ইসলামী ব্যাংকিং

ইসলামি ব্যাংকিংঃ প্রচলিত ধারণা ও মূল্যায়ন

ইসলামি ব্যাংকিং হ’ল ইসলামি শরিয়াহর ভিত্তিতে সুদবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাস্তবায়ন ও এর মাধ্যমে সুদের অভিশাপ ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে সমাজ ও অর্থনীতিতে সুবিচার ও ইনসাফ নিশ্চিত করা। এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা বর্তমানে শুধু বাস্তব সত্যই নয়, এর সাফল্য ও অগ্রগতি এবং সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি যারা গতানুগতিক ধারায় ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারাও ইসলামি ব্যাংকিংয়ের সফলতায় আকৃষ্ট হয়ে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোতে ইসলামি ব্যাংকিং ধারা চালু করছেন।

অঞ্চলভিত্তিক ব্যক্তি ও কমিউনিটি পর্যায়ে শরিয়াহভিত্তিক আর্থিক লেনদেন অনেক আগে থেকেই প্রচলিত থাকলেও সত্তর/আশির দশক হতে আধুনিক ইসলামি কমার্শিয়াল ব্যাংকিং বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হতে শুরু করে। বিভিন্ন দেশের মতো এদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থাতেও ইসলামিক ব্যাংকিং খুব দ্রুতই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ধর্মভীরুতা ও ধর্মান্ধতার কারণে নিজেদের আর্থিক লেনদেনে অনেকে ইসলামি ব্যাংকিং সম্পৃক্ততা বজায় রাখলেও এ সম্পর্কে অনেকের ধারণা এখনও স্পষ্ট নয়। এ ধারণাকে একেকজন একেকভাবে মূল্যায়ন করে থাকেন। নিম্নে ইসলামি ব্যাংকিং সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা ও তার মূল্যায়ন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হ’ল-

১. ঘুরিয়ে সুদ খাওয়ার ভুল ধারণা
ইসলামি ব্যাংকিং সম্পর্কে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা আসলে একই। ইসলামি ব্যাংকসমূহ একটু ঘুরিয়ে সুদ খায়। তাদের মতে, সুদ বলুন আর মুনাফা বলুন, আসলে দুটি একই। কথাটা আদৌ সঠিক নয়, কারণ ইসলামি ব্যাংকিং শরিয়াহর মূলনীতিগুলোর উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থনীতি ও আর্থিক লেনদেন বিষয়ে পবিত্র কোরআনের বাণী ও হাদিসের বিশ্লেষণের মাধ্যমে আলেমগণ যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাই হ’ল ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ভিত্তি। শরিয়াহ্ কাউন্সিল ও সমন্বিত মতামতের ভিত্তিতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনায় আমানত সংগ্রহে ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শরিয়াহ্ পরিপালন করার মাধ্যমে সুদমুক্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা ইসলামি ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্য।

২. শতকরা হার এবং নির্ধারিত হার সম্পর্কে বিভ্রান্তি
সুদের হিসাব শতকরা হারে করা হয় বলে শতকরা হার শুনলেই তাকে আমরা সুদ মনে করি, যা মোটেও ঠিক নয়। শতকরা হার হ’ল একটা হিসাব পদ্ধতি মাত্র। দেখতে হবে এর প্রয়োগ কোথায় কিভাবে হচ্ছে।ব্যবসায়ীগণ বছরের শেষে হিসাব করতে গিয়ে ব্যবসায় কি পরিমাণ লাভ বা ক্ষতি হয়েছে তা শতকরা হার দ্বারা হিসাব করতে পারেন। কত টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ হয়েছিল এবং এতে কত টাকা লাভ বা লোকসান হয়েছে তা শতকরায় হিসাব করতে শরিয়াহর কোনো নিষেধ নেই। একইভাবে মালামাল ক্রয়ে কত টাকা খরচ হয়েছে, ক্রয়মূল্যের সাথে শতকরা কত টাকা লাভ করলে পোষাবে, এসকল বিষয় চিন্তা করে পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ণয় করাতে শরিয়াহ্ বিরোধী কিছু নেই।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

