বীমা

প্রচলিত ইসলামী বীমা: সমস্যা ও তার প্রতিকার

ড. এম কবির হাসান, লুকমান হাসানঃ আগের এক লেখায় আমরা বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামী বীমা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমস্যা ও তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি। সে ধারাবাহিকতায় আমরা ইসলামী বীমা কোম্পানিগুলোর চুক্তি ফরম, প্রসপেক্টাস ইত্যাদি কাগজপত্রের ত্রুটিগুলো নিয়ে কিছু আলোচনা করব। মূলত এগুলো এমন মৌলিক সমস্যা, যা থেকে মুক্ত হওয়া ছাড়া ইসলামী বীমা ব্যবস্থার প্রকৃত সুফল মিলবে না। তাই এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে। এবার মূল আলোচনায় আসা যাক—

ইসলামী বীমাসংক্রান্ত কাগজপত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি
ইসলামী বীমাবিষয়ক ফর্ম, পরিচিতি, শর্তাবলি ইত্যাদি কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকাটাও এ দেশে ইসলামী বীমা অনগ্রসরতার একটি মৌলিক কারণ। শ্রদ্ধাভাজন আলেম শ্রেণী ইসলামী বীমাকে ভিন্ন চোখে দেখার এটিও একটি কারণ। নিম্নে নমুনাস্বরূপ কিছু ত্রুটি মন্তব্যসহ উল্লেখ করা হলো:

১. একটি প্রসিদ্ধ ইসলামী বীমা কোম্পানির ফরমে লেখা আছে—‘আমি আরও ঘোষণা করিতেছি যে…ইনসিওরেন্স কোম্পানির আবেদনপত্রে বা ঘোষিত বিবৃতিতে কোন প্রকার অসত্য বর্ণনা থাকিলে প্রস্তাবিত বীমা চুক্তি বাতিল বলিয়া গণ্য হবে এবং প্রদত্ত প্রিমিয়াম কোম্পানি কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হইলে আমার কোন আপত্তি থাকবে না।’

মন্তব্য: ইসলামী জীবন বীমায় প্রায় ৯০ শতাংশ প্রিমিয়াম মুদারাবা ফান্ডে দেয়া হয়। আর মুদারাবা চুক্তিতে এরূপ কোনো শর্ত করা এবং মূল পুঁজি বাজেয়াপ্ত করা মুদারাবা-সংক্রান্ত মূলনীতির স্পষ্ট পরিপন্থী। আর অসত্য বর্ণনা বলতে যা বোঝানো হয় তা হলো, বীমাবহির্ভূত কোনো রোগ শরীরে ছিল, সেটা হয়তো গোপন করা হয়েছে কিংবা বয়স লুকানো হয়েছে ইত্যাদি। এসব কারণে রব্বুল মালের সম্মতিতেও মূল পুঁজি বাতিল করার কোনো অবকাশ নেই।
এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এতটুকু করা যায়, বীমা চুক্তিটি বাতিল করে দেয়া। আর বাতিল করা পর্যন্ত বাস্তব যা খরচ হয়েছে তা কেটে রাখা। তবে অপরচুনিটি কোনো কস্ট কেটে রাখা যাবে না।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

২. একই কোম্পানির ইসলামী জীবন বীমার সাধারণ শর্তাবলি ও সুবিধাদির ধারা ০৪-এ লেখা আছে: ‘বীমা দাবি নিষ্পত্তির পূর্বে গ্রহণযোগ্য বয়সের সন্তোষজনক প্রমাণ দাখিল করতে হবে…তবে বয়সের পার্থক্য যদি সাত বছর বা তদুর্ধ্ব হয় তাহলে বীমাটি বাতিলযোগ্য হবে।’

মন্তব্য: আগেও বলা হয়েছে, প্রিমিয়ামের প্রায় ৯০ শতাংশ যেহেতু মুদারাবা বাবদ প্রদত্ত, তাই তা বাজেয়াপ্ত করার অধিকার কোম্পানির নেই। এর বিকল্প তা-ই, যা আগে বলা হয়েছে।

৩. ইসলামী জীবন বীমার সাধারণ শর্তাবলি ও সুবিধাদির ধারা ০৬-এ উল্লেখ আছে, ‘যদি ৬ মাসের মধ্যে বকেয়া প্রিমিয়াম বিলম্ব মাসুলসহ প্রদান না করা হয়, তাহলে বীমাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হ্রাসকৃত অংকের লাভবিহীন সম্পাদিত বীমায় রূপান্তরিত হবে।’
কাছাকাছি কথা আরেকটি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের [ইসলামী বীমা (তাকাফুল) ডিভিশন] পরিকল্প পরিচিতি ও প্রিমিয়াম তালিকার পৃষ্ঠা ৬৭-এর ধারা-২-এও লেখা আছে।

