ডিজিটাল ব্যাংকিং, নমিনী গুরুত্ব এবং কেস স্টাডি
দিনু প্রামানিকঃ ব্যাংকে চাকুরীর সুবাদে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নমীনি ও নমীনির গুরুত্ব নিয়ে কিছু কেইস স্ট্যাডির আলোকে এবং বর্তমান ডিজিটাল ব্যাংকিং সম্পর্কে আলোচনা করছি। এএমএলডি সার্কূলার অনুযায়ী প্রত্যেকটা পুরানো হিসাব আপডেট করার ধারাবাহিকতায় ২০০৮ ইং সালে কয়েকটা পুরানো হিসাব ফরম হালনাগাদ করার দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। সেই ফরমগুলি মধ্যে প্রথম হিসাবধারীর ফরমে উল্লেখিত টেলিফোন নাম্বারে ফোন করতেই একজন বয়স্ক ভদ্র মহিলা ফোন পিকআপ করলেন এবং প্রতুত্তরে জানালেন, হিসাবধারী হৃদক্রিয়া যন্ত্র বন্ধ হয়ে বিগত ছয় মাস আগে মারা গেছেন এবং তিনি উক্ত হিসাবধারীর মমতাময়ী মা।
তিনি আরো জানালেন, হিসাবধারী জীবনদ্দশায় বিবাহ করেন নাই। আমি ফোনালাপ শেষ করে, শাখা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নজরে বিষয়টি আনলাম। উক্ত হিসাব ফরমে কোন নমিনীর তথ্য ছিল না এবং হিসাবটিতে প্রায় কয়েক লক্ষ টাকা জমা ছিল। পরবর্তীতে ওয়ারিশগণ মহামান্য আদালতের শরনাপন্ন হন এবং মিস কেইস দাখিল করেন। আদালতের হিস্যা অনুযায়ী প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে উক্ত টাকা নিস্পত্তি করা হয়। উক্ত হিসাবে কোন নমিনী না থাকা অবস্থাজনিত কারণেও উক্ত হিসাবের টাকা হিসাবধারীর ওয়ারিশগণের মাঝে বন্টিত করা সম্ভব হয়েছিল।
এবার আসি আরেক কেইস স্ট্যাডি। কোন এক সরকারী কার্যালয়ের কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বেতন হিসাব ও পিএফ হিসাব পৃথক সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। তাদের মধ্যে তেমনই এক হিসাবধারী ছিলেন অবিবাহিত এবং তার দূর সম্পর্কের এক কাজিনকে উনি জীবিত থাকাকালিন উভয় হিসাবে নমীনি হিসেবে রেখে যান এবং নমীনি সংক্রান্ত যাবতীয় দলিলাদি সম্পন্ন করেন। উক্ত হিসাবধারী দূর্ঘটনাজনিত কারণে মারা যান। পরবর্তীতে নমীনি ব্যাংকে এসে নমীনি হিসেবে উক্ত হিসাবের টাকা দাবী করেন। যেহেতু তিনি সরকারী কর্মকর্তা এবং অবিবাহিত অতএব, উনার ওয়ারিশগণ সংশ্লিষ্ঠ সরকারী দপ্তরে তার জমানো পিএফ এবং অন্যান্য পাওনাদি দাবী করলে সরকারী রুল অনুযায়ী উক্ত মৃত ব্যক্তির পাওনা বিষয়ে আদালতে মিস কেইস করেন এবং আদালত উক্ত টাকা ওয়ারিশগণের মধ্যে বন্টন করার লিখিত নির্দেশনা দেন।
এখানে নমীনি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাদি থাকা সত্বেও তার পাওনাদি নমীনিকে দেয়া হয়নি বরং নমীনি ও ওয়ারিশগণের একত্রে মিমাংসাতে উক্ত হিসাবধারীর আমানতকৃত অর্থ মহামান্য আদালতের নির্দেশনানুযায়ী ওয়ারিশগণের মধ্যে বন্টিত হয়।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
এবার আলোচনায় আসা যাক নমীনি সংক্রান্ত আইনানুগ দিক নিয়ে। ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ এর ধারা ১০৩৷ (১) ব্যাংক-কোম্পানীর নিকট রক্ষিত কোন আমানত যদি একক ব্যক্তি বা যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির নামে জমা থাকে, তাহা হইলে উক্ত একক আমানতকারী এককভাবে বা, ক্ষেত্রমত, যৌথ আমানতকারীগণ যৌথভাবে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে, এমন 2[একজন বা একাধিক] ব্যক্তিকে মনোনীত করিতে পারিবেন 3[যাহাকে বা যাহাদিগকে], একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর, আমানতের টাকা প্রদান করা যাইতে পারে :
তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণ যে কোন সময় উক্ত মনোনয়ন বাতিল করিয়া নির্ধারিত পদ্ধতিতে 4[অন্য কোন ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিবর্গকে] মনোনীত করিতে পারিবেন।
(২) উপ-ধারা (১) এর অধীনে 5[মনোনীত কোন ব্যক্তি] নাবালক হইলে, তাঁহার নাবালক থাকা অবস্থায় উক্ত একক আমানতকারীর বা যৌথ আমানতকারীগণের মৃত্যুর ক্ষেত্রে, আমানতের টাকা কে গ্রহণ করিবেন তত্সম্পর্কে উক্ত একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণ নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট করিতে পারিবেন৷
(৩) আপাততঃ বলবত্ অন্য কোন আইনের বা কোন উইলে বা সম্পত্তি বিলি বণ্টনের ব্যবস্থা সম্বলিত অন্য কোন প্রকার দলিলে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপ-ধারা (১) এর অধীনে কোন ব্যক্তিকে মনোনীত করা হইলে বা উপ-ধারা (২) এর অধীন কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট হইলে তিনি একক আমানতকারী বা ক্ষেত্রমতে যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর, উক্ত আমানতের ব্যাপারে একক আমানতকারীর বা, ক্ষেত্রমত, সকল আমানতকারীর যাবতীয় অধিকার লাভ করিবেন, এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি উক্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত হইবেন।
