অর্থনীতি

দারিদ্র্য বিমোচন প্রচেষ্টাকে কীভাবে আরো শক্তিশালী করা যায়?

শামেরান আবেদঃ ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের সংখ্যা (বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে যাদের প্রতিদিনের আয় ১ দশমিক ৯০ ডলারের কম) ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন থেকে কমে ৬৪৮ মিলিয়ন হয়েছিল। কভিড-১৯ এ অগ্রগতি অনেকটাই উল্টে দিয়েছে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ মহামারীটি ১৫০ মিলিয়ন লোককে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেবে।

এমনকি কভিড-১৯ শুরুর আগে থেকেই আগামী দশকের মধ্যে বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণভাবে চরম দারিদ্র্য দূরীকরণের সঠিক পথে আমরা অগ্রসর হচ্ছিলাম না। মহামারী শুরুর বেশ আগে থেকেই দারিদ্র্য বিমোচন পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে দেখা যায়। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ প্রতি বছর বৈশ্বিক দারিদ্র্যের মাত্রা কমেছে অর্ধেকেরও কম শতাংশ হারে। এ অবস্থায় এমনকি কভিড-১৯ পরিস্থিতি না এলেও ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৫৩৭ মিলিয়ন লোক চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যেই অবস্থান করত, যা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, বিশেষ করে এসডিজি-১ শর্ত পূরণের ব্যর্থতাকেই বোঝায়।

গ্লোবাল সাউথের অন্যতম নেতৃত্বাধীন এনজিও ব্র্যাক কয়েক দশক ধরে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমের নকশা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, পরামর্শ প্রদান ও দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আমাদের একটি ধারণা প্রদান করেছে যে কীভাবে কাজ করলে দারিদ্র্য দূরীকরণ কার্যক্রম ও নীতিগুলো আরো অধিকতর ফলপ্রসূ হতে পারে।

প্রথমত, কর্মসূচিগুলো চরম দরিদ্রদের কাছে পৌঁছে দেয়া জরুরি। যারা চরম দরিদ্রাবস্থার মধ্যে থাকে, তারা স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক কার্যক্রম ও পরিষেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। কেননা তাদের অনেকেরই ব্যাংক হিসাব, স্থায়ী ঠিকানা কিংবা আনুষ্ঠানিক পরিচয়পত্র নেই—এর সবই নিবন্ধনের সময় প্রয়োজন হতে পারে। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অনেক সময় তারা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রায়ই সরকারি কর্মসূচি সম্পর্কিত তথ্যগুলো তারা পায় না, যদিও কর্মসূচিগুলো তাদের জন্যই নেয়া হয়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

নিম্ন আয়ের দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচের দিকে বসবাসকারীদের ৭৯ শতাংশই কখনো কোনো সামাজিক সহায়তা পায় না। তাই যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সাহায্যগুলো তাদের কাছেই পৌঁছে দিতে হবে। সরকার ও তার অংশীজনদের অবশ্যই এমন নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করা চাই, যার মাধ্যমে সরকারি সাহায্য প্রাপ্তির বাধাগুলো দূর করে চরম দরিদ্রদের সামাজিক সুরক্ষাজালে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিস্থাপকতা তৈরিতে কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে অবশ্যই চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারীদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শুধু মৌলিক চাহিদা পূরণ নয়, সরকার এবং তার অংশীজনদের এক্ষেত্রে অবশ্যই করণীয় রয়েছে অনেক কিছু। পুনরায় দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়া থেকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে তাদের সক্ষমতা বাড়াতেও বিনিয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে সংকটের সময় এ পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সম্প্রতি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে ফিলিপাইনের সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ব্র্যাকে কর্মরত আমাদের দলটি এ সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছে। কার্যক্রমটি মহামারী চলাকালীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে নগদ সাহায্য আর স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা প্রদান কর্মসূচির সঙ্গে সংযুক্ত করে। একই সঙ্গে তাদের বিভিন্ন কাজে দক্ষ করে গড়ে তুলতে ও উপার্জনক্ষম করতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে দেয়। ফলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ৭৬ শতাংশ কঠোর লকডাউনের মধ্যেও নিজেদের উপার্জনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সফল হয়।