মন্তব্য: বিলম্ব মাসুল কী? পলিসি হোল্ডার তো মুদারাবা বাবদ অর্থ জমা করছে। এখন রব্বুল মাল যদি যথাসময়ে পুঁজি প্রদান না করে তাহলে কি পুঁজিদাতা থেকে বিলম্ব মাসুল নেয়া যাবে? মুদারাবা মূলনীতি অনুযায়ী এটি কোনোভাবেই বৈধ নয়। তাছাড়া ওই মাসুল কোন ফান্ডে গণ্য হবে? এটি কি কোম্পানির আয় হিসেবে গণ্য হবে, নাকি মুদারাবা ফান্ডে যাবে—এসব স্পষ্ট নয়।

এরপর বলা হয়েছে, ‘লাভবিহীন’। এই লাভ তো রব্বুল মালের অর্থ থেকে উপার্জিত। ব্যবসায়ীর ওই লাভ বাজেয়াপ্ত করার কোনো অধিকার নেই। এরূপ শর্ত সুস্পষ্ট মুদারাবা মূলনীতির পরিপন্থী।

এসব ক্ষেত্রে এরূপ করা যায়, যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধ না করলে এমন আইন থাকতে পারে যে পরবর্তী বছর বা মাসে বকেয়াগুলো নগদায়ন করতে হবে অথবা মুনাফার হার কমিয়ে দেয়ার কথা বলবে বা তাবাররু চাঁদা বৃদ্ধি করে দেবে অথবা কিস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করবে।

৪. একই লাইফ ইন্স্যুরেন্সের [ইসলামী বীমা (তাকাফুল) ডিভিশন] পরিকল্প পরিচিতি ও প্রিমিয়াম তালিকার পৃ. ৬৭-এর ‘সাধারণ শর্ত’ ধারা-০১-এ উল্লেখ আছে, “প্রথম প্রিমিয়াম পরিশোধের পর পরবর্তী প্রতিটি প্রিমিয়াম নির্ধারিত তারিখ থেকে ৩০ দিন (তবে মাসিক প্রিমিয়াম প্রদানের ক্ষেত্রে ১৫ দিন) অনুগ্রহকালের মধ্যে পরিশোধ করা যাবে। অনুগ্রহকালের মধ্যে প্রথম প্রিমিয়াম জমা দেয়া না হলে ‘বিচ্যুতি’ ঘটেছে বলে বিবেচিত হবে। দুটি পূর্ণ বার্ষিক প্রিমিয়াম প্রদানের আগে অনুরূপ ‘বিচ্যুতি’ ঘটলে সংশ্লিষ্ট তারিখ থেকে পলিসিটি অচল বা তামাদি হয়ে যাবে এবং এরই মধ্যে জমাকৃত সব প্রিমিয়াম কোম্পানি কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হবে।”

মন্তব্য: এটিও মুদারাবা নীতিমালার পরিপন্থী। এভাবে মুদারাবার অর্থ তামাদি করে খেয়া ফেলা স্পষ্ট ‘আল আকলু বিল বাতিল’ (অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ গ্রাস করা)-এর অন্তর্ভুক্ত হবে। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না’—(সূরা নিসা, আয়াত নং ২৯), সুতরাং এসব ধারা পরিবর্তনযোগ্য।

৫. ইসলামী জীবন বীমার সাধারণ শর্তাবলি ও সুবিধাদির ধারা ০৮-এ লেখা আছে, ‘পলিসি সমর্পণ মূল্য অর্জনের পূর্বে প্রিমিয়াম প্রদান বন্ধ করা হলে…বিশেষ পুনর্বহাল ফি প্রদান করতে হবে।’
কাছাকাছি কথা আরেকটি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের [ইসলামী বীমা (তাকাফুল) ডিভিশন] পরিকল্প পরিচিতি ও প্রিমিয়াম তালিকার পৃ. ৬৭-এর ধারা-২-এও লেখা আছে।

মন্তব্য: মুদারাবা চুক্তিতে পুনর্বহাল ফি নেয়ার শর্তারোপও মুদারাবা মূলনীতির পরিপন্থী। সর্বোচ্চ এতটুকু করা যায়, তাবাররু অংশ বাড়িয়ে নেয়ার শর্তারোপ করা হবে।

