ব্যাংকার

ব্যাংকারদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক?

একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ: প্রায়োগিক অর্থনীতিতে খরচ পছন্দ তত্ত্ব (The Cost Preference Hypothesis) একটি জনপ্রিয় অধ্যায়। অনেকের মধ্যে অর্থনীতিবিদ Edward এবং Heggested ১৯৭৩ সালে এবং Heggested এবং Mingo ১৯৭৬ সালে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহে বিশেষত মুনাফার উপড়ে উক্ত খরচ পছন্দ তত্ত্বের প্রভাব নিয়ে বিস্তর প্রায়োগিক গবেষণা করেন। প্রায়োগিক অর্থনীতির অনেক ছাত্রের কাছেই The Edward-Heggested-Mingo Theory একটি সুপরিচিত নাম।

খরচ পছন্দ তত্ত্ব অনুযায়ী সরল সিদ্ধান্ত এই যে, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা বেশি বেশি খরচ করতে পছন্দ করে। সে খরচ অবশ্য বিভিন্ন নামেই হতে পারে। হোক সে ব্যবস্থাপকদের উচ্চ বেতন, ভাতা, বোনাস, বাড়ি, গাড়ি সংশ্লিষ্ট দৃশ্যমান খরচ অথবা অনেক অদৃশ্যমান বা পরোক্ষ খরচ। যুগের পরিক্রমায় নামে বেনামে অনেক খরচের খাত যোগ হলেও সব খরচই প্রয়োজনীয় কিনা তা অবশ্য ভেবে দেখার বিষয়। অভিজাত হোটেলে কর্মশালার আয়োজন থেকে শুরু করে অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ আর পাঁচ তারকা হোটেলে ইফতারি আয়োজন কোনটা যে প্রয়োজনীয় আর কোনটা অপ্রয়োজন তা সংশ্লিষ্টরা ভাববেন বৈকি।

বাংলাদেশে ব্যাংকারদের বেতন কমানো এবং সুযোগ সুবিধা স্থগিত করণ শিরোনামে সম্প্রতি একটি খবর বেশ আলোচনা এবং সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ব্যাঙ্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বলা হয়ে থাকে, ব্যাঙ্ক হচ্ছে অর্থনীতির চালিকা শক্তি। যেভাবেই বলি না কেন অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেক অবদান রাখে। তবে বুঝতে হবে ব্যাঙ্ক, ব্যাংকিং এবং ব্যাংকার একই সমিকরনে বিভিন্ন উপাদান। এদের প্রতিটা উপাদানের নিজস্ব লক্ষ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। এখানে ব্যাংকার বলতে মূলত নিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে বুঝায় যারা ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানটিকে পরিচালনা করে।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

The Edward-Heggested-Mingo Theory অনুযায়ী ব্যাংকারদের পিছনে ব্যাঙ্কের খরচ এবং ঐ ব্যাঙ্কের মুনাফা সমগতিক। অর্থাৎ, অন্যান্য কিছু অপরিবর্তিত থাকা অবস্থায়, যে ব্যাঙ্কের ব্যাংকারদের পিছনে খরচ বেশি, সেই ব্যাঙ্কের মুনাফাও বেশি। উক্ত খরচ পছন্দ তত্ত্বের যথেষ্ট যৌক্তিক ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। ব্যাঙ্কের পরিচালনার দায়িত্ব যেহেতু ব্যাঙ্কারদের হাতেই, তাই একটি তুষ্ট ব্যবস্থাপনা অবশ্যই নিশ্চিত করা জরুরি। সময়ে সময়ে তাই ব্যাঙ্কের মালিকপক্ষ ব্যাংকারদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাদি বিবেচনা করে থাকে, মূলত সুবিধাদি বৃদ্ধি করতেই শোনা যায় বেশি, সুবিধাদি হ্রাস, স্থগিত বা বন্ধের কথা খুব কমই শোনা গেছে বা আলোচিত হয়েছে। বেতনভাতা বা অন্যান্য সুবিধাদি কমানো বা স্থগিত অবশ্য মালিকপক্ষের একটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত যা অন্যান্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যও প্রযোজ্য।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

যে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে ব্যাংকারদের বেতনভাতা কমানো এবং ক্ষেত্র বিশেষ- এ স্থগিত করা হয়েছে তা যথেষ্ট আলোচনার দাবি রাখে। বলা হচ্ছে করোনা মহামারীর কারণে ব্যবসা বাণিজ্যের মন্দা পরিস্থিতি যা কিনা অনেক দিন ব্যাপ্ত হতে পারে। ধারনাটি অমূলক নয়। মানুষের নগদ অর্থের অভাব, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক অবস্থা সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান বা ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই সুখকর নয়। ব্যাংকিং ব্যবসাও অন্যান্য ব্যাবসা থেকে মৌলিক ভাবেই ভিন্ন। এই ব্যবসায় মালিকপক্ষ যে মূলধন সরবরাহ করে তা প্রতিষ্ঠানের মোট সম্পদের তুলনায় খুবই নগণ্য। ব্যাঙ্ক মূলত তাঁর ঋণদানের জন্য আমানতের উপর সবিশেষ নির্ভরশীল। তাই নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখে এবং মুনাফার উপর ধার্যকৃত ট্যাক্স হারও তুলনামূলক বেশি।

