ব্যাংকার

ব্যাংকিং ও সামাজিক দূরত্বে কল্পিত কাহিনী

ভাবনা কি আর সত্যের দ্বার খোঁজে। জনাকীর্ণ রাস্তা আজ জনশূন্য, প্রয়োজনের তাগিদে হয়তো দু-একজন অগোছালোভাবে সীমাবদ্ধতার দ্বার খোঁজে। কেউ হয়তো নিজের আবর্তেই নিজেকে ঢেকে রাখে, আবার কেউ হয়তো সাহিত্যিক ভাবনায় নিয়োজিত রেখে কাব্যিক রূপ ধারণ করে ঘরে বসে বসে সময় পার করেন। ব্যাংকের চিত্র এক্ষেত্রে জনাকীর্ণের আবরণেই ঢাকা থাকে বলা চলে।

সময় পেলে মাঝে মাঝে হাঁটার অনুভব করি। বিশেষ করে অফিস থেকে ফেরার পথে ৩৬-৩৯ মিনিটের রাস্তা মাঝে মাঝে হেঁটে আসি। আজও হেঁটেই যাচ্ছি তবে বাসা থেকে ব্যাংকের উদ্দেশ্যে। কিন্তু; চারদিকের নিস্তব্ধতার দরুণ আগের মতো হাঁটার মাঝে কোন আনন্দ ফিরে আসে না। অতিব্যস্ত শহরটাও আজ কেমন যেন ব্যস্ততার ঘ্রাণ নিতে নিজ ঘরের বাইরে কেউ বের হয়ে আসে না। সবাই নিজেকে সামলিয়ে নিতে ব্যতিব্যস্ত। মনে হয় সৃষ্টির স্থিতিশীলতা কোন এক ধাপে অবনমিত হয়েছে। শহরের মাঝে কিছু রিক্সা হয়তো টাকার যোজন-বিয়োজনে সামিল হতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এছাড়া অন্য কোন বাহনের দেখা পাওয়া ভার।

তবে যে কয়জন মানুষের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায় উনাদের বেশিরভাগই যে আমার মতই ব্যাংকার হাঁটার গতিবিধিতে বুঝে নিয়েছি। তাই হয়তো জনার্দন দা বলতেন, দেখিস ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিস, এক পা ব্যাংকের দিকে এগুতে চাইলেও অন্য পা অকারণে পিছনে টেনে রাখতে চাইবে। ব্যাংকারদের সরল উদাস চাহনি যেন আজ সেটাই জানান দিচ্ছে।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

হয়তো সৃষ্টির বিলাসীতা নেই বলেই সেবার বিপরীতে কোন বাসনা স্থায়িত্বে অপারগতা বিদ্যমান। তাই, ভাবনার জগতে প্রবেশ করতেও কেমন যেন মনটা আঁটসাঁট হয়ে আসে। ভাবি, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এই মুহূর্তে প্রতিদিন ব্যাংক খোলা রাখাটা দায়বদ্ধতারই প্রতিশ্রুতি। ভাবনার অগোচরে স্থবির হয়ে আসে সমস্ত দিনের গতিময়তা।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

প্রথম দিন থেকেই একটি শাখার সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং সার্ভিস দেবার নিমিত্তে শাখা চালু রাখা হয়। Social Distancing কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে তিন ফুট দূরত্ব বিবেচনায় গোল দাগ চিহ্নিত করা হয়। সচেতনতা হিসেবে শাখার সামনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা হয়। হাত ধোয়ার তাবেদারী করতে গেলেও অনেকেই মানতে নারাজ! তারপরও নিরাশ না হয়ে হাত ধৌত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। মাঝে মাঝে ভেবেছি সেবাটাতো এখানেই প্রীত হয়ে আসে। কারো প্রীত্যর্থেই তো সেবার মোক্ষ উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। কিন্তু দয়ায় কি আর গুরু দাক্ষিণ্য মিলে?