৬. একটি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের [ইসলামী বীমা (তাকাফুল) ডিভিশন] পরিকল্প পরিচিতি ও প্রিমিয়াম তালিকার পৃ. ৬৭-এর ধারা ৬-এ লেখা আছে, ‘এক বছরের মধ্যে বীমা গ্রহীতা যদি আত্মহত্যা করে তাহলে পলিসিটি বাতিল বলিয়া গণ্য হবে। এবং প্রচলিত বীমা আইন মোতাবেক প্রদত্ত সকল প্রিমিয়াম বাজেয়াপ্ত হবে।’

মন্তব্য: পলিসি হোল্ডার তো রব্বুল মাল (পুঁজিদাতা)। আর বীমা কোম্পানি এখানে মুদারিব। প্রদত্ত প্রিমিয়ামের প্রায় ৯০ শতাংশ মুদারাবা হিসেবে প্রদত্ত। সুতরাং সে আত্মহত্যা করলে তার মূল পুঁজি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার মুদারিবের নেই। বইটির শুরুতে স্পষ্ট লেখা আছে, ‘জীবন বীমা পলিসি সুদভিত্তিক না হয়ে বরং তা আল-মুদারাবা আর্থিক পদ্ধতির নীতিমালা অনুযায়ী হয়।’ অন্যদিকে একই বইয়েরই ৬৭ পৃষ্ঠায় মুদারাবা পরিপন্থী কথা লেখা। অবাক করা বিষয়! এসব যেন কেউ বলার নেই, দেখার নেই।

৭. আরেকটি বীমা কোম্পানি, যাদের জেনারেল জীবন বীমার পাশাপাশি তাকাফুল ব্যবস্থাও আছে। তাদের জেনারেল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচিতিমূলক বইয়ের নাম ‘ডিপিএস সুপার’। আর তাকাফুলের পরিচিতিমূলক বইয়ের নাম ‘তাকাফুল ডিপিএস’। দুটি বই দশ পৃষ্ঠার। দুটি বই পাশাপাশি রাখলে আপনি মৌলিক তিনটি পার্থক্য পাবেন। তা হলো:
ক. ‘তাকাফুল ডিপিএস’ বইয়ের কভারে মানুষের ছবি নেই। ‘ডিপিএস সুপার’ বইয়ের কভারে একটা মেয়ের ছবি দেয়া আছে।
খ. ‘তাকাফুল ডিপিএস’-এর শুরুতে আস সালামু আলাইকুম লেখা আছে। যা ‘ডিপিএস সুপার’-এর শুরুতে নেই।
গ. ‘তাকাফুল ডিপিএস’ শুরুতে লেখা আছে, ‘ইসলামী আইন ও শরিয়াহ নির্দেশনাবলি পালন করে (কোম্পানি) প্রথমবারের মতো শরিয়াহ-ভিত্তিক বীমা প্রচলন করেছে।’

ওই তিনটি পার্থক্য ছাড়া কনভেনশনাল জীবন বীমা ও তাকাফুলের কার্যক্রমে কোনো তফাত নেই। যেমন আত্মহত্যার ব্যাপারে ‘ডিপিএস সুপার’-এর ধারা ০৫-এ লেখা আছে, ‘বীমার প্রথম দুই বছরের মধ্যে আত্মহত্যা করলে পলিসি কোনো কিছু কভার করবে না।’ হুবহু একই কথা ‘তাকাফুল ডিপিএস’-এর ধারা-০৫ এর মধ্যেই লেখা আছে। এভাবে বাকি সবকিছু অভিন্ন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ডিপিএস সুপারের কপি পেস্ট করে তাকাফুল ডিপিএস তৈরি করা হয়েছে। ধর্মের নামে এ রকম জালিয়াতি আর কোনো খাতে দেখা যায় না!

