জেনারেল ব্যাংকিং

বাণিজ্যিক ব্যাংকের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা সমূহ

বাণিজ্যিক ব্যাংক কে কেন্দ্র করে একটি দেশের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য গড়ে ওঠে৷ এতে বৃদ্ধি পায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সম্ভব হয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন৷ কাজেই একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাণিজ্যিক ব্যাংকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য৷ বস্তুত বাণিজ্যিক ব্যাংককে কেন্দ্র করেই আধুনিক বিশ্বের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ আবর্তিত হচ্ছে৷ আর এজন্য অনেকেই বাণিজ্যিক ব্যাংককে আধুনিক অর্থনীতির মধ্যমনি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন৷ নিম্নে বিভিন্ন দিক বিচারে বাণিজ্যিক ব্যাংকের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা সমূহ আলোচনা করা হলো-

১) Collecting deposit & formation of capital (সঞ্চয় সংগ্রহ ও মূলধন গঠন)
উন্নয়নশীল দেশে অনেক সময় সংগ্রহযোগ্য মূলধন থাকা সত্বেও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে৷ এসব দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংক মূলধন গঠন এবং সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে৷ জনগণের অব্যবহৃত এবং উদ্বৃত্ত সঞ্চয় সংগ্রহ করে বিভিন্ন উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করতে পারে৷ একটি দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা মূলধনের ওপর নির্ভরশীল৷ উন্নয়নের জন্য যে মূলধন প্রয়োজন তা বেশিরভাগ দেশে নেই৷ এসব দেশের অনগ্রসরতার প্রধান কারণ মূলধনের স্বল্পতা৷ মুলধন সৃষ্টির জন্য দরকার সঞ্চয়৷ আর এ সঞ্চয় সংগ্রহ করে বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখছে৷

আরও দেখুন:
ব্যাংক কি বা ব্যাংক কাকে বলে?
ব্যাংকিং কি বা ব্যাংকিং কাকে বলে?
বাণিজ্যিক ব্যাংক কাকে বলে?

২) Providing loan (ঋণদান)
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রহণকৃত আমানতের একটি অংশ আমানতকারীদের দাবি মেটানোর জন্য নিজের কাছে তারল্য হিসেবে রেখে দেয় এবং বাকি অংশ ব্যবসায়ী, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও জনগণকে ঋণ হিসেবে প্রদান করে৷ এসব ঋণের উপর ব্যাংক নির্দিষ্ট হারে সুদ বা মুনাফা চার্জ করে থাকে৷ বিভিন্ন রকম জামানতের বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ ও অগ্রিম জমাতিরিক্ত ও নগদ ঋণ প্রদান করে থাকে৷ অবশ্য ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রে জামানতহীন ঋণ প্রদান করে থাকে৷ এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে মূলধনজনিত সমস্যা দূর হয়ে থাকে৷

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

৩) Creation of medium of exchange (বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি)
ব্যাংকিং ইতিহাসের প্রথম দিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নোট প্রচলন করতে পারলেও বর্তমানে এ দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে৷ কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংক চেক, হুন্ডি, বন্ড, ঋণপত্র, সিকিউরিটিজ, ড্রাফট, পে-অর্ডার ইত্যাদি বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি করে থাকে৷ এর ফলে লেনদেন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে গতিশীলতা সৃষ্টি হয়৷ যা ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিবাচক হিসেবে কাজ করে থাকে৷

৪) Transfer of money (অর্থের স্থানান্তর)
বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে এক স্থান হতে অন্য স্থানে সহজে ও নিরাপদে অর্থ স্থানান্তরের সুযোগ দিয়ে থাকে৷ এমনকি ব্যবসায়ীদের টাকা এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর করে থাকে৷ এক্ষেত্রে অবশ্য উক্ত ব্যাংকগুলোর শাখা ও তাদের প্রতিনিধি এই সকল কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে৷ এ ধরনের কার্যক্রম দ্বারা ব্যবসায়ীদের আর্থিক ঝুঁকি থেকে চিন্তা মুক্ত করে৷

৫) Representation (প্রতিনিধিত্ব)
বাণিজ্যিক ব্যাংক আমদানিকারক ও রপ্তানীকারকদের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ, বিদেশে পণ্যের বাজার সৃষ্টি, বৈদেশিক পাওনা নিষ্পত্তি, বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে৷ এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত হয়৷

৬) Development of agriculture (কৃষি উন্নয়ন)
বাণিজ্যিক ব্যাংক কৃষি উন্নয়নের জন্য কৃষকদের বিভিন্ন প্রকার ঋণ প্রদান করে থাকে৷ যেমন- খাদ্যশস্য ঋণ, অর্থকরী ফসল ঋণ, ফলের বাগানের জন্য ঋণ, গুদামজাতকরণের জন্য ঋণ, পল্লী ঘর-বাড়ি তৈরির জন্য ঋণ, খামার প্রকল্প ঋণ, ক্ষুদ্র হস্তচালিত শিল্প ঋণ, উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঋণ ইত্যাদি৷ এতে একটি দেশের কৃষি ক্ষেত্রে উন্নতি হয়৷ ফলে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়৷

৭) Development of industry (শিল্প উন্নয়ন)
বাণিজ্যিক ব্যাংক শিল্প উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে৷ এই ব্যাংক শিল্পে দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদী মূলধন সরবরাহ, বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ, পণ্য বাজারজাতকরণ, পণ্যের মান উন্নয়ন, শিল্পকে আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণসহ শিল্প উন্নয়নের জন্য নানাভাবে সাহায্য ও সহায়তা করে থাকে৷

