ব্যাংকব্যাংকিং

ব্যাংকের সাথেই ব্যাংকিং করুন

ব্যাংক খাতের কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারির কথা আমরা প্রায়ই শুনি। আছে সমালোচনাও। বিচ্ছিন্ন কিছু অনিয়ম-দুর্নীতির খবরও চাউর হয় প্রায়ই। এসব কেলেঙ্কারি, অনিয়ম-দুর্নীতি অসমর্থনযোগ্য, তবে অবাস্তব নয়; কারণ যেখানে গুড় যেখানে মিষ্টতার মোহে কিছু পিঁপড়ার আনাগোনা থাকবেই। কিন্তু তবুও ব্যাংকই মানুষের অর্থের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। কয়েকদিন আগেই দেখলাম, একটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে নয় লাখ টাকা জালিয়াতি হয়েছে। কিন্তু এজন্য একজন আমানতকারীকেও কি এক টাকার মাশুল গুনতে হয়েছে? না, এ অর্থ ব্যাংক তার নিজস্ব আয় থেকেই সংস্থান করেছেন বা করবেন। গ্রাহকদের যাতে কোনো আর্থিক ক্ষতি বা স্বার্থ ক্ষুন্ন না হয়, এটা প্রত্যেক ব্যাংকেরই অগ্রাধিকার। কারণ ব্যাংকের সবচেয়ে বড় পুঁজি হচ্ছে তার গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাস।

বর্তমানের নেটি জগতে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের প্রবেশ ও ব্যবহার সহজলভ্য হওয়ার কারণে প্রায় প্রতিটি মানুষই এক একজন সাংবাদিক। একজন ব্যাংকারের যে কোনো কথা, আচরণ ও বডি ল্যাংগুয়েজ নিজের অজান্তেই কোনো না কোনো গ্রাহকের মোবাইলে অডিও বা ভিডিও আকারে রেকর্ডেড হয়ে যেতে পারে। ব্যাংকারের গ্রাহক হয়রানিমূলক কোনো আচরণ কিংবা একটি অতি সাধারণ ভুল বা যে কোনো অন্যায় মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যেতে পারে একজন গ্রাহকের একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে।

এ ধরনের নেতিবাচক প্রচারসংশ্লিষ্ট ব্যাংকারকে যতটুকু না হেনস্তায় ফেলে, তার চেয়ে বেশি দুর্নাম ছড়িয়ে দেয় তার ব্যাংক তথা পুরো ব্যাংক খাতেরই। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বর্তমান প্রজন্মের ব্যাংকারকে তার গ্রাহকদের সেবাপ্রদান করতে হয়। তাই ব্যাংকারকে সেবামুখী এবং গ্রাহকবান্ধব হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ব্যাংকগুলোও আর্থিক সেবার আওতা বৃদ্ধি, সেবার মান, দ্রুততা ও গ্রাহকের হিসাবের অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিদ্র জোরদারকরণে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা বাড়াতে এবং কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে।

কিন্তু এরপরও অনেকেই ব্যাংকমুখী নন। দেশে বর্তমানে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা ৫৯টি, অ-তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা পাঁচটি। নতুন আরও একাধিক ব্যাংক অনুমোদনের অপেক্ষায়। এসব ব্যাংকের একের পর এক শাখা সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এজেন্ট ও উপ-শাখার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামগঞ্জের মানুষের দোরগোড়ায়। কিন্তু বিআইবিএমের ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য মতে, দেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষের এখনও কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই! দেশের মানুষের এ ব্যাংকবিমুখতা বা ব্যাংকিং অজ্ঞতা কি কেবলই ব্যাংকের কেলেঙ্কারি ও নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে?

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

আমি চাকরি করি প্রথম প্রজন্মের সবচেয়ে পুরোনো ও বৃহৎ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর একটিতে। কিন্তু মাঝেমধ্যে কিছু গ্রাহক এ ব্যাংক সম্পর্কেও জানতে চান, ‘ব্যাংকটি কখনও আমার টাকা নিয়ে ভেগে যাবে না তো?’ সচেতনতার প্রশ্নে গ্রাহকের এমন জিজ্ঞাসাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু অবাক লাগে, এই গ্রাহকদেরই কেউ কেউ যখন নামের শেষে ‘ব্যাংক’ শব্দযুক্ত কিছু অবৈধ বা অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানে বা মাসে লাখে দুই হাজার বা তিন বছরে দ্বিগুণ টাকা প্রদানের প্রলোভন দেখানো কিছু অখ্যাত-অজানা হায় হায় কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে অতি মুনাফার আশায়।

সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, নারায়ণগঞ্জে নিবন্ধিত একটি সংস্থা নিজেদের নামের শেষে ‘ব্যাংক’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে রাজশাহীতে শাখা খুলে চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম। এখানে গ্রাহকরাই লোভে পড়েননি, লোভে পড়েছেন ওখানে যারা কর্মকর্তা (নকল ব্যাংকার) হিসেবে চাকরি করছেন তারাও। তারা চাকরি পাওয়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন ওই প্রতিষ্ঠানকে। যদিও ওইসব কর্মকর্তাদের দেওয়া বক্তব্য মতে, তারা তাদের টাকা সেখানে এফডিআর হিসেবে আমানত রেখেছেন এবং সেই আমানতকে ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করে তার সুদ আয় থেকে নিজেদের বেতন নিচ্ছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, (প্রকৃত) ব্যাংকিং ব্যবসা কি এতই সহজ ও নিয়ন্ত্রণহীন? এত সহজ আর অনিয়ন্ত্রিতই যদি হবে তাহলে সরকার প্রায় অর্ধশতাধিক বিভাগের সুবৃহৎ পরিসর নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ এক নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দায়িত্বে রাখতেন না। ব্যাংকিং এত সহজ নয়। হায় হায় কোম্পানি চালানো সহজ। কারণ বোকা এবং লোভী

মানুষদের নিয়েই এদের ব্যবসা; আর বোকা ও লোভী মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের ফাঁদে ফেলা যায় খুব সহজে। আর তাই এসব প্রতিষ্ঠান হঠাৎ আসে, হঠাৎ নাই; মাঝখানে নির্বোধ আর অতিলোভী কিছু মানুষের কোটি কোটি টাকা ‘নাই’ হয়ে যায়!

আইন অনুযায়ী ব্যাংক ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহ করতে পারে না। সমবায় সমিতি কেবল সদস্যদের অর্থ জমা রাখতে পারে। অর্থাৎ কোনো সমবায় সমিতি সদস্যদের চাঁদা গ্রহণ ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অবৈধভাবে আমানত গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু আমরা দেখি, সমবায় সমিতি হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে শত শত প্রতিষ্ঠান। কোনো সমবায় সমিতি নিজের নামের শেষে ‘ব্যাংক’ শব্দটি ব্যবহার করতে না পারার বিধান থাকলেও কেউ কেউ নিজেদের নামের শেষে ‘ব্যাংক’ শব্দ জুড়ে দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করে দিব্যি ব্যাংকিং ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে ফাঁদ পাতছে, আর মুনাফালোভী ও বোকা শ্রেণির কিছু মানুষ এসব ফাঁদে পা দিচ্ছে।

যার ফলে যুবক, ইউনিপে টু ইউ, ডেসটিনির মতো ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দিয়েছে। কিন্তু এতসবের পরেও মানুষের চোখ খুলে না, টনক নড়ে না। তাই আমার বর্তমান কর্মস্থলের কাছে হঠাৎ অফিস খুলে বসা অখ্যাত-অজানা এক সংস্থার নাম নিয়ে পরিচিত এক কোটিপতি নারী গ্রাহক আমাকে বললেন, বাজারে নাকি আরেকটি ‘ব্যাংক’ এসেছে? আমার বাজারে আরেকটি ব্যাংক, কিন্তু আমি জানি না! জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাংক? ‘এসটিসি ব্যাংক’, পুরো নাম ‘স্মল ট্রেডার্স কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড’। পাঠকের মনে থাকতে পারে, নারায়ণগঞ্জ পেরিয়ে রাজশাহীতে অফিস খুলে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া যে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিবেদন করেছিল এটি সেই ‘এসটিসি ব্যাংক’!