তৃতীয়ত, কর্মসূচির অধীনে দারিদ্র্যকে বহুমুখী ও সুনির্দিষ্ট করে বিবেচনা করা জরুরি। চরম দারিদ্র্য বহুমাত্রিক। সুপেয় পানিপ্রাপ্তির দুষ্প্রাপ্যতা, বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়া, অপুষ্টি আর সামাজিকভাবে বাদ পড়া থেকে শুরু করে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসরতদের বঞ্চনার ক্ষেত্রগুলো যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। এসব বঞ্চনা ও তা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম ও কর্মসূচিগুলো জনসংখ্যা আর ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে ভিন্ন হয়। নির্দিষ্ট অবস্থান এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে সরকার ও তাদের অংশীদারদের সামগ্রিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে, যা দরিদ্র মানুষদের অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম করে।

চতুর্থত, কর্মসূচিগুলোর সঙ্গে অবশ্যই স্থানীর সরকার ও সম্প্রদায়গুলোকে সম্পৃক্ত করতে হবে। কেননা তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম ঘিরে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতাকে আরো ভালোভাবে প্রতিফলিত ও স্থানীয় সমস্যাগুলো ভালোভাবে চিহ্নিত করে। এ প্রক্রিয়ায় সুশীল সমাজকে যুক্ত করার মাধ্যমে সরকারকে আরো গঠনমূলক জবাবদিহিতার মুখোমুখি করার পাশাপাশি অধিক কার্যকর কর্মসূচি ও নীতি প্রণয়নের বিষয়গুলোয়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার ও তার অংশীদারদের এলাকার প্রান্তিক পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করতে এবং তাদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তিতে সহায়তা করতে পারে স্থানীয় সরকারগুলো।

পঞ্চমত, সরকার ও তার অংশীজনদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে কোনটি কাজ করছে এবং কোনটি নয়, তারপর সেই অনুযায়ী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির প্রভাব বাড়াতে সরকার ও তার অন্যান্য অংশীজনের অবশ্যই কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন এবং তা থেকে শিক্ষা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তারপর প্রয়োজন অনুসারে তা সংশোধন করতে হবে।

এ ধরনের মূল্যায়ন শুরু করা উচিত ড্রাইভিং প্রোগ্রামগুলোর নকশা চিহ্নিত করার মাধ্যমে। মূলনীতিগুলোর আলোকে কর্মসূচির উপাদানগুলো যাচাই-বাছাই ও নিরীক্ষা করতে হবে এবং এর ফলাফলও সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কেবল প্রমাণভিত্তিক অভিযোজনের মাধ্যমে সরকার ও তার অংশীদাররা নিশ্চিত হতে পারবে যে তাদের গৃহীত কর্মসূচিগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিদ্যমান এবং এগুলো তার দেশের মানুষের বিশেষ ও বিকশিত চাহিদা পূরণের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ।

সর্বোপরি, এটাকে একটি সহায়ক প্রচেষ্টা হতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো যদি এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম ও নীতিগুলো আরো বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক, অভিযোজিত ও ব্যাপক হতে পারে। যতক্ষণ না এ মানুষগুলো তাদের গার্হস্থ্য খরচ মেটানোর জন্য স্বাধীনভাবে পর্যাপ্ত সম্পদ উপার্জন করতে পারছে ততক্ষণ সরকারগুলোর উচিত সুশীল সমাজ ও গবেষক ছাড়াও বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান আর দাতা দেশসহ উন্নয়ন অনুঘটকদের সম্পৃক্ত করা। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের অনেক দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের বিপরীতে বৃহৎ আকারের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য শুধু বাজেট বরাদ্দ ও রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার অভাব রয়েছে।

লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে টেকসই অগ্রগতি ও পুষ্টি চাহিদা মেটানো পর্যন্ত টেকসই উন্নয়নের অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে এসডিজির ১ নম্বর লক্ষ্যটি গভীরভাবে সম্পর্কিত। তবে কভিড-১৯ এ ক্ষেত্রগুলোর কয়েক দশকের অর্জিত অগ্রগতিকে উল্টে দিয়েছে। পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের তাই বিকল্প বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা একই সঙ্গে উন্নয়নের একাধিক ক্ষেত্রকে সমর্থন করে। বহুসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বাদ পড়া থেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে আমাদের অবশ্যই দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমগুলোয় প্রয়োজনীয় আর্থিক সমর্থন দানের বিষয়টিকে নিশ্চিত করার পাশাপাশি এ কর্মসূচিগুলোকে আরো বেশি ব্যাপক ও কার্যকরভাবে পরিচালনা করা।

আরও দেখুন:
◾ ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরও বাড়লো
◾ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পণ্যের মূল্য অগ্রিম নিতে পারবে না
◾ ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]
শামেরান আবেদ: নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল
ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button