নির্ধারিত হলেই তা সুদ এবং হারাম, বিষয়টি আসলে এমন নয়। বাজার ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে অনেক নির্ধারিত মূল্যের দোকান দেখা যায় যেখানে ক্রয়-বিক্রয় করতে আমরা স্বস্তিবোধ করি। আমরা নির্ধারিত রেটেই আমাদের বাড়ি বা কোনো সম্পদ ভাড়া দিয়ে থাকি। আমরা যদি কোনো গাড়ি কিনে কাউকে চালাবার জন্য ভাড়া দেই, তখন গাড়ি কিনতে কত টাকা খরচ হয়েছে, দৈনিক বা মাসিক কিংবা বার্ষিক কত ভাড়া হলে লাভজনক হবে, কিংবা যে পরিমাণ পুঁজি খেটেছে তাতে কত হারে ভাড়া ধরলে লাভবান হওয়া যাবে তা নির্ধারণ করে কাউকে ভাড়া দিতে শরিয়াহর কোনো আপত্তি নেই। বরং ভাড়া নির্ধারিত না করলে পরবর্তী সময়ে মালিক পক্ষ ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে একটা মনোমালিন্যের আশঙ্কা থেকেই যায় যা মূলত শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। এমনকি কেউ কোনো কিছু ভাড়া নিয়ে সেটির ব্যবহার না করলেও তার ভাড়া যথাসময়ে দিতে বাধ্য থাকবে। সুতরাং লাভের পরিমাণ নির্ধারিত হলেই তা সুদ হবে বিষয়টি এমনও নয়।

৩. সুদ ও মুনাফার পার্থক্য বুঝতে না পারা
আরবি ‘রিবা’ যার শাব্দিক অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, বেশি হওয়া, মূল যেটা বেড়ে যাওয়া, অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের ক্ষেত্রে পূর্ব নির্ধারিত হারে অধিক পরিমাণ অর্থের বিনিময় এবং দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে একই জাতীয় সামগ্রীর কম পরিমাণের সাথে বেশি পরিমাণে বিনিময় করা হলে অর্থ বা পণ্যের অতিরিক্ত অংশকে বলা হয় রিবা বা সুদ। বিনিময় মূল্য ছাড়া আসলের অতিরিক্ত যা নেয়া হয় তা-ই সুদ। অন্যদিকে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে ব্যবসায়িক উপার্জনকে মুনাফা বলা যায়। কেনা-বেচার ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার লাভ লোকসানের সম্মতির ভিত্তিতে বিক্রেতা তার ক্রয় মূল্যের সাথে আনুষঙ্গিক খরচসহ উৎপাদন খরচের অতিরিক্ত যে অর্থ পায় বা পাওয়ার আশা রাখে তাকেই মুনাফা বলে।

সুদ ও মুনাফার পার্থক্য
১. সুদের সম্পর্ক ঋণের সাথে।
মুনাফার সম্পর্ক ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে।
২. সুদে শ্রম ও সময় দিতে হয় না।
মুনাফায় শ্রম ও সময় দিতে হয়।
৩. সুদ নিশ্চিত ও নির্ধারিত।
মুনাফা অনিশ্চিত ও অনির্ধারিত।
৪. সুদে কোনো লোকসানের ঝুঁকি নাই।
মুনাফায় লোকসানের ঝুঁকি আছে।
৫. সুদ বারবার নির্ধারণ করা যায়।
মুনাফার ক্ষেত্রে তা করা যায় না।

