মহামারীতে ব্যাংকিং সেবা ও আমার সহকর্মীর জন্য যাতনা
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। নিস্তব্ধতায় আঁধার ভেঙ্গে বারান্দায় একাকী দাঁড়িয়ে আছি। দূরের ল্যাম্প পোস্টের এক ঝিলিক আলো সাড়া জাগাতে পারে না। অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকা প্রকৃতিকে একটু অস্ফুটই মনে হচ্ছে। তাই নির্জন প্রকৃতি কেমন যেন একটু অগোছালোই রয়ে গেছে। মনে হচ্ছে মলিনতার ছাপ ভেসে বেড়ায়। মাঝে মাঝে কিছু মানুষের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়।
কয়েকদিন হলো লক ডাউন উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তাই হয়তো বাইরের পরিবেশ অবলোকনের জন্য ব্যস্ত মানুষগুলো অধৈর্য্য হয়ে বাইরে চলে আসছে। মাঝে মাঝে পাশের রাস্তাটি দিয়ে দু’একটা গাড়ির শব্দ ধেয়ে আসে। গাড়ির পিছনের দুটি অস্পুট লাল বাতি কেমন যেন অস্পষ্টতার মোড়ে ঢাকা থাকে। অন্ধকারের মূঢ়তাকে ছাপিয়ে গাড়িগুলো যতই দূরে যাচ্ছে পেছনের বাতি দু’টি ততই যেন নির্জনতার গহীনতাকে আরও বেশি জানান দিচ্ছে।
সত্যি, এভাবেই নির্জনতায় কিংবা নিস্তব্ধতায় বার বার বহমান দিনগুলো পার করতে হচ্ছে আতঙ্কের মাঝে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সঙ্কটময় মুহূর্ত পার করছি। তাই অনেকদিন যাবৎ মনটা অস্বস্তিতে ভুগছে। যুগে যুগে মহামারী বা মড়কের (আগেকার দিনে মহামারীকে মড়ক হিসেবেই মানুষ চিনতো) কথা মুখে মুখে শুনেছি কিংবা গল্প উপন্যাসে পড়েছি। ভীত সন্ত্রস্ত হওয়ার মতো পরিবেশ কখনো অনুভব করতে পারিনি।
ভাবনার স্ফূরন ঘটাতে পারিনি তখনকার দু:সময়ের বারতায়। তবে বর্তমান সময়ের সঙ্কটময় মুহূর্তে আতঙ্কিত না থেকে পারা যায় না। অগোছালো মনটাকে দমিয়ে রাখা কষ্টসাধ্যই বটে। ব্যাংকে চাকরি করার ফলে আতঙ্কের অশনি সংকেত আরো বেশি তাড়া করে।
ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন। |
দেশে ক্রান্তিকালীন কিংবা সঙ্কটময় মুহূর্ত যাই আসুক না কেন ব্যাংকারদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। দুর্যোগ পরবর্তী আরো কঠিন সময়ের আবর্তনে ব্যাংকাররা চালিকা শক্তির বাহক হিসেবে দাঁড়াতে পারে। প্রকৃত যুদ্ধ তখনই ধেয়ে আসে। দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে ঋণ প্রদান করে অর্থনীতির ছন্দটুকু পুনরুজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করা হয় ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমেই। মহামারীর সময়ে কিছুদিন আগেও যখন সরকারী অন্যান্য অফিস আদালত বন্ধ ছিল ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চালু রাখা হয়েছিল।
অর্থনীতির সাথে ব্যাংকের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিধায় ব্যাংক বন্ধ থাকলে সর্বক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যাংকের দায়বদ্ধতা থাকতেই হবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সর্বাত্মক দায়িত্ব পালণ করে চলছে। লকডাউন উপেক্ষা করে ব্যাংকিং সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে।
ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ (Banking News Bangladesh. A Platform for Bankers Community.) প্রিয় পাঠকঃ ব্যাংকিং বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ব্যাংকিং নিউজ বাংলাদেশ এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। |
আমি একজন ব্যাংকার, তাই কষ্টের সীমানাটা বুঝি। অন্য কেউ হয়তো সে কষ্টটুকু আঁচ করতে পারবে না। কষ্টের মাঝেও রকমফের আছে। তবে সে কষ্ট যে কায়িক শ্রমের কষ্ট নয়। সেখানে আছে না বলার কষ্ট; মানসিক যাতনা আর ত্যাগ-তিতিক্ষার কষ্ট।
তাই সঙ্কটময় এই মুহূর্তে অনেকটা আতঙ্কিত হয়েই অনেকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। সব সময় মনের মাঝে একটি ভয় কাজ করে। মনের মাঝে মলিনতার ছাপ ফেলে দেয়। কিছু কিছু সহকর্মীদের মাঝে এত অসহায়ত্বের ছাপ আগে দেখিনি। জীবন-জীবিকার পার্থক্য বোধহয় এমন অসাম্যতেই ঠেকে।
তারপরও চালিয়ে যেতে হয় ব্যাংকিং কার্যক্রম। এই কঠিন সময়ের আবর্তনে ব্যাংকে টাকা জমার চেয়ে উত্তোলনের পরিমাণ বেশি বলেই টাকার যোগানও ঠিকমতো চালিয়ে রাখতে হয়। এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সুচারুরূপে সম্পন্ন করা কষ্টসাধ্যই বটে।
ঈদের আগমুহূর্তে রেমিট্যন্সের প্রবাহ বাড়তে থাকে। টাকার চাহিদার প্রেক্ষিতে বারবার যোগান দিতে হয়। মানুষদের ভীড়ে কোন কোন গ্রাহক ভ্যাবাচেকা খেয়ে মাস্ক পড়ে ব্যাংকে আসে। ব্যাংকের ভিতরে এসে মনে হয় হাফ ছেড়ে বেঁচে যায়, তাই হয়তো প্রকৃতির সুধা পান করার জন্য নাকের উপর থেকে মাস্ক সরিয়ে মুখটা শুধু ঢেকে রাখে। অস্বস্তির পালাবদল মনে হয় ব্যাংকেই বারবার তৈরি হয়। আমরা (ব্যাংকাররা) যাতনা সইতে পারি, হাসিমুখে বরণ করতে পারি, হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে জয় করতে পারি। দেখতে দেখতে সহনশীল হয়ে গিয়েছি।
দেশে আস্তে আস্তে লকডাউন উঠে যায়। লকডাউন উঠা মাত্র মানুষ রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ওদিকে সংক্রমনের গ্রাফটাও দিন দিন উপরের দিকে উঠে আসছে। ভয়ার্ত মনের মাঝে খোঁজে ফিরি না বলার ভাষা। যেন আতঙ্কের গ্লানিতে বারবার পড়তে হয়েছে!
