নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ

মামুন রশীদঃ থাইল্যান্ড, ভারত, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা এমনকি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রেও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ বিতরণ এবং নতুন ধরনের অর্থায়নে ভালো ভূমিকা রেখেছে। অটো লোন, হাউজিং লোন এমনকি ব্যক্তি ঋণের ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানগুলো বরং অনেক এগিয়ে। অথচ বাংলাদেশে ৩৬টি অনুমোদিত ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ৩০টিরই পারফরম্যান্স গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নেই। গুটিকতক প্রতিষ্ঠান ভালো করলেও খাতটি মোটেও গোছানো নয়। এমনকি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বা খাত থেকে অনেক অনেক পিছিয়ে। তাদের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ঋণ পরিচালক ও তাদের বন্ধুবান্ধবের মাঝে বিতরণ বা ইনসাইডার ল্যান্ডিং, দুর্বল সম্পদ ব্যবস্থাপনা, মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি ব্যবহার, অদক্ষ মানবসম্পদ, অভ্যন্তরীণ সুশাসন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ নজরদারির অভাবের অভিযোগ রয়েছে।

পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, একটি নামকরা ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এফডিআর রেখে মেয়াদপূর্তির অনেক পরও টাকা ফেরত পাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৭ কোটি টাকা আটকে আছে। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের প্রায় ১০৯ কোটি টাকা আটকে রেখেছে এই ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। এই তহবিলের আটটি এফডিআরের মেয়াদপূর্তি হয় ২০১৯ ও ২০২০ সালে। নানা উপায়ে চেষ্টা করেও আমানত ফেরত নিতে পারছে না তারা। এক সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানে ৩০০ কোটি টাকা রেখে আটকে গেছে আরেক সরকারি জ্বালানি প্রতিষ্ঠান। বারবার তাগাদার পরও জমানো টাকা তুলতে পারছে না। এই ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীদের মধ্যে আবার কিছু ব্যাংকও রয়েছে।

আরও দেখুন:
ব্যাংক কি বা ব্যাংক কাকে বলে?
বাণিজ্যিক ব্যাংকের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা
ব্যাংকিং কি বা ব্যাংকিং কাকে বলে?

আর্থিক খাতের নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের একসময়কার নিয়ন্ত্রণে থাকা পিপলস লিজিং, বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্সসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারার বিষয়টি প্রায় সবার জানা। ২০১৪ সালে দখলের পর এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি অনুসন্ধান করছে দুদক। এর বাইরে আরো অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও সময়মতো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। বিশেষ করে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক কিংবা আরেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা আটকে যাওয়ায় আর্থিক খাতে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এতে করে ৮ থেকে ১২ শতাংশ সুদ প্রদানের আকর্ষণ সত্ত্বেও সাধারণ আমানতকারীদের মতো করপোরেটগুলোও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে চাইছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে অনেক অভিযোগ এসেছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পুরো ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের অবস্থার অবনতি বেশ আগে থেকে হলেও এত খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগের পর। এর কিছুদিনের মধ্যে চার প্রতিষ্ঠান থেকে পিকে হালদারের টাকা তুলে নিয়ে পালানোর বিষয়টি সামনে আসে। এরপর বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাধারণ আমানতকারীর মতো ব্যাংক এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর একযোগে টাকা তোলার চাপ তৈরি হয়। তখন বেশকিছু প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে তা জানাজানি হয়ে যায়। অধিকাংশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নতুন করে তহবিল জোগান বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা জানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট তহবিলের ৬০ শতাংশের মতো আসে ব্যাংক থেকে।

সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের ক্ষেত্রে কাদের এসব প্রতিষ্ঠান দেয়া হচ্ছে, তারা চালাতে পারবেন কিনা তা ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। আবার অনুমোদনের পর এসব প্রতিষ্ঠান ঠিকভাবে তদারকও করা হয়নি, নামে-বেনামে বেশির ভাগ ঋণ গিয়েছে পরিচালক এবং তাদের আত্মীয়-পরিজনদের কাছে। যে কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে আমানতকারী আর টাকা তুলতে পারছেন না।

পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন প্রক্রিয়ার দুই বছর পার হলেও এখনো কোনো আমানতকারী টাকা ফেরত পাননি। প্রতিষ্ঠানটিতে ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা আমানতের মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ের আমানত রয়েছে সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা। পিপলস লিজিংয়ে জীবনের শেষ সম্বল জমা রেখে আর ফেরত পাচ্ছেন না—এমনদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, ব্যবসায়ী এমনকি ব্যাংক কর্মকর্তারাও রয়েছেন। জানা গেছে, তাদের অনেকেই এ প্রতিষ্ঠানে তিন মাস ও ছয় মাস মেয়াদি আমানত রাখেন। কেউ কেউ বেশ আগে থেকে এ অর্থ ফেরত বা তুলে নেয়ার চেষ্টা করলেও ফেরত না দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগ দেখাচ্ছেন।

টাকা ফেরত না দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তহবিল জোগান বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানেই একবারে টাকা তুলে নেওয়ায় বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে তাদের ঋণের বেশির ভাগ দীর্ঘমেয়াদি বা খেলাপি। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে বড় অংকের তহবিল সময়মতো ফেরত দেয়া যাচ্ছে না।

জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় এক জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালে এক সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানে তিন মাস মেয়াদি ৫০০ কোটি টাকার আমানত রাখে। দীর্ঘদিনেও মূল টাকা ফেরত না পেয়ে বারবার নবায়ন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন চেষ্টার মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা ফেরত পেলেও বাকি ৩০০ কোটি টাকা এখনো পায়নি। দ্রুত টাকা ফেরত চেয়ে গত ২৫ আগস্ট আবার চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। একই প্রতিষ্ঠানে এক হাজার ৫০ কোটি টাকা আছে এক বৃহৎ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের। আসল টাকা ফেরত না পেয়ে বাধ্য হয়ে বছরের পর বছর পুনর্বিনিয়োগ করছে ব্যাংকটি। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানে এ তহবিল রাখার শুরু ২০১৬ সালের মে মাসে।

শুধু যে তাদের কাছে অন্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের টাকা আটকে আছে, তা নয়। তাদেরও অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে আর ফেরত পাচ্ছেন না। অর্থ আদায়ে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাষ্ট্রীয় এই বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি জানার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর সম্প্রতি সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করে আপাতত মামলা না করার অনুরোধ জানান। এর আগে একাধিক ব্যাংক টাকা তুলতে না পেরে মামলার উদ্যোগ নেয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকার্স সভায় মামলা না করে সমঝোতার ভিত্তিতে অর্থ আদায়ের জন্য বলেছেন।

ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখা অন্যায় নয়। যদিও কতটুকু ঠিক, তা নিয়ে কথা উঠতে পারে। এমনকি আমানত রাখার আগে পর্যালোচনার দায়িত্ব ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানেরও রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখার ক্ষেত্রে এখন প্রায় সব ব্যাংকই অনেক সতর্কতা দেখাচ্ছে। ঋণ বা আমানতকৃত টাকা ফেরত নেয়ারও চেষ্টা করছে। একবারে এই চাপ তৈরি না হলে হয়তো এমন অবস্থা হতো না। এ সমস্যার সমাধানে অনেকেই বলছেন বাংলাদেশ ব্যাংক একটা পরিকল্পনা নিতে পারে।

সম্প্রতি আমানত ফেরত নিয়ে সমস্যা ছাড়াও পরিচালকদের অন্যায় হস্তক্ষেপ, দুর্বল ঋণ সম্পদ, দক্ষ জনবলের অভাব, ন্যূনতম প্রযুক্তি ব্যবহারেও অনীহা এমনকি অনেক বেনামি ঋণের অভিযোগ রয়েছে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে এমনকি তাদের তদারকির দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত বিভাগের বিরুদ্ধেও উচ্চ আদালতের রায়ে অনেক অনেক দুর্নীতি এবং অদক্ষতার প্রমাণ উঠে এসেছে।

আগেই বলেছি, বিরাট অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে এ খাতটি ঘিরে। অপেক্ষাকৃত আকর্ষণীয় হারে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা না রেখে আমানতকারীরা ছুটছেন পুঁজিবাজারের দুর্বল শেয়ারের দিকে। এখন তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিতকরণ, দক্ষ জনবল নিয়োগ, পরিচালকদের অন্যায় হস্তক্ষেপ বন্ধ, উন্নত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার এবং প্রতিনিয়ত নজরদারির ওপর জোর দেয়ার বিকল্প নেই।

লেখকঃ মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button