ব্যাংকিং

ব্যাংকিং ল এ্যান্ড প্রাকটিসঃ কেইস স্টাডি-১

ব্যাংকিং ল এ্যান্ড প্রাকটিস-কেইস স্টাডি-১: ক’দিন আগে একটি সুদবিহীন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে একজন কর্মকর্তা ফোন করলেন। আমার মাঝে মধ্যে ওখানে ক্লাস নেয়ার সুযোগ হয়েছিল, সেই সুবাদেই তাদের সাথে পরিচয়। পরামর্শ চাইলেন যে, এই কেইসটি কিভাবে নিস্পন্ন করবেন? দুই জনের একটি যৌথ হিসাব এবং যৌথ স্বাক্ষরে অপারেশন। অনাত্মীয় একজনকে নমিনী করা আছে। একজন মারা গেছেন, এখন নমিনী টাকা চাইছেন। এমতাবস্থায় ব্যাংক কি করবে? আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে পরামর্শ দিয়েছি, মনে হলো তারা খুশী হয়েছেন। যাই হোক, সমস্যাটি ব্যাংকার্সদের সামনে উপস্থাপন করলাম। আপনি কি করবেন বা করতেন?

সমাধান: ফেসবুকে একটি সমস্যা উত্থাপন করেছিলাম যৌথ হিসাবের একজন অপারেটর মারা গেলে, নমিনির দাবী ব্যাংক কিভাবে নিস্পন্ন করবেন সেই সংক্রান্ত। বিষয়টি অনেকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবং প্রচুর মন্তব্য বা মতামত দিয়েছেন আমাদের ব্যাংকার সহকর্মীরা। এদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবিও আছেন দেখলাম। এর মধ্যে দু’য়েকজন অবশ্য অপ্রাসঙ্গিকভাবে সুদবিহীন ব্যাংক শব্দটি দেখে কিছু ট্রল করারও চেষ্টা করেছেন। এগুলো আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। সেই ১৯৮৫ সাল থেকেই তো এসমস্ত ট্রল আমরা হজম করে এসেছি। আর ইতোমধ্যে ২৫ শতাংশেরও বেশি মার্কেট শেয়ার ইসলামী ব্যাংগুলো আয়ত্বে নিয়েছে। নিবন্ধটি আপনি পড়ছেন ব্যাংকিং নিউজ বিডি ডটকম-এ। বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংকিং সনাতনী ব্যাংক ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি growth rate নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে।

ক’দিন আগে দেখলাম বাংলাদেশ সরকারও সুকুক বা ইসলামী বন্ড ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। ম্যানেজার থাকা কালীন ১৯৯৬ সালের দিকেই এক গ্রাহকের মায়ের জানাজায় শরীক হয়েছিলাম। শহরের খুবই প্রমিনেন্ট ব্যবসায়ী। অনেক লোকই এসেছেন জানাজায়। বেশ ধনাঢ্য একজন যুবক ব্যবসায়ীর গলায় বড়সড় একটি সোনার চেইন দেখে আরেকজন বলে বসলো ‘তুমি চেইন গলায় দিয়ে জানাজা পড়তে এসেছো, জানো পুরুষের সোনার অলংকার ব্যবহার করা হারাম।’ চেইনধারী বললেন, ‘আরে বেটা বলে কি? হারাম হালাল আছে খাওয়ার ব্যাপারে, আর কোনো বিষয়ে হালাল হারাম আছে নাকি?’ এখন ইসলামের বিষয়ে এই যাদের জ্ঞানের বহর, তাদের কাছ থেকে ট্রল শুনলে আমাদের হাসিই পায়। যাকগে সে কথা মূল প্রসঙ্গে আসি:

যে ব্যাংক কর্মকর্তা আমাকে সমস্যাটি জানিয়েছিলেন, তাকে আমি তাৎক্ষনিক আমার মতামত দিয়েছিলাম যে, টাকা কেবলমাত্র নমিনিকেই দিতে পারে ব্যাংক। অন্য কাউকে দেয়ার আপাতত কোনো সুযোগ নেই ব্যাংকিং নিয়মে। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে ব্যাংক হিসাবধারীদের মধ্যে যিনি জীবিত আছেন তার থেকে একটি লেটার অব ইনডেমনিটি নিতে পারেন যদি তার কোনো আপত্তি না থাকে।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

