ব্যাংকার

চাকরিচ্যুত ব্যাংকারঃ কোভিডকালীন সময় ও আশার দোলাচল

অন্জন কুমার রায়ঃ আমার চাকরী জীবন শুরুই হয়েছিল বেসরকারী ব্যাংকে যোগদানের মধ্য দিয়ে। যদিও ব্যাংকিং সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা ছিল না। যোগদান করতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। সেখানে সুন্দর একটি ওরিয়েন্টশন প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়। জীবনের প্রথম চাকরী এবং চাকচিক্য পরিবেশ, সব মিলিয়ে আনন্দের কমতি ছিল না। কিন্তু; হোঁচট খেয়েছিলাম, যখনি দেখতে পেলাম ওরিয়েন্টশন শেষে আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা হাতে ধরিয়ে দেয়। অথচ, আমানত বা ডিপোজিট কি তখনো ভাল করে বুঝে উঠতে পারিনি! সবে মাত্র যোগদান করায় প্রতিষ্ঠানটিকে আমি মনের মধ্যে ধারণ করতে পারিনি কিংবা ভালবাসতে শিখিনি। সেখানে এমন খাপ ছাড়া আমানতের লক্ষ্যমাত্রা দেখে কিছুটা বিমর্ষ হলাম। প্রতিষ্ঠানটিতে সেবা দেওয়ার সুযোগই পেলাম না কিংবা প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে মনের মাঝে ভালবাসার জায়গাও তৈরি হয়নি অথচ আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা! চাকরির প্রথমেই এমন তিক্ত বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমাকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়।

একজন কর্মীকে প্রতিষ্ঠান থেকে নির্ধারিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতার মিশেলে গড়ে তুলা হয়। সে হিসেবে কর্মীরা একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। কিন্তু, ব্যাংকারদের অনেক সময় যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই ডেস্কে বসানো হয়। তারপরও একজন ব্যাংকার মনেপ্রাণে সর্বোচ্চ সেবা দেবার মনোভাব পোষণ করে। কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকিং সেবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একনিষ্ঠভাবে কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত থাকে। হোক সেটা নিচু স্তরের কর্মী কিংবা উপরের স্তরে যে কেউ। সেজন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমুহে সেবার মান সমুন্নত বজায় আছে। অন্যান্য সেবামুলক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এখানেই ব্যাংকের আলাদা স্বকীয়তা!

আরও দেখুন:
ব্যাংকাররাই ব্যাংকারদের ক্ষতি করছে
ব্যাংকারদের লেন‌দেন সময় ও টা‌র্গেট ক‌মা‌নো উচিত
ব্যাংকার হতে চান? আরেকবার ভাবুন

২০২০ সালের প্রথম দিক থেকে করোনা মহামারী প্রাদুর্ভাবে তাবৎ বিশ্ব শঙ্কিত ছিল। মহামারীর দরুণ ব্যবসায়ে মন্দাভাব দেখা দেয়। যার নেতিবাচক প্রভাব গোটা ব্যাংকিং দুনিয়ায় অব্যাহত থাকে। সে সময়েও ব্যাংকাররা ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকিং সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখে। বস্তুত, করোনা মহামারী সময়কালীন সময়ে ব্যাংকিং সেবার ব্যাপ্তি অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক কঠিন ছিল। তা সত্ত্বেও উল্লেখ করার মতো ফরেন রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আমাদের দেশে এসেছে। বলতে গেলে করোনাকালীন কঠিন সময়ে ব্যাংকাররা ফ্রন্ট লাইনার হিসেবে নিবেদিত ছিল। করোনা আক্রান্ত রোগী যে ব্যাংকে সেবা নিতে আসেনি তা বলা মুশকিল। না হলে কি আর কোন এক করোনা আক্রান্ত রোগী ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে ব্যবস্থাপকের কক্ষে যেয়ে বলে, “স্যার খাস দিলে দোয়া কইরেন”! এভাবেই ব্যাংকাররা নিরবে সেবা দিয়ে দু:সময়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