এদেশে ভালো-মন্দ, বৈধ-অবৈধ বিবেচনা না করে নামের পেছনে অনেক মানুষ ছুটে চলে। তাই জানি, এখানেও একশ্রেণির মানুষ টাকা রাখবে সহজে কোটিপতি না হয় লাখপতি হওয়ার লিপ্সায়। কয়েকজন হয়তো অল্প সময়ে কিছু টাকা কামাবেনও, যারা পরবর্তীতে ধরাশায়ী হতে আগুয়ান মানুষগুলোর জন্য টোপ হিসেবে কাজ করবে। কিছুদিন পর সব হারিয়ে নিঃস্ব মানুষগুলো যখন হায় হায় করবে তখনও হয়তো আরও অনেক টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়া এটি নিয়ে প্রতিবেদন করবে। কিন্তু অন্ধ মানুষগুলোর চোখ তখনও খুলবে না; বরং এরপরও কেউ কেউ আবারও সেখানে যাবে, না হয় ভিন্ন নামের এমনি কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নিজের শেষ সম্বল হারাবেন।

কিন্তু এরপরও এসব মানুষ বোঝতে সমর্থ হবে না, ব্যাংক অনেক নিয়মতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। আমরা ব্যাংকারই জানেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যাংক খাতকে জনসেবায় নিবেদিত করতে কত কী-ই না করে যাচ্ছে। গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণে তাদের আছে ‘ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস’ বিভাগ। গ্রাহক তার হয়রানির যে কোনো অভিযোগ সহজেই জানাতে পারেন এই বিভাগে ১৬২৩৬ নম্বরে ফোন করে। প্রতিকারও পান খুব ত্বরিত। ব্যাংকের সেবার মানেও বহুমাত্রিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিনিয়ত নতুনত্ব যোগ করে যাছে ব্যাংকিং সেবা ও প্রযুক্তিতে। এরপরও ব্যাংক খাতের কত সমালোচনা!

অথচ চেনা নেই, জানা নেই, নামের পাশে ‘ব্যাংক’ শব্দ যোগ করে অফিস খুলে বসে ব্যাংক বনে যাওয়া সর্বনাশা প্রতিষ্ঠানে মানুষকে আস্থা রাখতে দেখা যায়। কিন্তু যখন এসব প্রতারক আস্তানা গাড়ে তখন ওইসব এলাকার সচেতন আর শিক্ষিত কেউ কি থাকেন না তাৎক্ষণিকভাবে এসব অননুমোদিত ব্যবসার অবৈধ কার্যক্রম যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাতে; কী-ইবা করে ওখানকার স্থানীয় প্রশাসন? টনক নড়ে ঠিকই, কিন্তু সেটা সময় হারিয়ে নড়ে; ততক্ষণে বোকা আর অতি লোভী মানুষগুলোর কোটি কোটি টাকা তছরুপ হয়ে যায়।

ভারতীয় বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলতে হয়, ‘জাগোন গ্রাহক জাগোন’! ব্যাংকের সঙ্গেই ব্যাংকিং করুন। প্রতারণার হাতছানি থেকে নিজের অর্থকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন। নামে ব্যাংক কিন্তু অনুমোদন সমবায় অধিদপ্তরের, এমন মুখোশধারী প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংক ভেবে ভুল করবেন না। একইভাবে কাল্পনিক মুনাফার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হায় হায় কোম্পানিগুলো থেকেও সজাগ থাকুন। ব্যাংকের কিছু অনিয়ম-দুর্নীতি আছে এটা যতটা না সত্যি, তার চেয়ে বড় সত্যিÑব্যাংকের মতো নিয়ন্ত্রিত আর্থিক খাত বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। এছাড়া দেশের আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী ব্যাংক খাতে একাধিক লাগাম পরানো আছে।

যেমন- ব্যাংকিং ব্যবসার জন্য কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন লাগে। আমানতকারীদের আমানতের সুরক্ষাকল্পে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে তাদের মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের পাঁচ শতাংশ দৈনিক গড় ভিত্তিতে সিআরআর ও এবং দৈনিক গড় ভিত্তিতে ১৩ শতাংশ হারে (শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের জন্য সাড়ে পাঁচ শতাংশ) এসএলআর সংরক্ষণ করে। একইভাবে ব্যাংকের আয়ের একটি বড় অংশ রিজার্ভ রাখতে হয় ঋণের প্রভিশন হিসেবে, যা টাকার অঙ্কে অনেক ব্যাংকের জন্যই প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা।