৮. একই কোম্পানির লাইফ ইন্স্যুরেন্সের তাকাফুল ডিভিশনের শরিয়াহ-ভিত্তিক পরিচালিত জীবন বীমার লিফলেটে লেখা আছে—‘ঊনবিংশ শতাব্দীর হানাফী স্কলার আল্লামা ইবনে আবেদীন বীমা ব্যবস্থাকে আইনানুগ বৈধ একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানরূপে বৈধতা দান করেছেন।’

মন্তব্য: এখানে কিছু লিখতেও কষ্ট হচ্ছে। একজন ফকিহের ওপর এত বড় মিথ্যাচার! ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম বিশদভাবে বীমা ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করলেন। অথচ তার নামে এত বড় মিথ্যাচার! যদি বলেন, এখানে উদ্দেশ্য ‘ইসলামী বীমা’, তাহলে বলব, তিনি ইসলামী বীমা নিয়ে কোনো আলোচনাই করেননি। ইসলামী বীমা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত তো সত্তরের দশক থেকে শুরু, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হওয়ার পর। ইবনে আবেদিন রহ. (মৃত্যু ১৮৩৬ ঈ.)-এর সময় এর কল্পনাই করা হয়নি। তখন জেনারেল বীমাও প্রথমাবস্থায় ছিল। সেটাও ভালো করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাছাড়া তিনি তো নৌ বীমা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার আলোচনায় জীবন বীমার কোনো কথা নেই। ইসলামী জীবন বীমার ক্ষেত্রে তার রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর তিনি কোথায় আলোচনা করেছেন, এরও কোনো তথ্য নেই। তাছাড়া তার মৃত্যু সন লেখা হয়েছে ১৮৩১ ঈ.। সঠিক হলো ১৮৩৬ ঈ.।

৮. উল্লিখিত লিফলেটে শাইখ মুহাম্মাদ আবদুহুর ব্যাপারেও মিথ্যাচার করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ মিসরের মুফতি ইমাম মুহাম্মদ আব্দুহু বীমা প্রচলনকে বৈধ ঘোষণা করেছেন।’
একই অসত্য তথ্যটি সেন্ট্রাল শরিয়াহ কাউন্সিল ফর ইসলামিক ইন্স্যুরেন্স অব বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ইসলামী বীমা প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’-এও আছে (পৃ. ৩৩)।

মন্তব্য: মূল ঘটনা হলো, ১৩২১ হি., সফর মোতাবেক ১৯০ ঈ., এপ্রিলে শাইখ মুহাম্মাদ আবদুহু রহ. বীমাবিষয়ক একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। প্রশ্নটি করা হয়েছিল মিউচুয়াল লাইফ আমেরিকা বীমা কোম্পানির পরিচালকের পক্ষ থেকে। প্রশ্নটি মূলত ছিল মুদারাবাসংক্রান্ত। বীমাসংক্রান্ত নয়। কিন্তু যেহেতু তা একটি বীমা কোম্পানি থেকে করা হয়েছিল এবং প্রশ্নের মধ্যে বীমার কিছু পরিভাষাও ব্যবহার করা হয়েছে, তাই সেখান থেকে কিছু ধূর্ত লোক একে জেনারেল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বৈধতার পক্ষে পেশ করা শুরু করে। বিশ্বের নামিদামি স্কলাররা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ওই ফতোয়াটি মূলত ছিল মুদারাবাবিষয়ক। তিনি মুদারাবাকে বৈধ বলেছেন। তার সঙ্গে বীমার দূরতম সম্পর্কও ছিল না।

শাইখ মুহাম্মদ আবদুহু রহ.-এর ওপর আরোপিত ওই অপবাদ যারা খণ্ডন করেছেন, এমন তিনজন স্কলারের নাম উদাহরণস্বরূপ এখানে উল্লেখ করা হলো:
১. ড. আলী মহিউদ্দীন আলী কারাহ দাগী। তার বই ‘আত-তামীনুত তাকাফুলী আল-ইসলামী’। খ. ১, পৃ. ১৫০। প্রকাশক: দারুল বাশায়ের, ষষ্ঠ সংস্করণ, ২০১১।
২. প্রফেসর ড. সিদ্দিক মুহাম্মদ আমীন আদ্দারীর। তার প্রবন্ধ ‘আত-তামীন-তাকভীমুল মাসিরাহ আন-নাযরিয়্যাহ ওয়াত তাতবিকিয়্যাহ’। পৃ. ১২।
৩. শাইখ মুহাম্মদ আহমদ আস-সানহুরী। মাজমাউল বুহুসিল ইসলামিয়ার সপ্তম অধিবেশনে তিনি তার বক্তব্যে শাইখ আব্দুহু থেকে ওই অপবাদ খণ্ডন করেছেন। দেখুন, ড. ঈসা আব্দুহুকৃত ‘আত-তামীন বায়নাল হিল্লি ওয়াত তাহরীম’, পৃ. ১৩৪-১৩৫, ১৪৪।