যাই হোক, আমানতের লক্ষ্যমাত্রা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমানতের লক্ষ্যমাত্রাকে ঘিরে ব্যাংকে অনেকের চাকরি এখন নড়বড়ে অবস্থানে আছে। সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও কোভিডকালীন সময়ে শুধুমাত্র লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না করা বা অদক্ষতার অজুহাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ও চাকরি থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পদত্যাগ করার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। ব্যাপারটা যেমন আমাদের জন্য সুখকর নয় তেমনি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিবেচনা প্রসুত নয়। যারা কঠিন সময়ে করোনার ঝুঁকি মোকাবেলা করে দেশের সাধারণ জনগণকে সেবা প্রদান করেছে তাদেরকে চাকরিচ্যুত করা অপ্রত্যাশিত।

চারিদিকে যখন করোনার অশনি শঙ্কেত, দু:সময়ের থাবা, লকডাউনে দেশ অচল, ব্যবসার কোন পরিস্থিতি নেই সে সময় ব্যাংকিং খাতেও দু:সময় বিরাজ করেছে। অথচ, করোনার কারণে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক যে বিপুল পরিমাণ আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করে তা ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে সেবা দিতে গিয়ে অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন যাদের অনেকেই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। তারপরও ব্যাংকাররা নিজ নিজ অধিক্ষেত্র থেকে যথাসাধ্য চেষ্টার পরও অনেকে লক্ষমাত্রা পুরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এতদিন প্রতিষ্ঠানকে ভাল কিছু দিতে পারলেও করোনার কারণে হয়তো সেটা সম্ভব হয়ে উঠেনি, তাতেই চাকরিচ্যুত। তাদের এতদিনের শ্রম সবই বিফলে গেল! অথচ, প্রতিদিনকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্রমে গড়া প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে তাদের অসামান্য অবদান রয়েছে।

কিন্তু, আজ তাদেরকেই প্রতিষ্ঠানটির বোঝা স্বরূপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কয়েকদিনেই তাদের শ্রম নি:শেষ হয়ে গেল। বর্তমানে তাদেরকে করোনাকালীন সময়ের চেয়েও শঙ্কিত সময় পাড়ি দিতে হচ্ছে। অথচ, জীবনের ছোট ছোট প্রত্যাশাগুলি তাদের মাঝেও উঁকি দিত। চাকরি চলে যাওয়ার কারণে জীবন সংগ্রামে তাদেরকে যেন নতুন করে ভাবতে শিখায়। এর ফলে শুধু চাকরিচ্যুত কর্মীর উপর প্রভাব ফেলবে না বরং তাদের সাথে জড়িত পুরো পরিবারের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিদ্যমান থাকবে। এমনিতে করোনাকালীন সময়ে সরকারি-বেসরকারি সহ প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে নিয়োগ প্রায় বন্ধ ছিল। এ কঠিনতম সময়ে তাদের চাকরিচ্যুত করা মানে দেশের বেকারত্বের বোঝা আরো বাড়িয়ে দেয়া। যার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থার উপর বিদ্যমান থাকবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে একটি পরিপত্র জারি করে। বলা হয় ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও ও চাকরিচ্যুত হয়েছে কিংবা চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে, তাদেরকে (আবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে) বিধি অনুযায়ী চাকরিতে বহাল করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বর্তমান সময়ে চাকরির বাজারে সবাই চাকরির নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা চায়। চাকরি ক্ষেত্রে নিরাপত্তা জনিত শৃঙ্খল বিঘ্নিত হলে অনিশ্চয়তা দেখা দিবে এবং পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং চাকরিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রা কমে আসবে। যা ভবিষ্যত চাকরিক্ষেত্রে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব বিদ্যমান থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন একটি উদ্যোগ প্রশংসনীয় যা চাকরিচ্যুত হওয়া কর্মীদের নতুনভাবে আশা জাগাবে। আশা করি, এ ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ভবিষ্যতে না ঘটার সম্ভাবনা থাকবে এবং সবাই চাকরি ক্ষেত্রে নিরাপদ চাকরির নিশ্চয়তা নিয়ে পুর্ণোদ্যমে কাজ করতে পারবে।

লেখকঃ অন্জন কুমার রায়, ব্যাংকার ও কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button