ব্যাংকিং

ব্যাংকিং কেবল সেবা নয়, ব্যবসাও বটে

মোশারফ হোসেনঃ যেকোনো কাজ বা উদ্যোগ- সেটা ব্যবসা হোক বা সামাজিক কর্মকাণ্ড হোক, তা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলে তার দিকে সবার দৃষ্টি পড়ে। আস্তে আস্তে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, বিভিন্ন নিয়ম-নীতি ও আইনের আওতায় আনা হয়। দেশিয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা আসে, জবাবদিহিতা বাড়ে এবং সর্বোপরি সেখানে গ্রাহকস্বার্থ তথা জনস্বার্থ সুসংহত হয়। তবে এই নিয়ন্ত্রণে ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। কারণ, এদেশে ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানের অমিত সম্ভাবনা ও অসীম প্রয়োজনীয়তা আছে। তাই নিয়ন্ত্রণ শুধু শাস্তি ও ধ্বংসের ছক কষে নয়; সংশোধন করে, পরিচর্যা করে, গাইড করে এবং টিকে থাকার সুযোগ দিয়েই করা উচিত। স্বার্থ শুধু গ্রাহকদেরই নয়, প্রতিষ্ঠান বা ইন্ডাস্ট্রির ন্যায্য স্বার্থকেও বিবেচনায় নিতে হবে। তবে আমার আলোচনার বিষয়বস্তু ইভ্যালি নয়। আমি ব্যাংকার, তাই ব্যাংক এবং ব্যাংকিং নিয়েই কিছু ভাবনার অবতারণা করব।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিবেচনায় ব্যাংক খাত দেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক খাত এবং একইসাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সেবা খাত। এই খাতকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে এক ডজনের অধিক আইন ও প্রায় অর্ধশতাধিক বিধিবিধান। এছাড়াও ব্যাংকখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারিকৃত অসংখ্য সার্কুলার ও নির্দেশনা তো আছেই। এই ধারাবাহিকতায় গত ১০ জুন, ২০২১ তারিখে বিআরপিডি সার্কুলার নং- ১১ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা মাশুলের খাত ও মাশুলের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এতে মূলত ব্যাংকগুলোর কিছু চলমান সেবার মাশুল রহিত করা হয়েছে এবং বেশিরভাগ সেবার মাশুলই কমানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ব্যাংক এবং ব্যাংকারদের জন্য শিরোধার্য। তাই সব ব্যাংককেই এ সার্কুলারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে।

এর আগে আরেক সার্কুলারের মাধ্যমে দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত গড় স্থিতির সঞ্চয়ী হিসাবের ‘হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ফি’ চলতি বছরে শুধুমাত্র একবার আদায়ের নির্দেশনাও এসেছে। ঋণের সুদহার তো ৯ শতাংশে নেমেছে গত বছরের এপ্রিল থেকেই। আবার চলতি আগস্ট মাসেই আমানতের সুদও সাড়ে ৫ শতাংশের নিচে দেওয়া যাবে না মর্মে নির্দেশনা দিয়েছে। এসব নির্দেশনার কোনোটিই ব্যাংকের অনুকূলে- এমনটা কেউই মনে করছেন না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতা গ্রাহকদের সুবিধা দেয়া হয়েছে।

কিন্তু এরপরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্নজনের ব্যাংকবিরোধী নেতিবাচক কিছু মন্তব্য চোখে পড়েছে। সম্প্রতি ব্যাংকের সেবামাশুল নিয়ে শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকার একজন পাঠকের মন্তব্য ছিল এরকম- ‘গ্রাহকরা ব্যাংকে বিশ্বাস ক‌রে আমানত রাখ‌বে- এটাই কি বেশি নয়? তাহ‌লে এত রকম চার্জ কেন? হো‌টে‌লে খে‌তে গে‌লে সালাদ, লেবু, লবণ, পা‌নি – এস‌বের জন্য কি আলাদা টাকা দেয়া লা‌গে? গ্রাহ‌কের টাকা খা‌টি‌য়ে ব্যাংক কো‌টি কো‌টি টাকা মুনাফা করবে আর গ্রাহক‌কে বি‌ভিন্ন সেবার জন্য টাকা দি‌তে হ‌বে? পয়সা দি‌য়ে সেবা পে‌তে হ‌লে গ্রাহক আমানত রাখ‌বে কেন?’ শুধু এ পাঠকই নন, কখনো কখনো একাধিক পত্রিকারও শিরোনামেও দেখেছি, ব্যাংকের সেবা ও মাশুলের সমালোচনা করতে। তাই একজন ব্যাংকার হিসেবে এ বিষয়ে কিছু কথা বলার তাগিদ অনুভব করছি।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

