বিকল্প ব্যাংকিং

করোনাকালীন ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রযুক্তির ব্যবহার

ব্যাংক একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি এবং ব্যাংকিং খাত ভেঙে পড়লে অর্থনীতি সচল থাকার কোন সুযোগ নেই। তাই এই করোনা মহামারিতেও ব্যাংকিং খাতকে যেকোন উপায়ে সচল রাখতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকার ও গ্রাহকগণ করোনা ঝুঁকিতে পরছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে এমন ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা করা যাতে করে একদিকে ব্যাংকারগণ ব্যাংকিং সার্ভিস ঘরে বসে দিতে পারেন অন্যদিকে গ্রাহকগণ ঘরে বসেই ব্যাংকিং সার্ভিস নিতে পারেন। বিষয়টি কঠিন হলেও ব্যাংকের কিছু বর্তমান পন্য ও সেবার ব্যবহার বৃদ্ধি এবং আর্থিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা গ্রহন ও প্রদান অনেকটাই ঘরে বসে করা সম্ভব।

ডেবিট কার্ডের ব্যবহার বৃদ্ধি
প্রায় সকল ব্যাংকেরই এখন ডেবিট কার্ড সার্ভিস আছে। সকল কারেন্ট ও সেভিংস অ্যাকাউন্ট গ্রাহকগণ ডেবিট কার্ড সার্ভিস পেতে পেরেন, যার মাধ্যমে গ্রাহকগণ সহজে এটিএম থেকে টাকা উত্তলন করতে পারেন অথবা পয়েন্ট অফ সেল (POS) ও ই-কমার্স ব্যবহারের মাধমে কেনাকাটা করতে পারেন। বর্তমানে প্রায় আট কোটি হিসাবধারীর বিপরীতে মাত্র নব্বই লাখের মত ডেবিট কার্ড গ্রাহক আছে। এই সংখ্যাকে অন্তত চার কোটিতে উন্নিত করা গেলে এখই অন্তত ৩০% থেকে ৪০% গ্রহক ব্যাংকে উপস্থিত না হয়েও ব্যাংকিং সেবা নিতে পারেন।

আমাদের সকল বিভাগিয় শহর, জেলা শহর ও মফস্বল শহরে এখন এটিএম ও পয়েন্ট অফ সেল (POS) নেটওয়ার্ক আছে। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে গ্রাহক ও ব্যাংকারের স্বার্থে অন্তত শহর ও জেলা শহরের হিসাবধারীদের বাধ্যতামুলক ডেবিট কার্ড প্রদান করা যেতে পারে। এছাড়া হিসাবধারীদেরও কিছু দায়বদ্ধতা আছে, ডেবিট কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে ও ব্যাংকারদের তিনি নিরাপদ রাখতে পারেন। অনেক ব্যাংক এই কার্ডএর মাধ্যমে পন্য ও সেবা ক্রয় করলে কিছু ডিসকাউন্টও দিয়ে থাকে।

ইন্টারনেট ব্যাংকিং গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি
ইন্টারনেট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ঘরে বসে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে টাকা প্রেরন করা যায়, যা কিনা ব্যাংকের বড় সংখ্যক ক্লিয়ারিং চেক গ্রাহকগণকে ঘরে বসে সেবা দিতে পারে। যদিও অনেক বড় অঙ্ক এই প্রক্রিয়াতে প্রেরন করা যায় না কিন্তু পরিস্থিতির বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক এর লিমিট বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়া ইন্টারনেট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ড এর বিল পরিশোধ করা যায়, যা ব্যাংকের উপর ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকগনের ব্যাংকে উপস্থিত হয়ে বিল পরিশোধের চাপ কমাতে পারে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এছাড়াও এই সার্ভিস এর মাধ্যমে একই ব্যাংক ফান্ড ট্রান্সফার, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, ব্যালেন্স চেক, বিকাশে টাকা ট্রান্সফারসহ অনেক সার্ভিস ঘরে বসে গ্রাহকগণ পেতে পারেন। বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী স্যংখ্যা প্রাই দশ কোটি এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহারকারী স্যংখ্যা মাত্র ২০ লাখেরও কম। এই সংখ্যা অন্তত দুই কোটিতে উন্নিত করা গেলে আরও ২০% থেকে ২৫% গ্রাহক ঘরে বসে ব্যাংকিং সেবা পেতে পারেন। এইজন্য ব্যাংকগুলোকে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সহজিকরণ ও প্রচারণার মাধ্যমে গ্রাহকগনকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এতে করে ব্যাংকের পরিচালনা খরচও অনেক কমে যাবে।