(৪) এই ধারার বিধান অনুযায়ী কোন ব্যাংক-কোম্পানী কর্তৃক টাকা পরিশোধিত হইলে সংশ্লিষ্ট আমানত সম্পর্কিত উহার যাবতীয় দায় পরিশোধ হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে:
তবে শর্ত থাকে যে, যে ব্যক্তিকে এই ধারার অধীনে আমানতের টাকা পরিশোধ করা হইয়াছে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্য কোন ব্যক্তির কোন অধিকার বা দাবী থাকিলে তাহা এই উপ-ধারার বিধান ক্ষুন্ন করিবে না।
আমানতকারী/ আমানতকারীগণের মূত্যুর পর তাদের মনোনীত নমিনী/ নমিনীগণকে অর্থ পরিশোধ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারীকৃত বিআরপিডি সার্কূলার নাম্বার- ০৬ তারিখঃ ১৯ এপ্রিল ২০১৭ ইং অনুযায়ী ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ এর ধারা ১০৩ অনুসরণ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
ব্যাংক যদি আমানতকারী/ আমানতকারীগণের মূত্যুর পর তাদের মনোনীত নমিনী/ নমিনীগণকে চিহ্নিত করতে পারে তবে আমানতকারী/ আমানতকারীগণের জমাকৃত অর্থ মনোনীত নমিনী/ নমিনীগণকে কিছু কাগজ পত্র সংগ্রহ ও যাচাই বাছাই করণ পরবর্তীতে ততক্ষণাত পরিশোধ করে।
এবার আসা যাক ডিজিটাল ব্যাংকিং ও নমিনী। কোর ব্যাংকিং সলিউশন চালুর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা সহজ করেছে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং, কার্ডভিত্তিক লেনদেন প্রভৃতি ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের পদ্ধতি। এছাড়া চেক ক্লিয়ারিং ও ইলেকট্রনিক্স ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটিএন, আরটিজিএস) সহজেই লেনদেন করা যায়। অর্থাত প্রত্যেকটা ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা পরিসেবা সহজতর করা তথা আপামর জনসাধারণকে ব্যাংকিং সেবা পরিসেবার আওতায় আসার লক্ষ্যে মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারীকৃত বিআরপিডি সার্কূলার নাম্বার- ০২ তারিখঃ ২৩ ফ্রেবুয়ারী ২০২০ ইং অনুযায়ী ব্যাংকসমূহে হিসাব খোলার ফরম ও কেওয়াইসি প্রোফাইল সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য সহজতরকরণ করা হয় যা ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৪৫ এর আওতায় এ নির্দেশনা দেয়া হয়। উক্ত নির্দেশনায় সংক্রান্ত ব্যক্তিক হিসাব খোলার ফরমের ত্বতীয় অংশে নমীনি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাদি সংগ্রহের নির্দেশনা থাকলেও নমীনির স্বাক্ষর সম্পর্কিত কোন তথ্য নাই যা পরবর্তীতে জটিলতা সৃষ্ঠি হতেও পারে।
এখানে আর একটি বিষয়, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সরকারী/ আধা সরকারী/ স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের হিসাব ফরমে নমীনি সংক্রান্ত কোন তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করার বিষয়টি উল্লেখ নাই। মোবাইল ব্যাংকিং যেহেতু কোর ব্যাংকিং এর সাথে সম্পর্কিত সেহেতু কোর ব্যাংকিং এ নমীনি সংক্রান্ত তথ্যাদি লিপিবদ্ধ থাকলে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব যদি কোর ব্যাংকিং হিসাবের সাথে সংযুক্ত না থাকে তবে, নমীনি সংক্রান্ত তথ্য না থাকলে তা ভবিষ্যতে কোন জটিলতা সৃষ্ঠি করবে কিনা তা একটু ভেবে দেখা দরকার। অর্থাত মোবাইল ব্যাংকিং ও হিসাবধারীদের তথ্যাদির পাশাপাশি নমীনি সংক্রান্ত তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে।
আরও দেখুন:
◾ ব্যাংকে রেখে যাওয়া মৃত ব্যক্তির আমানত কে পাবে?
◾ ব্যাংক গ্রাহকের মৃত্যুতে উত্তরাধিকারী ও নমিনী কর্তৃক টাকা উত্তোলনের নিয়ম
◾ মৃত ব্যক্তির হিসাবে গচ্ছিত টাকা কে পাবে নমিনী নাকি ওয়ারিশ?
পরিশেষে এ কথা বলা যায়, কোর ব্যাংকিং বা ডিজিটাল বা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা পরিসেবার আওতায় ব্যাংকিং প্রাক্টিস এবং আইনগত দিক বিবেচনায় প্রত্যেক ব্যক্তিক হিসাবধারী মূত্যু পরবর্তী জটিলতা এড়াতে নমীনির স্বাক্ষরসহ নমীনি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাদি অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে ব্যাংক হিসাব ফরমে সংযুক্ত করা উচিত।
দিনু প্রামানিকঃ ব্যাংকার, কলামিষ্ট ও কবি, লেখক।