সার কথা, জেনারেল লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে শাইখ আব্দুহু বৈধ বলেননি। তাছাড়া তিনি যদি জেনারেল বীমাকে বৈধ বলেই থাকেন, তদ্রূপ ইবেন আবেদীন রহ.ও যদি বৈধ বলে থাকেন, তাহলে তাকাফুলের কী প্রয়োজন? জেনারেল ইন্স্যুরেন্স যেখানে বৈধ, সেখানে এত কষ্ট করে তাকাফুল কাগজপত্র তৈরির কী প্রয়োজন? এসব বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য ইসলামী বীমা কোম্পানিগুলোর লিফলেটে ও বইপত্রে অনেক। ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনসাধারণের ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে এসব অন্যায় আচরণ দেখার কেউ নেই।

শেষ কথা, আমাদের দেশের ইসলামী বীমা কোম্পানিগুলো বাস্তব অপারেশনে কনভেনশনাল বীমাকেই প্রতিনিয়ত অনুসরণ করে। পার্থক্য কেবল কাগজে-কলমে। তাও অল্প কিছু ক্ষেত্রে, যা আমরা উল্লিখিত আলোচনায় দেখেছি। এর মধ্যে অনেকে আবার নামে তাবাররু মডেলকে অনুসরণ করে, যা শাইখুল ইসলাম মুফতি মুহাম্মদ তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহসহ উপমহাদেশের অধিকাংশ আলেমের মতে প্রশ্নবিদ্ধ। যদি তাবাররু মডেলটাও অন্যান্য দেশের মতো অ্যাওফির নির্দেশনা অনুযায়ী হুবহু অনুসরণ করা হতো, তবুও তা অনেকের মতে বৈধ হতো। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আলেমরা একে বৈধ বলেছেন। অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে এর চর্চাও হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটাও নেই। হুবহু জেনারেল বীমাকে অনুসরণ করা হয়। ফ্যামিলি তাকাফুলে নামে মুদারাবা শব্দ ব্যবহার করা হয়, আর বাস্তবে জেনারেল সিস্টেমকে ফলো করা হয়। তাদের কাগজপত্র ও বাস্তব আচরণে তা একেবারেই স্পষ্ট।

সুতরাং এসব থেকে উত্তরণ করতে হলে যা করতে হবে—
১. উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শরিয়াহ বাস্তবায়নের ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে।
২. যেকোনো একটি মডেল পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে। ওয়াকফ মডেল আমাদের বিবেচনায় তুলনামূলক ভালো।
৩. অন্যান্য মুসলিম বিশ্বে কীভাবে তাকাফুল বাস্তবায়ন হচ্ছে, তা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে সেভাবে আমাদের দেশে প্রয়োগ করা।
৪. স্বতন্ত্র তাকাফুল আইন বাস্তবায়ন করা।
৫. ইসলামিক জনশক্তির উন্নয়ন ঘটানো।

উপসংহার
আমদের দেশে প্রচলিত ইসলামী বীমাগুলোর অবস্থা বেশ ভঙ্গুর। কোনো মডেলকেই তারা পূর্ণরূপে অনুসরণ করছে না। কাগজপত্র থেকে শুরু করে বাস্তব কার্যক্রমে অসংখ্য শরিয়াহ লঙ্ঘন রয়েছে। এসব থেকে ইসলামী বীমা শিল্পকে রক্ষা করতে হলে প্রথমেই তাকাফুলবিষয়ক স্বতন্ত্র আইন রচনা করতে হবে। এরপর ওয়াকফ মডেলকে ভিত্তি বানিয়ে ইসলামী বীমা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক্ষেত্রে ওয়াকফ মডেলের ভিত্তিতে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বীমা কোম্পানি পরিদর্শন করে তাদের থিম ফলো করা যেতে পারে। এসবই করতে হবে বীমাবিষয়ক জেনারেল বিশেষজ্ঞ লোকদের পাশাপাশি মূলধারার আলেমদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শের মাধ্যমে। এজন্য আলেমদের সঙ্গে মত বিনিময়ের বিকল্প নেই।

লেখকঃ ড. এম কবির হাসান: অধ্যাপক, নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং লুকমান হাসান: সিএসএএ, অ্যাওফি, স্কলার।

আরও দেখুন:
সাউথ বাংলা ব্যাংকের এমডির পদত্যাগ
নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি ব্যাংকারদের আরও কিছু দাবি
দেশে এ মুহূর্তে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই
করোনায় ঢাকা ব্যাংক শাখা ব্যবস্থাপকের ইন্তেকাল
অর্থমন্ত্রী জানেন না ব্যাংক চায় এফবিসিসিআই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button