৪. ইসলামি ব্যাংকিং ও প্রচলিত ব্যাংকিং কর্মকান্ডের সাদৃশ্য নিয়ে বিভ্রান্তি
ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ‘বাই’ বা ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতির সাথে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের ঋণ প্রদান পদ্ধতির ক্ষেত্রে দৃশ্যত কোনো কোনো মিল পরিলক্ষিত হতে পারে। এ মিল বা সাদৃশ্য দেখে দুটিকে কোনোভাবেই এক বলে মনে করে নেয়া ঠিক নয়, কারণ দুটি পদ্ধতির মধ্যে বাহ্যিকভাবে কিছু মিল থাকলেও পদ্ধতি দুটি এক নয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের সাথে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের বহু বিষয়ে সাদৃশ্য থাকা নিতান্তই স্বাভাবিক, কিন্তু তাদের মধ্যে আসল পার্থক্য বিশ্বাস ও কর্মপদ্ধতিতে। ইসলামি ব্যাংকিং আল্লাহর বিধান ও শরিয়াহকে মানবজাতির কল্যাণের উৎস রূপে বিশ্বাস করে এবং সে অনুযায়ী যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রচলিত ব্যাংকিংয়ে এ ধরনের বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায় না, মুনাফা অর্জনই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, ইসলামি ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকের সাথে কখনো সুদ দেয়া বা নেয়ার চুক্তি করা হয় না। সুদের পরিবর্তে বাই মুরাবাহা, বাই মুয়াজ্জাল, বাই সালাম, বাই ইসতিসনা, মুদারাবা, মুশারাকা, ইজারা ইত্যাদি শরিয়ত অনুমোদিত ব্যবসায়িক চুক্তি করা হয়। ইসলামি ব্যাংকিং ও সুদভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের মৌলিক পার্থক্য এ সকল চুক্তির মধ্যেই নিহিত। চুক্তির মাধ্যমেই গ্রাহক ও ব্যাংকের স্ট্যাটাসে পরিবর্তন আসে। সুদভিত্তিক ব্যাংক ঋণ প্রদান করে তার বিনিময়ে সুদ গ্রহণের চুক্তি করে। পক্ষান্তরে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে করা হয় কখনো পণ্য বিক্রয় চুক্তি, কখনো ইসতিসনা চুক্তি, মুদারাবা চুক্তি, মুশারাকা চুক্তি ইত্যাদি। সুদভিত্তিক ব্যাংক যেখানে গৃহ নির্মাণ ঋণ দেয়, সেখানে শরিয়াহ নির্ভর ব্যাংক গৃহ নির্মাণের জন্য গ্রাহকের সাথে ইজারা বিল বাই তাহতা-শিরকাতিল মিল্ক বা HPSM চুক্তি করে।

এভাবে শরিয়াহ্ সম্মত চুক্তির মাধ্যমে গ্রাহক ও ইসলামি ব্যাংকের মধ্যে সুদদাতা ও সুদগ্রহীতার বদলে কখনো ক্রেতা ও বিক্রেতা, কখনো মুদারিব ও সাহিব-আল-মাল, কখনো ব্যবসায়িক ও অংশীদার, কখনো মালিক ও ভাড়াটিয়া, কখনো অর্ডারকারী ও নির্মাতা বা সরবরাহকারী, আবার কখনো শ্রমিক ও মজুর সম্পর্কের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে গ্রাহক ও ব্যাংকের উভয় পক্ষের উপর শরিয়াহর বিভিন্ন রকম অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়। এগুলো পালন করার কারণেই শরিয়াহ নির্ভর ব্যাংকের আয়-উপার্জন সুদ না হয়ে মুনাফায় পরিণত হয়।

৫. অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের নির্ধারিত হারে মুনাফা প্রদান সম্পর্কে ভুল ধারণা
একটি বহুল প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, ইসলামি ব্যাংকসমূহে টাকা জমা রাখলেও তারা শতকরা নির্ধারিত হারে মুনাফা প্রদান করে। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যাংক টাকা জমা রাখলে যেমন নির্ধারিত হারে সুদ দেয়া হয়, তেমনিভাবে ইসলামি ব্যাংকসমূহেও নির্ধারিত হারে মুনাফা দেয়া হয়। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, ইসলামি ব্যাংকিং সম্পর্কে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ইসলামি ব্যাংকসমূহে টাকা রাখলে নির্দিষ্ট হারে (যেমন: ৬%, ৭%, ৮%, ইত্যাদি) মুনাফা দেয়ার কোনো পদ্ধতি আদৌ নেই। ইসলামি ব্যাংকে আমানতকারীদের মুনাফা ব্যাংকের অর্জিত মুনাফা ও ক্ষতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং মুনাফার হার সেভাবে উঠা-নামা করে।

ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মুদারাবা ভিত্তিতে জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা জমা নেয়ার পর জমাকারীদের বলা হয় সাহিব-আল-মাল (মূলধনকারী) আর ব্যাংককে বলা হয় মুদারিব (ব্যবসা পরিচালনাকারী)। ইসলামি ব্যাংকসমূহ উক্ত মুদারাবা ফান্ড শরিয়াহ্ অনুমোদিত বিভিন্ন পন্থায় বিনিয়োগ করে থাকে। লাভ লোকসান হিসাব করার জন্য বছরের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। গ্রাহকের সুবিধার্থে ব্যাংক বছরের শেষ দিন পর্যন্ত গ্রাহককে আটকে না রেখে বিগত বছরের লাভের আলোকে একটা আনুমানিক লাভ (প্রভিশনাল রেটে) গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে দিয়ে দেয়। বছরের শেষে হিসাব চূড়ান্ত হওয়ার পর গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে লাভের বাকি অংশ (যদি থাকে) দিয়ে সমন্বয় করা হয়। অনুমিত লাভের চেয়ে প্রকৃত লাভ কম হলে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে তা কেটে সমন্বয় করা হয়। আর ইসলামি চুক্তি অনুযায়ী আল-ওয়াদিয়াহ হিসেবে কোনো মুনাফা প্রদান করে না।

৬. বিনিয়োগ হিসেবে নির্ধারিত হারে মুনাফা ধার্য সংক্রান্ত ভুল ধারণা
ইসলামি ব্যাংকিং সম্পর্কে আরেকটি ভুল ধারণা হচ্ছে, ইসলামি ব্যাংকসমূহ থেকে বিনিয়োগ নিলে প্রচলিত ব্যাংকের মতোই নির্ধারিত হারে মুনাফা দিতে হয়। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে প্রচলিত ব্যাংকের সুদ সবসময় নির্ধারিত ও শতকরা হারে ধার্য করা হয় বলে অনেকের মধ্যে এ ধরনের একটা বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, নির্ধারিত ও শতকরা হারে ধার্য হলেই তা সুদ। এ বদ্ধমূল ধারণা আসলে ঠিক নয়। ইসলামি ব্যাংকিং ক্রয়-বিক্রয় নির্ভর একটি ব্যাংকিং পদ্ধতি যেখানে মূলধনের উপর নির্ধারিত লাভ করার একটা শরিয়াহ্ সম্মত হালাল ব্যবসা পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়, পদ্ধতিটি হ’ল বাই-আল মুরাবাহা।

৭. লাভ লোকসান বহন করা বা না করা সম্পর্কে ভুল ধারণা
ইসলামি ব্যাংকিং সম্পর্কে আরেকটি ভুল ধারণা হ’ল, ইসলামি ব্যাংকিংয়ে কোনো লোকসান বহন করা হয় না। প্রকৃতপক্ষে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। অর্থাৎ গ্রাহকের লোকসান হলে শরিয়াহ নির্ভর ব্যাংকসমূহ তা কখনো বহন করেনা এমনটি নয়। মনে রাখতে হবে ইসলামি ব্যাংক হচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং তারা ইসলামের বিধান ও আইন অনুসরণ করেই ব্যবসা পরিচালনা করে। ইসলামি শরিয়াহ্ যে সকল পদ্ধতিতে ব্যবসা করা বৈধ ঘোষণা করেছে, ইসলামি ব্যাংক কেবল সে সকল ব্যবসা পদ্ধতিরই অনুসরণ করে থাকে। ইসলামি ব্যাংকসমূহ মুদারাবা ও মুশারাকা পদ্ধতিতে যে বিনিয়োগ করে, সেখানে আনুপাতিক হারে লাভ লোকসানের অংশ বহন করে থাকে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ইসলামি ব্যাংক ও গ্রাহকগণের মধ্যে যে পার্টনারশিপ সম্পর্কের সৃষ্টি হয় সেখানে মূলধন প্রদানকারী হ’ল ব্যাংকের গ্রাহক আর ব্যাংক হ’ল তার পরিচালনাকারী। এক্ষেত্রে লাভ-লোকসানের বণ্টন পার্টনারশিপ চুক্তির নির্ধারিত হারেই হতে হবে। ব্যাংক মুনাফা করলে গ্রাহক যেমন তার বিনিয়োগকৃত মূলধনের বিনিময়ে মুনাফা অর্জন করবে ঠিক একইভাবে ব্যাংক সেই মূলধনের পরিচালনাকারী হিসেবে পারিশ্রমিক গ্রহণ করবে। অন্যদিকে লোকসানের ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগকারী তার মূলধনের উপর লোকসান বহন করবে আর ব্যাংক তার পরিচালনাকারী হিসেবে পারিশ্রমিক প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হবে। তাই ব্যাংকের ক্ষেত্রে আর্থিক লোকসান দৃশ্যমান হয় না।