আমানতকারীদের টাকা বিনিয়োগ করেই ব্যাংক ব্যবসা করে। তাই আমানতদার থেকে শুরু করে বিনিয়োগ গ্রহণকারী সবাই ব্যাংকের কাছে রাজাতুল্য গুরুত্ব ও সম্মান পেয়ে থাকে। তাই আপনার মনে হতেই পারে, আপনি বোধহয় কেবল ব্যাংকের প্রয়োজনেই ব্যাংকে আসছেন এবং ব্যাংকের সেবা নিয়ে ব্যাংককে নিজের মহানুভবতা দেখাচ্ছেন। কিন্তু প্রিয় পাঠক, শুধু টাকা জমা রাখতে বা ঋণ পেতেই ব্যাংক নয়; আপনার জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে ব্যাংক ও ব্যাংকিং। চাইলেই আজকাল আপনি ব্যাংকিংকে উপেক্ষা করে যেতে পারবেন না। আপনার জীবন ও জীবিকার অনেক কাজের অংশীদার হিসেবে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে ব্যাংক ও ব্যাংকিং। টাকা জমা রাখা বা ঋণ নেওয়া ছাড়াও অনেক প্রয়োজনেই ব্যাংক আপনার অদ্বিতীয় বিকল্প। অনেক প্রয়োজনেই ব্যাংক ছাড়া আপনার চলবে না, যেমন-

এক. ব্যাংক আপনার নিজের গচ্ছিত অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রীর নিরাপত্তা দিয়ে আপনাকে নিশ্চিন্ত রাখে;
দুই. আপনার অলস অর্থকে ব্যাংকে বিনিয়োজিত করে আপনার নিজের মতো নিজের অর্থকেও উপার্জনক্ষম করে তুলতে পারেন;
তিন. নিয়মিত ব্যাংকিং লেনদেন আপনার আর্থিক পরিচয়ের সনদ;
চার. যে কোনো প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির ব্যবসায়িক ডিলারশিপ অর্জনে ব্যাংক আপনার সহায়ক পার্টনার হিসাবে কাজ করে;
পাঁচ. ব্যবসায়িক ঋণ ও গৃহনির্মাণ ঋণসহ যে কোনো ঋণ প্রাপ্তিতে ব্যাংকের সঙ্গে সুদীর্ঘ লেনদেনের ইতিহাস নিয়ামক ভূমিকা পালন করে;
ছয়. অ-ব্যাংক অনেক প্রতিষ্ঠানে রাখা আমানত, যেমন সরকারি সঞ্চয়পত্রের বিপরীতেও জরুরি মুহূর্তে ঋণ সুবিধা পাবেন না; কিন্তু ব্যাংকে জমাকৃত আপনার আমানতের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ টাকা সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে তাৎক্ষণিক ঋণ নিতে পারেন কোনো বিশেষ কাগজপত্র ছাড়াই;
সাত. কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মাইক্রো ফিন্যান্স ইনস্টিটিউশন থেকে ঋণ নিতে গেলেও আপনার ব্যাংক হিসাব থাকা চাই;
আট. ব্যাংকের মাসিক সঞ্চয়ী স্কিমে রাখা আমানতে (বার্ষিক ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত) নির্দিষ্ট হারে কর রেয়াত পাবেন;

নয়. বিমার বোনাস বা দাবি পেতে গেলেও আপনার নামে ব্যাংক হিসাব লাগবে;
দশ. ঠিকাদারি করতে চাইলে টেন্ডার ডকুমেন্টসের সঙ্গে ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট জমা না দিলে ঠিকাদারের দরপত্র বাতিল হয়ে যাবে। বর্তমানে ই-টেন্ডারিংয়ে ই-জিপি সুবিধা পেতে ব্যাংকে আপনাকে আসতেই হবে। ব্যাংকের বিড বন্ড ও পারফরম্যান্স গ্যারান্টি ছাড়া ঠিকাদারি পেশায় আপনি অচল;
এগার. আপনি যদি ব্যবসায়ী হোন, আপনার পক্ষে ব্যাংক গ্যারান্টি থাকলে জায়ান্ট কোম্পানিগুলো আপনাকে কোটি কোটি টাকার পণ্য বাকিতে দিতে দ্বিধা করবে না;
বার. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তথা আমদানি-রফতানি ব্যাংকের সহায়তায় ঋণপত্র (এলসি) খোলা ছাড়া অসম্ভব;
তের. হাজারো মাইল দূরে থাকা আপনার স্বজনের কষ্টার্জিত প্রবাসী রেমিট্যান্স দেশে আপনার হাতে সযতেœ পৌঁছে দিচ্ছে ব্যাংক। এছাড়া অনেক বিদেশি নিয়োগদাতা কর্তৃক প্রবাসীদের বেতন প্রদানের পূর্বশর্তই থাকে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংকে খুলা প্রবাসীর অ্যাকাউন্ট নম্বর;
চৌদ্দ. এখন প্রায় সব করপোরেট প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মীদের বেতন দিচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে;
পনের. বিভিন্ন অনুদান, বৃত্তি, প্রবাসীদের ডেথ বেনিফিট ইত্যাদিও চেক তথা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই পরিশোধ করা হয়;
ষোল. আপনার সন্তানকে স্টুডেন্ট ভিসায় দেশের বাইরে পাঠাবেনÑমোটা স্থিতিসম্পন্ন ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও ব্যাংক সনদ লাগবে;
সতের. উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরের দেশের ভিসা পেতেও ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ আবেদন করতে হবে;
আঠারো. সরকারি ইউটিলিটি (বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, টেলিফোন) বিল দিতে হবে ব্যাংকের মাধ্যমেই;