ভার্চুয়াল অফিস এর মাধ্যমে ঘরে বসে ব্যাংকিং সেবা প্রদান
বর্তমান যুগে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল অফিস করা সম্ভব। অনেক আধুনিক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ভার্চুয়াল অফিসের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে আসছে। ভার্চুয়াল অফিস পদ্ধতিতে কর্মীরা সশরীরে অফিসে হাজির না হয়েও ঘরে-বাইরে যেকোনো জায়গায় বসে অনলাইনে কাজ সারতে পারেন। ব্যাংক যেহেতু সেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠান অনেক সার্ভিস ঘরে বসে দেওয়া সম্ভব। ব্যাংকের ব্যাক অফিস সিস্টেম কর্মীদের ল্যাপটপ এ স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাক অফিস সেবা ঘরে বসে দেওয়া যায়। তাছাড়া শাখা ম্যানেজার ও অন্যান্য ম্যানেজারগন গ্রাহকদের সাথে ইন্টারনেট ভিত্তিক লাইভ প্রোগ্রাম করতে পারেন। অনেক অফিস ইতোমধ্যে ঘরে বসে অফিস করার ব্যবস্থা করেছে। ভার্চুয়াল অফিস বেশি করে স্থাপনের মাধ্যমে বড় সংখ্যক ব্যাংকারগণ অফিসে না গিযেও ব্যাংকিং সার্ভিস দিতে পারেন।

ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

ব্যাংক ও আর্থিকসেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হ্যান্ডসেকিং ও ইনটিগ্রেশন বৃদ্ধি
বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিকসেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠানের প্ল্যাটফর্ম ও নেটওয়ার্ক হ্যান্ডসেকিং বা ইনটিগ্রেশনের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক চেইন বৃদ্ধি করা গেলে গ্রাহকগন ঘরে বসে অধিক আর্থিক সেবা পেতে পারে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা কার্ড থেকে আর্থিকসেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠান যেমন বিকাশ বা নগদে টাকা প্রেরন এবং বিকাশ বা নগদ থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ড এ টাকা প্রেরনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অনেক ব্যাংক ও আর্থিকসেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠান হ্যান্ডসেকিং এর মাধ্যমে সেবা প্রদান শুরু করেছে।

কিন্তু এখনও অনেক হ্যান্ডসেকিং এর ব্যাপক সুযোগ রয়ে গেছে। বর্তমানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, কার্ড, বিকাশ, নগদ মিলে দশ থেকে বারো কোটি গ্রাহক হিসাব সংখ্যা রয়েছে। সুতরাং এই রকম হ্যান্ডসেকিং বা ইনটিগ্রেশনের মাধ্যমে কোটি কোটি গ্রাহককে বেশ কিছু আর্থিক সেবা ঘরেই বসেই দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিশেষ করে ক্যাশ জমা ও উত্তোলন, টাকা পাঠানো, কেনাকাটা, বিল পরিশোধ ইত্যাদি। এ ধরনের নেটওয়ার্ক হ্যান্ডসেকিং বা ইনটিগ্রেশনের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক চেইন বৃদ্ধির করা গেলে গ্রাহক, ব্যাংক, আর্থিকসেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠান সকল পক্ষের সুবিধা হবে।

আর্থিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও ডিজিটাইজেশন
বর্তমান যুগে ব্যাংকে আর্থিক প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর পৃথিবীতে যে ধরনের আর্থিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় তাতে করে আর্থিক সেবা অনেকটাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। এমনকি প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের চেয়ে সহজ উপায়ে ও কম খরচে আর্থিক সেবে দিতে শুরু করেছে। আর্থিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক সেবার সুবিধা হচ্ছে প্রায় সকল ধরনের আর্থিক সেবা গ্রাহক ঘরে বসে পেতে পারেন এবং প্রতিষ্ঠানও একটি ডিজিটাল অ্যাপ এর মাধ্যমে সেবা দিতে পারে। যেমন হিসাব খোলা, টাকা জমা ও উত্তোলন, বিল পরিশোধ, টাকা পাঠানো, ঋণের জন্য আবেদন, ঋণ পাওয়াসহ আরও অনেক সেবা।