৮. সকল পণ্যে একই হারে লাভ নির্ধারণ করা সম্পর্কে ভুল ধারণা
ইসলামি ব্যাংকিং সম্পর্কে আরেকটি ভুল ধারণা হ’ল, বাস্তবে যারা ব্যবসা করেন তারা সকল পণ্যে একইরকম মুনাফা অর্জন করেন না, বিভিন্ন আইটেমে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ লাভ করেন। আবার তারা সকল ক্রেতার থেকে সমান দামও রাখেন না। অথচ ইসলামি ব্যাংকিং যদি ব্যবসা নির্ভরই হয় তবে কোনো মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে কেন সকল পণ্যের উপর একই পরিমাণ লাভ দিতে হয়। এ বিষয়ে দেখা দরকার লাভ নির্ধারণের ক্ষেত্রে শরিয়াহ্ কি বলে। কোন পণ্যে কত লাভ করা যাবে এরূপ কোনো নির্দেশনা কুরআন বা হাদিসে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ চালে কত, ডালে কত, ধান, আটা যব, লবণ, কোনটিতে কত লাভ করা যাবে, এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা কুরআন হাদিসে নেই। আবার সকল পণ্যে এক রকম লাভ করা যাবে না এরূপ কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই। আসলে শরিয়াহতে বিষয়টিকে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কারণ লাভ নির্ণয়ের বিষয়টি নির্ভর করে স্থান-কালপাত্র ভেদে। তবে মুনাফাখোর তথা অধিক মুনাফা (অযৌক্তিক মুনাফা) অর্জনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

৯. খেলাপি গ্রাহকের ক্ষতিপূরণ আরোপে সুদি ব্যাংকের চক্রবৃদ্ধির সাদৃশ্য সম্পর্কে বিভ্রান্তি
ইসলামি ব্যাংকিং বিষয়ে আরেকটি ভুল ধারণা হ’ল, কোনো গ্রাহক নির্ধারিত সময়ে পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে অতিরিক্ত সময়ের জন্য পাওনা টাকার উপর নির্দিষ্ট হারে ক্ষতিপূরণ আরোপ করে। এক্ষেত্রে প্রচলিত সুদি ব্যাংকের সাথে তাদের আচরণ ও পদ্ধতির তেমন কোনো পার্থক্য নেই। নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ না করলে শরিয়াহ্র বিধান সম্পর্কে জানলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেন-
وَ اِنۡ کَانَ ذُوۡ عُسۡرَۃٍ فَنَظِرَۃٌ اِلٰی مَیۡسَرَۃٍ ؕ وَ اَنۡ تَصَدَّقُوۡا خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ
অর্থাৎ ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, যদি অস্বচ্ছল হয়ে পড়ে তাহলে তাকে স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত অবকাশ দাও, আর সদকাহ্ করা (এরূপ অস্বচ্ছল ব্যক্তির ঋণ মাফ করে দেয়া) তোমাদের জন্য উত্তম। (সুরা আল বাকারা-২৮০)’