৮) Helping international trade (আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সহায়তা)
বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তথা পণ্য দ্রব্য আমদানি-রপ্তানিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে৷ বৈদেশিক বাণিজ্যের সকল কাগজপত্র বাণিজ্যিক ব্যাংক এর সাহায্যে আদান প্রদান করা হয় এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক আমদানিকারকের প্রত্যয়পত্র ইস্যু করে থাকে৷ বর্তমানে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে ব্যাংকের সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্য একেবারেই অচল৷ এ সকল সহযোগিতামূলক কার্যাবলী বাণিজ্যিক ব্যাংক করে থাকে৷

৯) Settlement of payment (দেনা-পাওনার নিষ্পত্তি)
বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবসায়ীদের পক্ষ হয়ে বিভিন্ন রকম লেনদেন করে থাকে৷ এ সকল ব্যাংক ব্যবসায়ীদের পক্ষ হয়ে প্রদেয় বিল, বেতন, ঋণের সুদ, বীমা প্রিমিয়াম, ভাড়া ইত্যাদি পরিশোধ করে থাকে৷ আবার ব্যবসায়ীদের পক্ষ হয়ে বেতন, বিনিয়োগের সুদ বা লভ্যাংশ, প্রাপ্য বিল, চেক, পেনশন ইত্যাদি বাবদ অর্থ আদায় করে থাকে৷ এসব কার্যাবলী উন্নত অর্থনীতির পরিচায়ক হয়ে থাকে৷

১০) Discount bill of exchange (বিনিময় বিল বাট্টাকরণ)
একজন ব্যবসায়ী অন্য একজন ব্যবসায়ী থেকে ধারে মাল ক্রয় করলে নগদ অর্থের পরিবর্তে বিনিময় বিল দিয়ে থাকে৷ ফলে উক্ত ব্যবসায়ী (বিক্রেতা) মেয়াদের পূর্বে তার টাকা আদায় করতে পারে না৷ কিন্তু বিক্রেতার আর্থিক সংকটের সময় ব্যাংক মেয়াদ পূর্তির পূর্বে তার বিল বাট্টাকরণ করে নগদ অর্থ সরবরাহ করে থাকে৷ ফলে বিক্রেতার আর্থিক সংকট দূরীভূত হয়৷ এ ধরনের কার্যাবলী ব্যবসা-বাণিজ্যকে গতিশীল করে৷

১১) Incorrect to savings (সঞ্চয়ের আগ্রহ সৃষ্টি)
বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানত কারীকে তার আমানতের উপর সুদ বা মুনাফা প্রদান করে থাকে৷ এর সুদ বা মুনাফা আমানতকারীর একটি নিশ্চিত আয়৷ এ ধরনের আয়ের ক্ষেত্রে আমানতকারীর আমানতি টাকার যেমন ঝুঁকি নেই তেমনি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় আসতেই থাকে৷ ফলে আমানতকারীরা বেশি করে অর্থ সঞ্চয় করতে এবং সঞ্চিত অর্থ ব্যাংকে জমা রাখতে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে৷

১২) Employment (কর্মসংস্থান)
বর্তমানের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পুরণার্থে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দেশে-বিদেশে শাখা স্থাপনের মাধ্যমে তার কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে৷ আর এই ব্যাংকের কার্যাবলী বা কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য প্রচুর লোক প্রয়োজন হয়৷ ফলে বানিজ্যিক ব্যাংক বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়ে তাদের জীবন যাত্রার মান উন্নত করছে৷ এর ফলে দেশের বেকারত্ব সমস্যা কিছুটা হলেও হ্রাস পাচ্ছে৷

১৩) Helps in credit control (ঋণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা)
বাণিজ্যিক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত ঋণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে৷ এতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়৷ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদের হার হ্রাস-বৃদ্ধি করে, খোলা বাজারে শেয়ার এবং সিকিউরিটিজ ক্রয় বিক্রয় করে, ঋণদান করে, ঋণের অর্থ সংগ্রহ করে৷

১৪) Profitable investment (লাভজনক বিনিয়োগ)
প্রাপ্ত আমানত বাণিজ্যিক ব্যাংক সব সময় ব্যাংকে রেখে দেয় না৷ এর থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে থাকে৷ এতে উক্ত খাতগুলো উন্নত হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত করে থাকে৷

১৫) Regional development (আঞ্চলিক উন্নয়ন)
বাণিজ্যিক ব্যাংক মূলধনের গতিশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অঞ্চল ভিত্তিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে থাকে৷ উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে ঘাটতি অঞ্চলে বিনিয়োগকে স্থানান্তরের মাধ্যমে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করে৷ যা একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য৷

১৬) Implementation of financial plan (আর্থিক নীতি বাস্তবায়ন)
বাণিজ্যিক ব্যাংক সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক নীতি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে৷ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে জনগণের সরাসরি সম্পর্ক থাকে না৷ তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময়ই বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাহায্যে তার আর্থিক নীতি বাস্তবায়ন করে থাকে৷

১৭) Increase standard of living (জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন)
বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের আয়, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে৷ ফলে মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ে৷ সর্বোপরি জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটে থাকে৷

পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, একটি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাণিজ্যিক ব্যাংকের অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়৷ আর এই অবস্থানের জন্যই অধ্যাপক সেয়ার্স যথার্থই বলেছেন- Banks are not merely traders in money, But also important manufacturer of money.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button