ব্যাংক দুই ধরনের সেবা মাশুল আদায় করে থাকে। কিছু এককালীন, আর কিছু কেস টু কেস ভিত্তিতে। তবে এত দিন কিছু কিছু সেবা মাশুলে ব্যাংক-টু-ব্যাংক অভিন্নতা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলোর সেবা মাশুলে অভিন্নতা ছিল না। একই সেবার বিপরীতে কেউ নিচ্ছিল ২০০ টাকা, কেউ নিচ্ছিল ৫০০ টাকা। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সার্কুলারটি ব্যাংকের সেবা মাশুল আদায়ে শৃঙ্খলা আনবে এবং এটা আসলে দরকারও ছিল। তবে ব্যাংকের অনেক মাশুলযোগ্য সেবা আছে, যা সর্বশেষ এই সার্কুলারে বিবেচনা করা হয়নি।

কিন্তু এরপরও প্রায়ই একটা বিষয় লক্ষ করি, আমাদের অধিকাংশই মনে করেন- ব্যাংক হচ্ছে সেবা খাত, তাই এখানে ব্যবসা করা যাবে না! বিনা মাশুলের সেবার সংখ্যা আর নিয়ন্ত্রক সংস্থার আদেশে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণও যেন তেমনটাই ইঙ্গিত করে। সোনালী ব্যাংক সরকারি খাতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিনামূল্যে ৩৭ ধরনের সেবা দিচ্ছে। নামমাত্র মূল্যে দিচ্ছে আরও ১৪ ধরনের সেবা। অর্থাৎ, সরকারকে মোট ৫১ ধরনের সেবা দেয়া হচ্ছে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে। এর মধ্যে শিক্ষাবৃত্তি, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, অতি দ্রারিদ্র্য ভাতা, ভিক্ষুক ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, অবসরভোগীদের পেনশন ভাতা, বিভিন্ন বন্ড বিক্রি, সঞ্চয়পত্র বিক্রি, বিভিন্ন উৎসব ভাতা প্রভৃতি সেবা বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বছর শেষে এই ব্যাংকটিকেও মুনাফার সূচকে অন্যান্য ব্যাংকের সাথে তুলনা করা হয়। সংবাদপত্রে শিরোনাম হতে হয় মূলধন ঘাটতির ব্যাংক হিসেবে।

সরকারি এসব সেবা ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে নিয়মিতই বিনালাভের বিভিন্ন সেবা ব্যাংকের সেবা তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। দুই বছর ধরে প্রবাসী রেমিট্যান্সের বিপরীতে দুই শতাংশ করে ইনসেনটিভ দেওয়া হচ্ছে। শুরুর দিকে তিন মাসের বকেয়া ইনসেনটিভ প্রদান করতে গিয়ে বেনিফিশিয়ারিদের ফোন করা, ডকুমেন্টস সংগ্রহ করা, রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংকের সাথে বারংবার যোগাযোগ, প্রধান কার্যালয়ে নিয়মিত রিপোর্টিং ইত্যাদি করতে গিয়ে ব্যাংকার কর্তৃক প্রতিটি বেনিফিশিয়ারিকে অতিরিক্ত সময় ও সেবা দিতে হয়েছে। এই কাজের বিনিময়ে ব্যাংক কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোনো কমিশন পায়নি, কিংবা শাখায় অতিরিক্ত কোনো ম্যানপাওয়ারও যুক্ত হয়নি।

এভাবে বিনা পারিশ্রমিকে সরকারের পক্ষে সরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোও অনেক কাজ করে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ঋণও ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই ছাড় করা হচ্ছে। এতে করে ব্যাংকের বিশেষ কোনো আয় না হলেও ব্যাংকের মানবশক্তির একটা বড় অংশ নিয়োজিত রাখতে হচ্ছে, সময় ও শ্রম দিতে হচ্ছে, নিয়মিত ঋণ কার্যক্রমের পাশাপাশি দিনরাত পরিশ্রম করে এসব ঋণ প্রস্তাব নিয়েও কাজ করতে হচ্ছে।