দেনাদার অস্বচ্ছল হলে মাফ করাকে পবিত্র কুরআনে উত্তম বলা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে টাকা ধার দিয়ে পাওনা টাকা মাফ করা আর মুদারাবা ব্যবসা করার চুক্তিতে মানুষের নিকট থেকে টাকা জমা নিয়ে সেই টাকা কাউকে প্রদান করে তা (মুদারিব কর্তৃক) মাফ করে দেয়া এক কথা নয়। ইসলামি ব্যাংকসমূহের যে টাকা খেলাপি গ্রাহকের নিকট পাওনা, তা কোনো ব্যক্তি বিশেষের টাকা নয়। ব্যবসার উদ্দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমাকারীদের টাকা। তারা ব্যাংকে টাকা দিয়েছে ব্যবসা করার জন্য, মানুষকে টাকা দিয়ে তা মাফ করে দেয়ার জন্য নয়। অতএব, কোথাও মাফ করার প্রয়োজন হলে তার যথার্থ শরয়ী কারণ থাকা দরকার এবং অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ের হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি অত্যন্ত ব্যাপক এবং খেলাপিদের থেকে টাকা দ্রুত আদায়ের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে এ শর ইসলামি ব্যাংকগুলোতে কম্পেন্সেশন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে একজন গ্রাহক যথাসময়ে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ না করলে মেয়াদোত্তীর্ণ হবার পর ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হয়, সুদি ব্যাংকের মতো পেনাল্টি ইন্টারেস্ট আরোপ করা হয় না। ফলে খেলাপি গ্রাহক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাংকের পাওনা পরিশোধের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়। আর এ ক্ষতিপূরণের টাকা শরিয়াহ্ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শরিয়াহ্ অনুমোদিত পন্থায় ব্যয় করা হয়।

১০. সুদি ব্যাংকের ন্যায় ইসলামি ব্যাংকসমূহ বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিদেশি ব্যাংকের সাথে সুদি লেনদেনে যুক্ত
অনেকে মনে করেন, ইসলামি ব্যাংকসমূহ বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেন যেহেতু সুদভিত্তিক, সেহেতু ইসলামি ব্যাংকসমূহকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে সুদের ভিত্তিতেই লেনদেন করতে হয়। এছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিদেশি ব্যাংকগুলো সুদ ছাড়া অন্য কিছু বুঝে না, কাজেই কেউ কেউ মনে করেন ইসলামি ব্যাংক যতই দাবি করুক তারা সুদমুক্ত ব্যাংকিং পরিচালনা করছেন, আসলে তা সম্ভব হচ্ছেনা এ ধারণাও সঠিক নয়।

কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকসমূহের সুদমুক্ত ব্যাংকিং পরিচালনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। যেমন ইসলামি ব্যাংকসমূহের বেলায় যে পরিমাণ এসএলআর (স্ট্যাটিউটরি লিকুইডিটি রিজার্ভ) বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা হয় তার বিপরীতে কোনো মুনাফা নেওয়া হয় না। এছাড়া আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বা বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে পরিমাণ সুদ আয় হয় তা ইসলামি ব্যাংকসমূহের অর্জিত মুনাফার সাথে একীভূত না করে আলাদাভাবে সন্দেহযুক্ত আয় হিসেবে নিয়ে তা জনহিতকর কাজে ও সিএসআর (কর্পোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি) কাজে ব্যয় করা হয়।

১১. বিনিয়োগ গ্রাহক থেকে ইসলামি ব্যাংকসমূহের মর্টগেজ নেয়া প্রসঙ্গে বিভ্রান্তি
মনে করা হয়, ব্যাংকে মর্টগেজ রাখার মতো যাদের কোনো সহায় সম্পদ নেই, তারা ইসলামি ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ পায় না। যাদের ব্যাংকে বন্ধক রাখার মতো পর্যাপ্ত জায়গা জমি, সহায় সম্পদ আছে, ইসলামি ব্যাংক হতে কেবল তারাই বিনিয়োগ পায়। অর্থাৎ যার কিছুই নেই তাকে উন্নয়নের জন্য ইসলামি ব্যাংক নয় বরং যার আছে তাকে আরো সম্পদশালী বানানোর জন্যই ইসলামি ব্যাংক কাজ করছে। এটাই কি ইসলামের নীতি?
প্রকৃত অবস্থা হ’ল এটি আরেকটি ভুল ধারণা। কাউকে ঋণ দিলে ঋণ আদায়ের নিশ্চয়তাস্বরূপ মর্টগেজ (বন্ধক) নেয়া কিংবা কারো নিকট বাকিতে মালামাল বিক্রয় করলে পাওনা টাকা আদায় করার নিশ্চয়তাস্বরূপ ক্রেতার নিকট থেকে কোনো সহায় সম্পদ বন্ধক নেয়া শরিয়াহ্ মতে বৈধ।

