ক্ষুদ্রঋণখেলাপি ঋণবিনিয়োগ ও লোন

কৃষি ও পল্লী ঋণ আদায়ে “মৌয়াল পদ্ধতি”

গ্রামীণ শাখাগুলোতে পল্লী ঋণের অবস্থা দিন দিন প্রায় ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বেশির ভাগ ঋণ দীর্ঘদিন যাবৎ শ্রেণীকৃত হয়ে পড়ে আছে। যার ফলে ব্যাংকের আয় তো কমছেই পাশাপাশি নতুন করে বিনিয়োগ করার সুযোগও কমে আসছে। সুতরাং যে কোন উপায়ে এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

বর্তমানে শাখার প্রধানতম কাজ হওয়া উচিৎ তাদের দীর্ঘদিনের অনাদায়ী ও শ্রেণীকৃত ঋণ আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। শাখার ঋণ গুলো সিএল মুক্ত হলে রোগমুক্ত দেহের ন্যায় সাচ্ছন্দে এগিয়ে যাওয়া যায়। এ অবস্থায় গ্রামীণ শাখাগুলোকে পল্লী ঋণের ক্ষেত্রে সিএলমুক্ত করতে মৌয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।

মৌয়াল কি?
মৌয়াল হচ্ছেন মধু সংগ্রহকারী, মৌমাছি পালক অথবা মৌচাষী। যিনি ধোঁয়ার মাধ্যমে সংঘবদ্ধ মৌমাছিদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে মৌচাক থেকে মধুর অংশটুকু কেটে নিয়ে আসেন। অজস্র মৌমাছিরা চারপাশে স্বশব্দে উড়াউড়ি করে কিন্তু তাকে একটি কামড় দেয়ার সুযোগও পায় না। মৌয়াল কাজটি এমন সতর্কভাবে করে থাকেন যে, ক্ষণকাল পরই মৌমাছিরা পুনরায় আবার সেই মৌচাকেই ফিয়ে আসে এবং নতুন উদ্যেমে মধু সংগ্রহ করতে থাকে। আর মৌয়াল পুনরায় দিন গুনতে থাকে কখন তার মধু সংগ্রহের সময় আসবে। নির্দিষ্ট সময়ে মধু সংগ্রহ না করতে পারলে মৌমাছি নিজেরাই মধু খেয়ে ফেলে অথবা শুকিয়ে যায়। মৌমাছিরাও উড়ে যায় অথবা মরে যায়।

পল্লী ঋণ আদায়ে মৌয়াল পদ্ধতি কি?
সরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর আমাদের কৃষকগণ মৌমাছির মতই গাপ্টি মেরে থাকেন। স্বেচ্ছায় তারা কখনোই ঋণের টাকা পরিশোধ করতে চান না। আমাদের সঠিক তদারকীর অভাবে একটি সময়ের পর কৃষকগণ ঋণগুলো না দেয়ার নানান ফন্দি আটে, অথবা অন্য কোথাও চলে যায় বা মরে যায়। সময় অতিবাহিত করে মৌয়াল যেমন করে মৌমাছিবিহীন মধু শূণ্য শুষ্ক মৌচাক দেখে আপসোস করে। আমাদেরও ঠিক তেমনী দীর্ঘদিন পর তদারকী করতে গিয়ে কৃষকের খালি ভিটায় দাড়িয়ে শুধু আপসোস করে খালি হাতেই ফিরতে হয়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

পল্লী ঋণে মৌয়াল পদ্ধতি বলতে সাধারনত ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী কৃষকদের মধ্যে একটি আশা-নিরাশা এবং শংঙ্কার ধোঁয়াশা তৈরি করে ঋণগুলো ফেরৎ নিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে বুঝায়। ব্যাপক ভাবে বলতে গেলে- রিকভারিতে মৌয়াল পদ্ধতি হলো, শ্রেণীকৃত ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অনাগ্রহী ব্যক্তি এবং সবচেয়ে অসহায় অক্ষম ব্যক্তির নিকট থেকে যে কোন উপায়ে সর্ব প্রথম ঋণ আদায় করে তা অন্যদের সতর্কতামূলক জানিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করা।

যেভাবে মৌয়াল মৌচাকে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছিদের ছত্রভঙ্গ করে মধু পেড়ে আনে। কাজটি এমন ভাবে করতে হবে, যেভাবে করলে পুনরায় কৃষক ঋণ নিতে আগ্রহ হারাবে না এবং নতুন কৃষকরাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঋণ নিতে চাইবে। আমরা কৃষকদের বেছে বেছে পুনরায় আবার ঋণ দেব এবং মৌয়ালের মত অপেক্ষায় থাকবো কখন মেয়াদ পূর্তি হবে। সুদ-সমেত জমা নেব এবং আসলটুকু আবার তাদের ঋণ হিসেবে বিতরণ করবো।

পরিশেষে বলা যায়, মৌয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ঋণ আদায়ের এই প্রক্রিয়াকে পল্লী ঋণ আদায়ে মৌয়াল পদ্ধতি বলে।

আরও দেখুন:
জেনে নিন যে ১০টি ভুলে পারসোনাল লোন হয় না
জামানত নিয়ে ব্যাংকের বিড়ম্বনা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
ঋণ খেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট করুন
ব্যাংক লোন নেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস

মৌয়াল পদ্ধতিতে কতগুলো বিষয় আবশ্যক
১. শাখাতে গুড টিম-ওয়ার্ক থাকতে হবে।
২. শাখার সেবাদান কার্যক্রমে পজেটিভ দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে হবে।
৩. এ কাজে সাহায্যকারী পক্ষসমূহের সাথে একটি সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। এবং
৪. সর্বক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের শতভাগ সৎ থেকে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করতে হবে।

মৌয়াল পদ্ধতির প্রয়োগ
মন্দ ঋণ গুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেলো, দীর্ঘদিনের অনাদায়ী ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে সাবেক মেম্বার জনাব আবুল হাসেম (ছদ্মনাম) নামের ব্যক্তিটি সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং চতুর। ২০০৮ সালে তিনি নিজ নামে ৪০,০০০ টাকা কৃষি ঋণ নিয়েছিলেন। কয়েক বছর পর পর জনাব হাসেম তার ঋণ হিসাবে ৫০০ অথবা ১০০০ টাকা করে জমা দিয়েছেন। ২০১৮ সাল নাগাদ তার বকেয়া প্রায় দ্বিগুণ। ধারনা করা যায়, খুব বিপদে না পড়লে সে ব্যাংকের কাছাকাছি ঘেষেন না।

আমরা জনাব হাসেমকে টার্গেট করে এগুতে লাগলাম। পনের দিনের মধ্যে তার সাথে আমার তিন বার দেখা হয়েছে, চা খাওয়া হয়েছে কিন্তু একটি বারও তার ঋণের ব্যাপারে জানতে চাইনি। সে হয়তো ভেবেছে তার ঋণের বিষয়ে আমরা অবগত নই। যতবারই দেখা হয়েছে অন্য ঋণ গ্রহীতাদের ব্যাপারে তার কাছ থেকে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করেছি। তার পরামর্শ মোতাবেক কয়েকটি ঋণ আদায়ের পর্যায় এসেছে। এরি মধ্যে জনাব হাসেম এর সাথে আমাদের একটি চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।

তার সাথে চতুর্থবারের দেখাটি হয় আমাদের শাখায়। সে নিজে ব্যাংকে এসেছে। কুশল বিনিময়ের পর সে বলল “ম্যানেজার সাব, আপনাকে বলা হয়নি, আমার নামে একটি লোন আছে, একটু দেখবেন কত টাকা হয়েছে?”

আমি অবাক হলাম! কি বলেন? আপনার নামে আমাদের শাখায় ঋণ আছে? তারপর খেলাপি ঋণের তালিকাটি একটু নেড়েচেড়ে হঠাৎ আৎকে উঠার অভিনয় করলাম। বললাম হাসেম ভাই, ব্যাপারটি আপনার মত লোকের জন্য মানানসই নয়। এই যে তালিকাটি দেখছেন, এটি মামলার জন্য প্রস্তুতকৃত তালিকা। আমাদের হেড অফিস থেকে পাঠিয়েছে। আগামী সপ্তাহে আমাকে নিশ্চিত মামলা করতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই আমার কাছে। ঠিক তার দুদিন পর সে ঋণের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন। মজার বিষয় হলো, পরে জানতে পারলাম তিনি উপরোক্ত টাকা কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আমাদের ঋণ পরিশোধ করেছেন।

এবার হাসেম ভাইকে যখম ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে আর বাদ থাকবে কে? তিনি নিজে আমাদের আগে দৌড়াচ্ছেন ঋন আদায়ের জন্য। আমরা কেবল তাকে একটু সম্মান দেখাচ্ছি এবং মাঝে মধ্যে একটু-আধটু চা-নাস্তা খাওয়াচ্ছি। অতপর পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক হাসেম মেম্বারকে নিয়ে গেলাম আমাদের মন্দ ঋণ তালিকার সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি, হরিদাস এর বাড়িতে।

নৌকা চালিয়ে সংসার চালায় হরিদাস। ব্যাংকের নিকট তার দায় ৩৭০০ টাকা। হরিদাসের দুঃখের কথা শুনে হাসেম ভাইকে বললাম কি করা যায়? সে বলল, কি করবেন স্যার গরিব মানুষ! কোন একটা ব্যবস্থা করেন।

হরিদাসকে জিজ্ঞেস করলাম কত টাকা দিতে পারবে। সে জানালো এই মহূর্তে ১০০০ টাকা দিতে পারবে। আমি আমার পকেট থেকে ২০০০ টাকা এবং আমার আরেক কর্মকর্তার কাছ থেকে ৭০০ টাকা নিয়ে তার নামে ৩৭০০ টাকার জমা শ্লিপ দিয়ে আসলাম। হরিদাসের ঋণটিও নিল হলো।

এতোদিন হাসেম মেম্বারের কারনে অন্যরাও ঋণ পরিশোধ করতে প্রয়োজন বোধ করেন নি। আজ যখন সে নিজে বলছে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে দিতে হবে, অন্যরা দিতে বাধ্য। ব্যাপারটি তাই হলো। মাত্র দু’মাসের মধ্যে আমাদের শাখার সিএল শূণ্য হয়ে গেলো।

সুতরাং কৃষি ও পল্লী ঋণ আদায়ে “মৌয়াল পদ্ধতি” একটি কার্যকর ঋণ আদায় পদ্ধতি হতে পারে।

লেখকঃ মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন; ব্যবস্থাপক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, বাতাকান্দি শাখা, কুমিল্লা উত্তর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button