উনিশ. মোটরযান রেজিস্ট্রেশন, ভূমি রেজিস্ট্রেশন, আয়কর প্রদানসহ সরকারি সেবাসংক্রান্ত ফি ও মাশুল পরিশোধ করতে হবে ব্যাংকের মাধ্যমেই;
বিশ. বিদেশে গেছেন, পকেটে ডলার নেই, কিন্তু ব্যাংকের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডটি সঙ্গে থাকলে আপনার খরচের চিন্তা নেই;
একুশ. টাকা ব্যাংকে না রেখে ঘরে অলস রাখলে ভাই, বন্ধু ও কাছের পরিচিতজনরা যখন-তখন ধার চাইবে। ধার না দিলে সম্পর্ক নষ্ট হবে, শত্রুতা বাড়বে। চুরি-ডাকাতির ভয় তো আছেই। তাই কী দরকার কাছের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির। টাকা ব্যাংকে রাখুন, কেউ জানবে না এবং টাকা ধার দেওয়া নিয়ে কাছের জনদের কাছে আপনাকে কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না;
বাইশ. ব্যাংকে রাখা আপনার আমানতের এক লাখ টাকা পর্যন্ত ‘আমানত বিমা’র আওতায় সুরক্ষিত। অন্যদিকে ব্যাংকের প্রতিটি শাখার ভল্টে রক্ষিত টাকাও বিমাকৃত;
তেইশ. সরকারের ডিজিটালাইজেশনের অংশ হিসেবে ক্যাশলেস ইকোনমি তৈরিতে ব্যাংকিং চ্যানেলে আর্থিক লেনদেনকে বাধ্যতামূলক করার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে মোবাইলে ব্যাংকিং ও নগদ লেনদেনের সর্বোচ্চ সীমা ১০ হাজার টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক);
চব্বিশ. সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের বেতন, পেনশন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অনেক নাগরিক সেবায় ব্যাংকের বিকল্প নেই;
পঁচিশ. ব্যাংকের অপারেটিং প্রফিটের ৪০ শতাংশ এবং গ্রাহকের হিসাব থেকে আদায় করা আয়কর, ভ্যাট এবং আবগারি শুল্ক বাবদ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের মাধ্যমেই সরকারি কোষাগারে গিয়ে জাতীয় উন্নয়নে অপরিসীম ভূমিকা রেখে যাচ্ছে প্রতি বছরই।

পাঠক, এবার উপসংহারে যাই। আপনার হাতের কোটি টাকার কানাকড়িও দাম নেই যদি না তা হাত বদল হয়। কারণ হাত বদল না হওয়া পর্যন্ত অর্থের বিনিময় মূল্য সৃষ্টি হয় না। আর অর্থের এ হাত বদলকে সম্ভব ও সহজ করেছে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা। একবার ভেবে দেখুন, আপনার ঢাকার কোনো ফ্ল্যাট বিক্রি করে পাওয়া পঞ্চাশ লাখ টাকা নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আপনার বাড়িতে নিয়ে যেতে আপনার মানসিক দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি কেমন হবে, ব্যাংক ছাড়া অন্য কী ব্যবস্থায়ই বা আপনি এতগুলো টাকা নিয়ে যাবেন। কিন্তু ব্যাংক আপনার দুশ্চিন্তা মুছে দিয়ে আপনাকে দিচ্ছে নির্ভরতা, বিশ্বস্ততা, নিরাপত্তা এবং একইসঙ্গে অর্থের উপার্জন ও গোপনীয়তা দুই-ই। তাই অর্থ ও ব্যাংক যেন একে অপরের সমার্থক ও পরিপূরক এবং অর্থসংক্রান্ত সবকিছুতেই ব্যাংকিং অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য। তাই আর্থিক লেনদেনে ব্যাংকেই ভরসা রাখুন, ব্যাংকিং চ্যানেলে আসুন।

লেখকঃ মোশারফ হোসেন: ব্যাংক কর্মকর্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button