বন্ধক সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ عَلٰی سَفَرٍ وَّ لَمۡ تَجِدُوۡا کَاتِبًا فَرِہٰنٌ مَّقۡبُوۡضَۃ
অর্থাৎ ‘আর যদি তোমরা সফরে থাক এবং কোনো লেখক না পাও তাহলে বন্ধকি বস্তু হস্তগত করা উচিত। (সূরা আল বাকারা-২৮৩)’

উক্ত আয়াতে ঋণ আদায়ের নিশ্চয়তাস্বরূপ বন্ধক নেয়ার কথা বলা হয়েছে, আয়াতে সফরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হলেও শুধু সফর নির্দিষ্ট করা উদ্দেশ্য নয়। সফর ব্যতীত অন্য অবস্থায় বন্ধক নেয়া বৈধ। এ ব্যপারে সকল ইমাম একমত। কারণ রাসুল (সাঃ) মুকীম অবস্থায় (সফরে না থাকা অবস্থায়) বন্ধক রেখেছেন।

রাসূল (সাঃ) নিজে বন্ধক রেখেছেন-
‘হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এক ইহুদীর নিকট থেকে বাকিতে খাদ্য ক্রয় করেছিলেন এবং তার নিকট রাসূল (রাঃ) তাঁর লৌহ বর্মটি বন্ধক রেখেছিলেন (বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ)।’

স্বয়ং রাসূল (সাঃ) নিজের লৌহবর্ম বন্ধক রেখে খাদ্য ক্রয় করেছিলেন (বাকিতে) রাসূল (সাঃ) মূল্য পরিশোধের নিশ্চয়তা বিধান করার জন্যই বন্ধক রেখেছিলেন। তখন রাসূল (সাঃ) কোনো সফরে ছিলেন না। কুরআন ও সুন্নাহর উল্লেখিত বিধানের আলোকেই ইসলামি ব্যাংক বন্ধক নিয়ে থাকে। যেহেতু বন্ধক নেয়া শরিয়াহ্ মতে বৈধ, কাজেই ইসলামি ব্যাংকসমূহের বন্ধক চাওয়াতে আপত্তি করার কিছু নেই। এটাকে ইসলামের পরিপন্থী মনে করারও কিছু নেই।

পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলামি ব্যাংকিং নিছক কোনো ব্যবসা নয়। এটি অর্থনৈতিক শোষণ ও সুদের মহাপাপ থেকে মানবতাকে মুক্ত করা ও কল্যাণমুখী ইসলামি অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার একটি মহৎ প্রচেষ্টা। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংকিং সেক্টরের লাইসেন্স প্রদানকারী ও মনিটরিংয়ের একক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিবিআই-৪ ইসলামি ব্যাংকসমূহের কর্মকান্ড পরিদর্শনের সাথে জড়িত। ইসলামি ব্যাংকসমূহের শরিয়াহ্ পরিপালন নিশ্চিতকরণে দরকার একটি সেন্ট্রাল শরিয়াহ্ বোর্ড, রেগুলেশনের জন্য দরকার যথাযথ পলিসি এবং মনিটরিংয়ে শরিয়াহ্ ও ব্যাংকিংয়ে জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবল।

যথাযথ গবেষণার দ্বারা ইসলামি ব্যাংকিংয়ের নতুন নতুন প্রোডাক্ট আবিষ্কার ও মার্কেটিং একদিকে যেমন ইসলামি ব্যাংকগুলোকে প্রতিযোগিতায় টিকতে সাহায্য করবে অন্যদিকে শরিয়াহর পরিপালন দ্বারা সুদমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধ জনবান্ধব ইসলামি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে।

লেখকঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, এডি, এইচআরডি-১, বাংলাদেশ ব্যাংক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button