে অ্যাসেট লায়াবিলিটি মিস ম্যানেজমেন্টের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে তাদের অর্থের সংস্থান ও বিনিয়োগের (ঋণ) মধ্যে ফারাক থাকে। তাই এসব প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটে ভোগে।
এখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। এটা মোটামুটি ভালো, তবে সমস্যা অন্যত্র। সেটা হচ্ছে পরিচালনাগত সমস্যা। অনেক প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাকভাবে চালাতে পারছে না। তাদের ব্যবস্থাপনা বেশ দুর্বল। তাদের লোকবলও দুর্বল। তাদের আয়ের উৎস কম এবং আয়ের পরিমাণ কম বলে তারা ভালো লোকও নিয়োগ দিতে পারে না।
ফলে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সুপারভিশন তা ব্যাংকের মতো কঠোর বা জোরালো নয়। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে অনেক ঘাটতি রয়েছে। ফলে এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক নজর কম দেয়। নজর কম দেওয়া কিংবা নজর দিতে না পারায় এখানে সুশাসন ও ব্যবস্থাপনায় প্রচুর ঘাটতি আছে। এসব সমস্যা যদি আমরা কাটিয়ে না উঠতে পারি, তাহলে আমাদের আর্থিক খাত গভীর সংকটে পড়বে।
এই খাতে আরো অনেক সমস্যা আমরা দেখি। প্রথমত, এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুষ্ঠু তদারকির অভাব। দ্বিতীয়ত, এখানে প্রতিবেদন, অডিট পর্যবেক্ষণের মান বেশ খারাপ। অডিটগুলো ভালো হয় না। এমনকি ফিন্যানশিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও তাদের ত্রুটিগুলো ধরা পড়েছে। এ ছাড়া এখানে বোর্ডের চেয়ারম্যান, সদস্যরা অবাঞ্ছিত প্রভাব খাটাচ্ছেন ও সুবিধা গ্রহণ করছেন।
সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক চেয়ারম্যান প্রচুর ঋণ নিয়েছেন, এক এমডি নাকি নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ঋণ নিয়েছেন। তারপর দুর্নীতি তো আছেই। আর সবচেয়ে বড় হলো অনেক মন্দ ঋণ। যদিও ব্যাংকের তুলনায় এদের মন্দ ঋণ একটু কম বা সার্বিকভাবে ৫ থেকে ৬ শতাংশের বেশি নয়; কিন্তু মন্দ ঋণ অল্প থাকা সত্ত্বেও যেহেতু তাদের ডিপোজিট কম, তাই তাদের সামান্য মন্দ ঋণই এ খাতের ওপর বিশাল নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আমরা যদি অন্যান্য দেশের দিকে তাকাই দেখতে পাব, তাদের ছোট অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে। বিশেষ করে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো ছোট প্রতিষ্ঠান হলেও বা কোনো অঞ্চল বা জেলা লেভেলে থাকলেও বা স্বল্পপুঁজির হলেও তাদের কিন্তু মেইন স্ট্রিম ফিন্যান্সের সঙ্গে একটা গভীর যোগসূত্র রয়েছে। সেটা সম্ভব হয় তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। তাদের সবচেয়ে বড় সক্ষমতার জায়গাটা হলো আইটি বা টেকনোলজি। যেমন—ছোট একটি শহরে স্থাপিত একটি টাউন ব্যাংক। ওই ব্যাংকটাও কিন্তু আইটিতে এত ওয়েল কানেকটেড যে এরা বিদেশি ঋণ আদান-প্রদানেও সহায়তা করতে পারে।
বিপরীতে বাংলাদেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান শুধু ঢাকায় এবং প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনায়ও খুব দুর্বল। আমাদের তো সার্বিক ব্যবস্থাপনাই দুর্বল। আরেকটা পার্থক্য হলো, বাইরের দেশে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বহুমুখী কাজ করে এবং সীমিত পরিসরে কাজ করে। তাদের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে, তবে তাদের মধ্যে যোগসূত্র দৃঢ়। আমাদের দেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা সব মিলিয়ে ২৫০টির মতো। এটা মোটেও খুব বেশি নয়। বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই সুনিয়ন্ত্রিত এবং মূলধারার অর্থ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত, যেটা আমাদের এখানে নেই।
এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের কী করতে হবে? প্রথমত, আমাদের এত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থাকার দরকার নেই। এগুলোর পুনর্বিন্যাস করতে হবে, দরকার হলে কোনো ব্যাংকের সঙ্গে বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো কোনোটাকে একীভূত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কিছু ক্ষেত্রে এসএমই বা ছোট ছোট ব্যবসায় তাদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এই মুহূর্তে কভিড-উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এটা খুব দরকার। যেমন—এখন এসএমই খাতের জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজটা রয়েছে, তা ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক মাধ্যমে দ্রুত বিতরণ করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু স্পেশাল রিফাইন্যান্স স্কিম করতে পারে, যেগুলো উদ্যোগী যুবক, নারী ও বিশেষ উদ্যোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান করতে পারে।
সব শেষে বলব, আমাদের ব্যাংকসহ সব ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। এই খাতে সুশাসনের অভাব বড় সমস্যা। জনগণের মধ্যে আস্থার অভাব রয়েছে। আস্থার অভাব হওয়ায় লোকজন অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এখন সময় হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে দ্রুত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দেওয়া এবং তাদের সমস্যার সমাধান ও সংস্কারের মাধ্যমে এগুলোকে একটা উন্নত পর্যায়ে নিয়ে আসা। নতুবা আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতিটা বেগবান হবে না, বরং নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
লেখকঃ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।