এবারে আসুন আমার মতামতের পিছনের কারনগুলো দেখি। ব্যাংকার কাস্টমার রিলেশনশিপের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয় তিনটি বিধি দ্বারা। হিসাব খোলা হয় The contract Act 1872 এর ভিত্তিতে। ব্যাংকিং অপারেশন্স তথা লেনদেন নিয়ন্ত্রিত হয় Negotiable Instrument Act 1881 এবং এর সর্বশেষ সংশোধনী সমুহ এবং ব্যাংক কোম্পানী আইন এর ভিত্তিতে। একজন ব্যাংকারকে এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। Contract Act অনুযায়ী হিসাবধারী মারা যাওয়ার সাথে সাথেই Contract বা চুক্তি তার কার্যকারিতা হারায়। যৌথ হিসাবের ক্ষেত্রেও একজন মারা গেলে চুক্তি বলবৎ থাকে না। এমনকি Either or Survivor নির্দেশনা থাকলেও একজন মারা গেলে সেই এ্যকাউন্ট আর অপারেট করার সুযোগ থাকে না। সেখানে সুবিধা হলো, যিনি জীবিত থাকেন তিনি প্রয়োজনীয় দলিল পত্র জমা দিয়ে একটি Single transaction এর মাধ্যমে ব্যালেন্সটা তুলে নিতে পারেন, কোনো জটিলতা ছাড়াই।

কিন্তু যেখানে যৌথ অপারেশন সেখানে একজন মারা গেলে অপরজনের আর কোনো সুযোগ নেই লেনদেন করার। নমিনি যখন করা হয়েছিল, তখন দু’জনের সিদ্ধান্তেই করা হয়েছিল। সেখানে আত্মীয় অনাত্মীয় কোনো বিষয় নয়। এখন একজনের পক্ষে সেই নমিনির বিষয়ে কোনো দ্বিমত করার অবকাশ নেই বা করলেও তা আইনে টিকবে না। সুতরাং ব্যাংকারের কাছে এখন টাকা পরিশোধের বৈধ দাবীদার হচ্ছেন নমিনি। আমার মন কি বলে, অথবা কি হওয়া উচিত এটি দিয়ে আইন চলে না। কাজেই অর্ধেক টাকা জীবিত হিসাবধারী পাবেন এমন ইজতিহাদ করার সুযোগ আইন ব্যাংকারের জন্য রাখেনি। নমিনি ছাড়া অন্য কাউকে পরিশোধ করারও কোনো সুযোগ ব্যাংকারের কাছে নেই।

কেননা চুক্তি হয়েছিল হয় দুইজনে নিবে; নয় তো নমিনি নিবে। যেহেতু দু’জনের নেয়ার আর সুযোগ নেই, তাই নমিনিই শুধু নেয়ার অধিকার রাখেন চুক্তি বা Contract অনুযায়ী। হ্যাঁ, যদি কোনো উত্তরাধিকারী সংক্ষুব্ধ হয়ে কোর্টে যান এবং কোর্ট কোনো ভিন্ন সিদ্ধান্ত দেন, তখন ব্যাংকারের কোনো সমস্যা নেই, তিনি দায়মুক্ত। কিন্তু সাধারণভাবে ব্যাংকারের জন্য নমিনি ছাড়া অন্য কাউকে পরিশোধ করলে তিনি আইন ভঙ্গ করবেন এবং দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপবে। টাকা তুলে নমিনি হিসাবধারীদের ওয়ারিশদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দিবেন কিনা এটাও ব্যাংকারের বিষয় নয়। তবে আপোষ বন্টনের ক্ষেত্রে নৈতিক প্রভাব খাটাতে পারেন ব্যাংকার, সেটি একান্তই ঐচ্ছিক বিষয়।

আমার জানা শুনা এতটুকুই এ বিষয়ে এবং আমি একাধিক কেইস এভাবেই নিষ্পত্তি করেছি। এর বাইরেও কোনো কিছু থাকতে পারে, কারোর জানা থাকলে আইনের সূত্র উল্লেখ করে জানাতে পারেন। আমি মাষ্টারী করার জন্য পোষ্টটি দেই নি। আমি সারাজীবনই ছাত্র ছিলাম, এখনও ছাত্র। আমি ব্যাংকিংয়ে আমার জুনিয়র এমনকি সিকিউরিটি গার্ডদের কাছ থেকেও শিখেছি এবং অকপটে তার স্বীকৃতি দিয়েছি বা এখনও দেই। দুটো ব্যাংকের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এর দায়িত্বে থাকাকালীনও আমি শিখেছি এবং শিখতেই আমার আনন্দ! নিজের দিকে তাকালে আমার মনে হয় কিছুই জানি না, তাই জানার ক্ষেত্রে আমার কোনো আত্মগর্ব নেই। ধন্যবাদ সকলকে যারা বিষয়টিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন।

লেখকঃ নূরুল ইসলাম খলিফা, সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও সাবেক প্রিন্সিপাল, ট্রেইনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, আলআরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button