যাই হোক, Social Distancing- ব্যাংকে মানার মত কয়জন গ্রাহক পাওয়া যাবে। আমার শাখায় যেটুকু জায়গা আছে তাতে অপর্যাপ্ততার সীমারেখায়ই যে বিদ্ধ করে রাখে। ওখানে দুজন করে ভেতরে ঢুকালে আসল কাজটুকু সিদ্ধ হবে এটুকু শুধুই আমার মনের কাল্পনিক দৃঢ়তা। তিনটি গোল দাগ টেনে দেই কিন্তু তিনটি গোলদাগের জন্য ভেতরে অন্য একজন প্রবেশের ব্যঘাত ঘটবে। শেষতক তিনটির বদলে দুটি দাগ টেনে দেই। এভাবে সারি হিসেবে লাইন প্রস্তুত করতে গেলে মানুষের লাইন শাখার গেইট পার হয়ে বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত ঠেকবে। আমার দায়িত্ব শাখা পর্যন্ত হলে বাকিটুকুর দায়িত্বে কে থাকবে? গোলমাল, হৈ-চৈ বেঁধে যেতে পারে।

কে বলে গ্রাহদের মাঝে আতঙ্কের ছাপ আছে? লাইনে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে কুশল বিনিময়ও করা হচ্ছে করমর্দনের মাধ্যমে! মনে পড়ে, যে লোকটি আগের দিন চার হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দিতে এসেছে পরের দিন পাঁচ হাজার টাকার জন্য চেক প্রদান করেছে। স্বস্তির নি:শ্বাস এমনিতেই দূরে চলে যায়। আচমকা হয়ে তাকিয়ে থাকি গ্রাহকের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে। সেবামুলক প্রতিষ্ঠান বলে কথা।

হঠাৎ করে কোন এক অপরিচিত মহিলা চেয়ার সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। উনার হাঁটার গতিবেগ দেখে মনে হয়েছিল কোন আত্মীয় এই ব্যাংকে হয়তো চাকরি করে। শেষে জানতে পারি, এক হাজার টাকার ডিপিএস খুলতে এসেছেন। সাথে নমিনী হিসেবে এক ভদ্র মহিলা এবং অভিভাবক হিসেবে উনার ভাই। হিসাব খুলবেন উনার ভাইপোর নামে! চোখ ছানাবড়া! নাবালকের হিসাব খুলতে তো তিনজনকে লাগবেই। একজন বেশি এসেছেন তাতে উনাদের দোষ কোথায়! দোষ তো সময়ের।

জটলা পাকানো কিছু মানুষ প্রতিদিনই ব্যাংকে এসে লেনদেন করে। আগে কখনো এদের আনাগোনা এত বেশি পরিলক্ষিত হয়নি। প্রতিদিনের লেনদেন সঞ্চালনই নাকি তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাদের কাছে ক্যাপিটালিজমের একটা স্বতন্ত্র নীতি কাজ করে। তাদের ভাষায়, কোন ব্যবসায়ী যখন ঘরে বসে অলস সময় পার করে তখন তাদের ব্যবসাটা চাঙ্গা হয়ে উঠে। আবার প্রতিদিনের অভ্যাসবশত তাদের লেনদেনের সামারী নাকি ঠিক রাখতেই হয়। কি কতশত কথা! আমার ভেতরে এত কিছু প্রবেশ করে না। কোনভাবে চেকটি ডেবিট করে দিতে পারলেই বাঁচি।

তার উপর অনলাইন চেকের আনাগোনা। বেচারা কোনভাবে না হয় একটি চেক ড্র করলো, কিন্তু হিসাব নম্বর ভুল! কি করে তাকে টাকা পরিশোধ করবো কোন আইন খুঁজে পেলাম না। অতি স্বযতনে চেকটি ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, হিসাব নম্বরটি ভুল। ভদ্রলোকটি কোন কথা না বলে চলে গেল। হঠাৎ করে কিছুক্ষণ পর এসেই আমাকে উনার কান থেকে ফোনটি দিয়ে বলল, আলাপ করুন।

দ্বিধান্বিত হয়ে ফোনটি না নিয়ে বললাম আপনার সমস্যা আমাকে আগে বলেন। ফোন নিয়ে উনি হয়তো আমার চেয়ে সর্বোচ্চ এক ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেবার বলে কয়ে কোনভাবে উনার গতির লাগাম টেনেছিলাম! উনার গতিবিধি লক্ষ্য করে আঁচ করতে পেরেছিলাম, টাকার উচাটনে সামাজিক দূরত্ব মানব সভ্যতা থেকে অনেক আগেই শূন্যে ভেসে গেছে।

ক্লান্তির অবসাদে শরীরটা ছেয়ে গেছে। তাই দু মিনিটের জন্য চোখ দুটি বুজে নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্য রাখার ব্যর্থ প্রয়াস। চোখ দুটি খোলতেই দেখি বার-তেরো জন ডেস্কের সামনে একসাথে ঠেলে শাখায় প্রবেশ করে! ভাবি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র।