ব্লকচেইন, ক্লাউড কম্পিউটিং, ওপেন এপিয়াই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে নতুন প্রজন্মের আর্থিক প্রযুক্তির বিবর্তন ঘটেছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি ব্যাংকের বিশেষ করে ভোক্তা ব্যাংকিং (Consumer Banking) সকল সেবা একটি ডিজিটাল অ্যাপ এর মাধ্যমে দেওয়া যায় এবং গ্রাহকগন স্মার্ট ফোন থেকে ব্যাংকিং সেবা নিতে পারেন। পৃথিবীর অনেক বড় বড় ব্যাংক ইতোমধ্যে ‘ডিজিটাল ব্যাংক’ বা ‘ইন্টারনেট ওনলি ব্যাংক’ নামে এই সেবা দিতে শুরু করেছে। যেমন ফ্রান্স এর ব্যাংক বিএনপি পারিবাস (BNP Paribas-France) এর হ্যালো ব্যাংক (Hello Bank); সিঙ্গাপুর এর ব্যাংক ডিবিএস (DBS-Singapur) এর ডিজি ব্যাংক (Digi Bank); কাতারের মাশ্রেক ব্যাংক (Mashreq Bank-Qatar) এর নিও ব্যাংক (Mashreq Neo) ইত্যাদি।

বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং নামে অনেক ব্যাংকের বিভাগ কাজ শুরু করেছে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংক বা ইন্টারনেট ওনলি ব্যাংক এখনও তৈরি হইনি। কিন্তু ভবিষ্যতে একটি পরিপূর্ণ ডিজিটাল ব্যাংক ছাড়া ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পরবে, কারন ডিজিটাল ব্যাংকিং পরিচালনা খরচ অনেক কম অন্যদিকে গ্রাহক সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করা যায়, সেবাও অনেক দ্রুত ও সহজে দেওয়া যায়। এই ধরনের ব্যাংকিং এর জন্য এক দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন অন্যদিকে ব্যাংকগুলোকে আরও মনযোগি ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হতে হবে, কারন ডিজিটাল ব্যাংকিংই হতে পারে ব্যাংক ছাড়াই ব্যাংকিং সেবা সর্বোত্তম দেওয়ার উপায়।

অবশেষে বলা যায়, ব্যাংকগুলোর বর্তমান পণ্য ও সেবার ব্যবহার বৃদ্ধি বিশেষত ডেবিট কার্ড ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং এর ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ভার্চুয়াল অফিস স্থাপনের মাধ্যমে এখনই ৫০% থেকে ৬০% সেবা গ্রাহকগণ ঘরে বসে নিতে পারেন ও ব্যাংকারগণও ঘরে বসে ব্যাংকিং সেবা দিতে পারেন। অন্যদিকে ব্যাংক ও আর্থিকসেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হ্যান্ডসেকিং বৃদ্ধি ও আর্থিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে নিকট ভবিষ্যতে সমগ্র ভোক্তা ব্যাংকিং খাতকে গ্রাহকের ঘরে ঘরে পৌছে দেওয়া যেতে পারে।

করোনা মহামারী ছাড়াও ব্যাংকগুলোকে ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য আর্থিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে একটি গতানুগতিক ব্যাংককে ডিজিটাল ব্যাংকিং এ রুপান্তর ছাড়া আর অন্য কোন উপাই নেই, যা এক দিকে ব্যাংকের পরিচালানা খরচ ব্যপক হারে কমাবে, অন্যদিকে একটি গ্রাহক বান্ধব ব্যাংকিং ব্যবস্থা তৈরি করবে। এইজন্য ব্যাংকগুলোর দূরদর্শিতা, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগীতা এবং গ্রাহকদের সচেতনতা প্রয়োজন। আশাকরি করোনা পরিস্থিতি এ বাবস্থাকে ত্বরান্বিত করবে।

লেখক: মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম ভুঁইয়া, সহযোগী ভাইস প্রেসিডেন্ট, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button