যাতনা বারবার তাড়া করতে থাকে। ব্যাংকের কোন এক সহকর্মীর সংক্রমনের খবর শুনে মনে বিষণ্নতা চলে এলো। যে প্রতিনিয়ত কষ্ট করে সেবা দিতে গিয়ে সংক্রমনে আক্রান্ত, তার জন্য কষ্ট তো হবেই। কয়েক দিন ধরেই তার সাথে ফোনে কথা হতো। কুশলাদি জিজ্ঞেস করতাম। একাডেমিকভাবে একই বিদ্যাপীঠে পড়েছি বিধায় ছোট ভাইয়ের মতই মনে হয়েছে। তাই অজান্তেই তার প্রতি একটু অন্যরকম ভালবাসা কাজ করতো।
যে ভালবাসায় ঠাঁই পেয়েছে স্নেহ আর গভীর মমত্ববোধের মিশেল! হঠাৎ করে এমনটা শুনে আঁৎকে উঠি। বার বার ফোন দিয়ে অস্বস্থিতে না ফেলতে নিরব থাকি। তর সইতে না পেরে বিষণ্নতায় ভুগি। তবে, লেখাটি লেখার মুহূর্তে তার সাথে ফোন কথা হয়। আঁচ করতে পারি কোন সমস্যা হবে না। তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। আশা করছি আমাদের মাঝে আমাদের সহকর্মী হিসেবে আবার অফিসে যোগদান করে পুর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করবে।
এরই মাঝে অনেক ব্যাংকার সংক্রমিত হয়েছে। কেউ সুস্থ হয়ে মলিনতার মাঝে আবারও কর্মোদ্যমে ব্যাংকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কি জানি তাদের মনটা এখনো নিরবে নিভৃতে কাঁদে। তারপরও বেঁচে থাকার মাঝে সান্ত্বনা খোঁজে পায়। মাঝে মাঝে কেউ হয়তো জানান দেয় দীর্ঘশ্বাসের বারতায়। জীবন প্রদীপের পাদ পদ্মে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। কারো মুখে ভেসে আসে কালো ছায়া।
অন্যদিকে সমাজের কারো অর্থনীতিতে কালো থাবায় আচ্ছন্ন। সবকিছুই ভাবান্তরে চলে আসে। তারপরও চালিয়ে যেতে হয় জীবন। হয়তো কোন একদিন থেমে যাবে সংক্রমনের হার। কারো মুখে থাকবে না দুশ্চিন্তার লেশমাত্র। সবাই চলবে আবারো নিজের উদ্বেগে কর্মক্ষেত্রে কৌতুহলকে জানান দিয়ে। স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হবে আবারও কর্মময় জীবন। ব্যক্তি স্বতন্ত্রে ফিরে আসবে প্রাণচাঞ্চল্য কর্মক্ষেত্র।
আমাদের আশা, আবারও পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে আসবে। পাখির কলকাকলিতে ভোরের ঘুম ভেঙ্গে যাবে। ভোরের সূর্যোদয়ের মাঝে অমানিশার কালো আঁধার ঢেকে যাবে। প্রকৃতি হেয়ালীপনায় মেতে উঠবে। রাঙানো বসন্তে ফিরে আসবে নতুনত্বের বারতা। ব্যাংকে নতুনভাবে কাজ করার উদ্যমতা ফিরে আসবে। প্রতিদিনের মতো গ্রাহকদের চাহিদা বেড়ে যাবে। ভাবলেশহীনভাবে বয়স্ক ক্যাশ অফিসার টাকা গুণতে থাকবে।
আমার সহকর্মীর মাঝে আবারও ফিরে আসবে প্রাণচাঞ্চল্য, দেখা যাবে কর্মক্ষেত্রে। সেবা দিয়ে যাবে পুর্ণোদ্যমে! তাই যেন হয় প্রিয় সহকর্মী আশিক, ভবিষ্যতের শুভ কামনায়।
অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক। প্রিন্সিপাল অফিসার, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, বন্দর বাজার শাখা, সিলেট।