শুনেছি শহরটাকে বাঁচাতে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তবে, গ্রাহকদের আনাগোনা ব্যাংকে তেমন একটা কমতির দিকে নেই। চাহিদা বেড়েই চলেছে। হয়তো আরো বাড়বে। ব্যাপার না, সবকিছু কোনভাবে সামলে নিলেই হলো। কিন্তু ধৈর্য্যের বাঁধ কি আর আটকে থাকে? ভ্রু কুচকে বার বার বলি দূরত্ব বজায় রাখাটাই জরুরী।

তাদের চাহনি দেখে মনে হয় আমার কথাটি একপেশে হয়ে গেল। ব্যাংকিং কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে এভাবেই প্রতিদিন কতসকল ঘটনা ঘটে থাকে। যেন সামাজিক দূরত্ব কিছু মানুষের নিকট বৈকল্যে রূপান্তরিত হয়ে আছে! যাই হোক, দিনশেষে অফিস থেকে বাসায় ফেরার স্পন্দনটুকু অনুভব করি। বাসা যাওয়ার রাস্তায় ছোট জটলা দেখে মাঝে মাঝে ভাবি, সামাজিক দূরত্ব যে এখানে টিকিবে না মশাই!

বাসায় গেলেও সেই চিন্তার ভাঁজটুকু থেকেই যায়। মনে শিহরণ জাগিয়ে তুলে গ্রাহদের Social Distancing কিংবা সামাজিক দূরত্ব মানিয়ে নেয়ার অপারগতা। এবার নিজেকে নিয়েও একটু চিন্তার আঁচর কাটি। হৃদ্যতার সংস্পর্শে থেকে ভাবাবেগে নিজেকে আর এতটুকু সংবরণ করতে পারি না! তারপরও শান্তি খুঁজে ফিরি বাসার একটি রুমের মাঝে নিজেকে বন্দিদশায় খুঁজে। ক্লান্তিতে মনটা ছেয়ে গেছে বলেই হাতে ফোনটি নিয়েও আপনজনদের খোঁজ খবর না নিয়েই বিছানায় ঘুমোতে যাই। চিন্তিত হয়ে মনের বিষণ্নতাকে দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা।

আমি আবার দিবা স্বপ্ন দেখতেও পারঙ্গম বটে। যাকে অনেকটা Somnambulist বলেও ভাবাতুর হৃদয়ে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে! তাই এক কাল্পনিক সীমানায় এসে একটা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নের মাঝেও একটা আশ্চর্য়ের ছোঁয়া থাকে। যদিও তত্ত্বগত দিক দিয়ে আমি একটু ভাবাতুর। স্বপ্নে চলে আসি অন্য একটি দেশে। ওই দেশের এক গ্রাহক Social Distancing- মান্য করতে ব্যাংক থেকে তাবেদারী করায় কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দায়ের করেন।

ভাগ্যিস; আধো আধো ঘুমটুকু ভেঙ্গে গিয়েছিলো! স্বস্তির নি:শ্বাসটুকু একটু জোরেই ফেলি। আস্তে আস্তে ঘুম থেকে জেগে ভাবি, বাঁচা গেল তবে। তাই, অনজন রায়ের ভাষায় বলতেই পারি-
হে শাশ্বতী, মোর প্রিয়ংবদা!
হবে নাকো উন্মাদ, রুখিবে নাকো রুদ্ধ দ্বার ঘরে
সীমাবদ্ধতার মাঝেও অসীমের আওয়াজ তুলে।।

পেছনে ফিরে বলি, বিকশিত জীবনের আরও একটি বছর চলে গেল। চাওয়া হবে, নতুন বছরের আগমনী বার্তায় যেন কাউকে আর অজানা আতঙ্কে গ্রাস না করে। আবারো প্রাণের স্পন্দনটুকু ফিরে আসবে অসীম উচ্ছ্বাসে যেখানে এসে ধরণীতল এক হয়ে যাবে। হয়তো পৃথিবী জেগে উঠবে নবরূপে, নতুন উচ্ছ্বাসে। মেনে চলবে সবাই Social Distancing বা সামাজিক দূরত্ব। ভাল থাকুক সবাই নববর্ষের নতুন আঙিনায়।

অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক। প্রিন্সিপাল অফিসার, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, বন্দর বাজার শাখা, সিলেট। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button