ঋণ খেলাপির সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতা পাচ্ছে কর্পোরেশন
খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে অন্য কারও কাছে লিজ দিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করা হবে। এতে ব্যর্থ হলে ঋণখেলাপির পুরো সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতা পাবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশন। এক্ষেত্রে খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দায় বিবেচনায় সম্পূর্ণ বা আংশিক সম্পত্তি দখলে নিতে পারবে প্রস্তাবিত এই প্রতিষ্ঠান। অন্য আইনে যা-ই থাকুক না কেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই আইন মেনে নিতে বাধ্য থাকবে।
এসব বিধান অন্তর্ভুক্ত করে ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশন আইন ২০২০’ এর খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। ‘মুজিববর্ষে হোক অঙ্গীকার, খেলাপি ঋণমুক্ত দেশ গড়ার’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে আইনটি প্রণয়ন করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি টিম যৌথভাবে কয়েক দফা বৈঠকের পর গত সপ্তাহে খসড়াটি তৈরি করে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে চালাতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার- এসব ব্যাংকের প্রচুর খেলাপি ঋণ, সেখানে সরকারি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কী করে খেলাপি ঋণ আদায়ের দায়িত্ব নেবে, তা আমার বোধগম্য নয়। বরং জনগণের টাকা নষ্টের আরেকটি সরকারি যন্ত্রের নাম হতে পারে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশন। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান উন্নত দেশে ভালো চলে। আমাদের মতো দেশে এ প্রক্রিয়ায় টাকা আদায় করা যাবে বলে আমি মনে করি না।
আইনের খসড়া অনুযায়ী, ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশন। এক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা করতে বাধ্য থাকবে খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। ঋণের জামানত দখল, সুরক্ষা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে লিজ বা বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কর্পোরেশন। এ প্রক্রিয়া চলাকালীন খেলাপির কাছ থেকে যে কোনো ধরনের তথ্য সংগ্রহের অধিকার থাকবে। এর মধ্যে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে কর্পোরেশন।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণের বেশির ভাগই সরকারি ব্যাংকে। এখন আরও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণ আদায়ের দায়িত্ব নেবে, তা কতটা যুক্তিযুক্ত, সময়ই বলে দেবে।
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয় হবে ঢাকায়। প্রয়োজনে ব্যবসা পরিচালনার স্বার্থে উপযুক্ত স্থানে এক বা একাধিক আঞ্চলিক শাখা এবং এজেন্সি স্থাপন করতে পারবে। এছাড়া সরকারের অনুমতি নিয়ে খেলাপি ঋণ কেনা-বেচার জন্য ট্রেডিং প্লাটফর্ম গঠন ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনে বিদেশে এক বা একাধিক কার্যালয় এবং এজেন্সি স্থাপন করতে পারবে।
কর্পোরেশনের প্রধান কাজের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি বা জামানতি ঋণ বা অগ্রিম ক্রয়, বিক্রয়, সংরক্ষণ, আদায়, পরামর্শ প্রদান ও ব্যবস্থাপনা অন্যতম। প্রয়োজনে ঋণগ্রহীতা রুগ্ণ প্রতিষ্ঠান ব্যালেন্সিং, আধুনিকায়ন, বিস্তার ও প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান এবং ব্যবস্থাপনা করতে পারবে।
খসড়ায় উল্লেখ করা হয়, কর্পোরেশনের অনুমোদিত শেয়ার মূলধন হবে ৫ হাজার কোটি টাকা, যা প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যের ৫০০ কোটি সাধারণ শেয়ারে বিভক্ত থাকবে। তবে সরকার চাইলে অনুমোদিত শেয়ার মূলধন বাড়াতে পারবে। কর্পোরেশনের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ হবে ৩ হাজার কোটি টাকা। এসব মূলধন সৃষ্টি, বরাদ্দ এবং সময় বাড়ানো- সবই সরকারের হাতে থাকবে।
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশন প্রয়োজনে ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে। তহবিল গঠনের জন্য এক বা একাধিক দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ারও সুযোগ রাখা হয়েছে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, আইনের অভাবে বা ঘাটতির কারণে খেলাপি হয়েছে; ব্যাপারটা এমন নয়। পর্যাপ্ত আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। তবে নতুন এই কোম্পানি আসার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।
‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশন আইন’ এর খসড়ায় আরও বলা হয়, কর্পোরেশনের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করবে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদমর্যাদার সাবেক কোনো কর্মকর্তা বা ব্যাংকিং পেশায় অন্যূন ২৫ বছরের অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তিকে চুক্তিভিত্তিক চেয়ারম্যান নিয়োগ দেবে সরকার। এছাড়া নিয়োগ করা হবে ১৪ জন পরিচালক। দেশের ১৪টি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসব পরিচালক নির্বাচন করা হবে।
পরিচালকদের মধ্যে থাকবেন অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল, যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ, এফবিসিসিআইয়ের একজন করে প্রতিনিধি। এ ছাড়াও একজনকে কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে।
পর্ষদের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য যে কোনো প্রয়োজনে এক বা একাধিক কমিটি গঠন করতে পারবে কর্পোরেশন। পরিচালকদের মধ্যে কেউ ঋণখেলাপি হতে পারবেন না। এছাড়া আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট কোনো অনিয়মের অভিযুক্ত হতে পারবেন না কোনো পরিচালক। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া এবং আদালতের প্রতি আনুগত্যশীল থাকাও প্রতিটি পরিচালকের যোগ্যতার অংশ। স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স, ব্যাংকিং, অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান বা ব্যবসায় প্রশাসন থেকে ডিগ্রিধারী হতে হবে প্রত্যেক পরিচালককে। এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কর্পোরেশনের আর্থিক বছর সরকারের আর্থিক বছরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। ব্যবসা পরিকল্পনা ও বাজেট পরিচালিত হবে পর্ষদের অনুমোদনক্রমে। লেনদেনের স্বার্থে অন্যান্য তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকে চলতি হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ করবে কর্পোরেশন। তবে কর্পোরেশনের ব্যবসার স্বার্থে অন্যান্য তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও হিসাব পরিচালনা করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
প্রতি অর্থবছর শেষে হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ এবং বার্ষিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে খসড়া আইনে। শুধু কর্পোরেশন নয়, প্রত্যেকটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এবং স্বতন্ত্র তহবিল ব্যবস্থাপনা ইউনিটকে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক নিয়োগকৃত নিরীক্ষক দ্বারা স্বাক্ষরিত হতে হবে সেই প্রতিবেদন। অর্থবছর সমাপ্তির প্রথম তিন মাসের মধ্যেই সরকারের কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন পাঠানোর শর্ত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে যে কোনো সময় বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনা করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া কর, শুল্ক, রেজিস্ট্রেশন ফি ও নিবন্ধন ফি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশনকে।
খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য সরকারি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ এবং তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে কর্পোরেশন। জামানত বা জামানতবিহীন মানি রিসিট প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্যান্য যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ যে কোনো উৎস থেকে এই ঋণ নেয়া যাবে। দেশের ভেতরে পর্ষদের অনুমতিক্রমে এবং দেশের বাইরে সরকারের অনুমোদন নিয়ে নির্দিষ্ট সুদহারে বন্ড ও ডিবেঞ্চার ইস্যু করেও ঋণ নিতে পারবে এই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট।
বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেশনকে অবসায়নের ক্ষেত্রে কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর বিধান কোনোভাবেই প্রযোজ্য হবে না। এছাড়া কর্পোরেশন প্রয়োজন মনে করলে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে এই আইনের পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজনের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয় খসড়ায়।