ব্যাংকাররা এসব সুবিধা অসুবিধা মেনে নিয়েই ব্যবসা করেন। দেখা যায় ব্যাংকিং ব্যবসায় ব্যাংকারদের পরিশ্রম কোনভাবেই কম নয়। ব্যাংকার সামাজিকভাবে একটি মর্যাদার পেশা। অনেকে ভেবে থাকেন ব্যাংকাররা যে পারিশ্রমিক পান তা দেশ বা সমাজের গড় সুবিধাদি থেকে বেশিই বটে। কিন্তু পেশার ভিন্নতা এবং চ্যালেঞ্জের কারণে এটাকে স্বাভাবিকই মনে হয়।

ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারীদের একটি প্রস্তুত বাজার (Ready Market) থাকে। তারা আগে থেকেই অনুমান করতে পারে কতটুকু উৎপাদন করবে এবং উৎপাদন ব্যয় কোথা থেকে আসবে। কিন্তু ব্যাংকাররা সেবার বাজার সৃষ্টি করে থাকেন। বিশেষত বাংলাদেশের মত আর্থসামাজিক বাস্তবতায় এদেশের সাধারণ মানুষের ভিতর ব্যাংকিং আচরণ (Banking Habit) খুব বেশি আশা ব্যাঞ্জক নয়। ব্যাংকাররা তাদের বুঝিয়ে আমানত সংগ্রহ করেন আবার সেই আমানতের সদ্বব্যাবহার অর্থাৎ ঋণদান করেন। কাজটি রেডি মার্কেট এর চেয়ে ঢের চ্যালেঞ্জিং। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমানত সংগ্রহ এবং ঋণদানের ক্ষেত্র বেশ সঙ্কুচিত হয়েছে বলে তাদের মুনাফার মুল উৎসে টান পরেছে।

অন্যদিকে আমদানি রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে অন্যান্য খাত (Off-Balance Sheet) থেকে অর্জিত আয়ও কমে যাওয়া স্বাভাবিক। নানাবিধ কারণে কোন কোন ব্যাঙ্কের মালিকপক্ষ ব্যয়সঙ্কচন নীতি অনুযায়ী তাদের উচ্চ বেতনের ব্যবস্থাপকদের বেতন কমানো ও অন্যান্যদের সুবিধাদি স্থগিত এর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

খরচ পছন্দ তত্ত্ব অনুযায়ী খরুচে ম্যানেজার প্রতিষ্ঠানের জন্য ভাল। এই ধরনের ম্যানেজার পরিশ্রম ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগ করে শুধু নিজের উচ্চ বেতন ভাতাই নিশ্চিত করেনা, বরঞ্চ প্রতিষ্ঠানের উচ্চ মুনাফায় অধিক অবদান রাখে।

গবেষণায় দেখা গেছে খরচের পাশাপাশি আরেকটি উপাদান ব্যাঙ্কের মুনাফা অর্জনে সমগতিক ভূমিকা রাখে আর তা হল মালিকপক্ষের সরবরাহকৃত মূলধন। অর্থাৎ মূলধন ও ঐ ব্যবসার মুনাফার ভিতর ধনাত্মক সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রায়োগিক গবেষণায় (বাংলাদেশের তথ্য সহ) প্রকাশ, কোন ব্যাঙ্কের মূলধন ১০০ টাকা বাড়লে মুনাফা বাড়ে ১৩ টাকার সমান। অন্যদিকে ব্যাংকারদের পিছনে খরচ ১০০ টাকা কমালে ঐ ব্যাঙ্কের মুনাফা কমে ৩২ টাকার মত।

তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যায় ব্যাঙ্ক মালিকদের জন্য প্রথম বিকল্পটি অধিক লাভজনক। মাত্র ১০০ টাকা অতিরিক্ত মূলধনের বদৌলতে ১৩ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা। সেখানে দ্বিতীয় বিকল্প বেশ ব্যয়বহুল। ১০০ টাকা খরচ বাঁচাতে গিয়ে ৩২ টাকার লোকসানের মুখে পড়া। মনে হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তিপক্ষ প্রথম বিকল্পের চেয়ে দ্বিতীয় টিকে সহজতর মনে করছেন। কিন্তু মুনাফা যদি উদ্দেশ্য হয় তবে ব্যাংকার তথা কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা ও সুবিধাদি কমানো বা স্থগিত কোন সহজ সমাধান নয়।

বিভিন্ন ব্যাংকার তথা কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতনভাতা ও সুবিধাদি কমানো বা স্থগিতের ফলাফল সুদূরপ্রসারী হবে বলেই প্রতীয়মান হয়। যে করোনা মহামারির কথা বলা হচ্ছে, সেখানে অন্য অনেক পেশার সাথে সন্মুখসারি থেকে সেবা দিয়েছে আমাদের ব্যাংকাররা। নিজের জীবন ও পরিবারের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখেও তারা সেবাদানে পিছপা হয় নাই। উক্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে অনেক পেশার মত ব্যাংকারদেরও জীবন মান হুমকির মুখে পরবে সে প্রসঙ্গ সবারই জানা। সবচেয়ে বড় কথা হল, পরিতুষ্ট ব্যবস্থাপনার ওভাবে ব্যাঙ্কের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হতে পারে। অসন্তুষ্ট ব্যবস্থাপনা আজকে দুর্দিনের পাশাপাশি সুদিনেও তাদের সর্বচ্চ সামর্থ্য প্রয়োগ নাও কড়তে পারে। তখন দীর্ঘমেয়াদে ব্যাঙ্কগুলোর মুনাফা বিনষ্ট হতে পারে।

ব্যাঙ্কের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতনভাতা কমানো, স্থগিত বা বন্ধের মত সহজ সমাধানে পৌছার আগে অন্যান্য বিকল্প বা বিকল্পসমূহের কথা ভেবে দেখা যেতে পারত।

লেখকঃ শহীদুল জাহীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button