কিন্তু দিন শেষে মুনাফাই হচ্ছে একটি ব্যাংকের মূল লক্ষ্য। ঋণের সুদহার এক ধাক্কায় ৯ শতাংশে নামিয়ে আনায় ব্যাংক খাতের সুদ আয় কমে গেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। অথচ ঋণের বিপরীতে আদায়কৃত সুদই হচ্ছে ব্যাংকের আয়ের প্রধান খাত। করোনাকালে ব্যাংকের সুদ আয় কমানোর পাশাপাশি সুদ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে অনেক সেবা মাশুল স্থগিত করার পাশাপাশি কোনো কোনো সেবা মাশুল রহিত করা হয়েছে, আবার অনেক সেবা মাশুল কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তার মানে, ব্যাংকের ব্যবসার এখন অনেকটাই চিড়ে-চ্যাপ্টা অবস্থা।

এরপরও কিছু গ্রাহকদের মানসিকতা এমন- সেবা নিবেন কিন্তু কমিশন দিবেন না! আমরা যদি একজন সাধারণ মুদি দোকানদারের কথা চিন্তা করি, তিনি চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেলসহ হরেক পদের পণ্য বিক্রি করেন। প্রতিটি পণ্যের জন্যই আলাদা আলাদা মূল্য পরিশোধ করতে হয় ক্রেতাকে। চাল নিলে ডাল ফ্রি- বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। তাহলে ব্যাংকের ক্ষেত্রে এমনটা কেন হবে? প্রায়ই পত্রিকার সংবাদের শিরোনামে দেখি- ‘ব্যাংকের রকমারি চার্জে নাকাল গ্রাহক’। সেবা যেহেতু রকমারি, চার্জও তো রকমারি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনি চেক ডিজঅনার করতে ব্যাংকে আসলে ব্যাংক ডিজঅনার চার্জ নিবে না? একটি চেক ডিজঅনার করতে গিয়ে কি ব্যাংক কর্মকর্তার সময় ও শ্রম লাগে না? হিসাব বিবরণী প্রিন্ট দিতে কি ব্যাংকের কাগজ, কালি ও বিদ্যুৎ খরচ হয় না?

একজন ডাক্তার যিনি হাজার টাকা কনসালটেশন ফি নেন, তিনি আপনাকে কয় মিনিট সময় দেন? আর ব্যাংক পৌনে এক ঘন্টা সময় নিয়ে হিসাব খুলে কয় টাকা কমিশন নেন? ধরুন, কোনো ডাক্তার আপনাকে এক মাসের ওষুধ দিলেন। কিন্তু ২৫ দিন ওষুধ খেয়েও কোনো উন্নতি বুঝতে না পেরে আপনি আবারও সেই ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হলেন। ডাক্তার সাহেব কি আপনার কাছ থেকে ফলো-আপ ফি নিবেন না? ডাক্তারের ওষুধে কাজ হচ্ছে না বলেই তো আপনি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। তাহলে ডাক্তার আপনাকে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উল্টো আবারো আপনার কাছ থেকে ৮০০ টাকা কনসালটেশন ফি আদায় করল! সেই আপনিই যখন ব্যাংকে আসেন, তখন আপনার কতই না অভিযোগ। হ্যাঁ, বছরে দুই-তিনশ টাকা একাউন্ট মেইনটেনেন্স ফি আপনি কেন দিবেন না- আপনার বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দারোয়ানকে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন দিতে পারেন, কিন্তু আপনার কোটি টাকা পাহারা দেওয়া ব্যাংক কি ৬ মাসে ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক পেতে পারে না? আপনি হয়তো তর্কের খাতিরে বলবেন, ডাক্তারি পেশার সাথে ব্যাংকিংয়ের তুলনা চলে না। ডাক্তারি জীবন রক্ষাকারী পেশা, ব্যাংকিং জীবন রক্ষাকারী পেশা নয়। কিন্তু পাঠক, এই করোনাকালে ডাক্তারি সেবা যেমন বন্ধ থাকেনি, ব্যাংকিং সেবাও কিন্তু বন্ধ থাকেনি। অর্থাৎ ডাক্তারির মতো ব্যাংকিংও জরুরি পরীষেবা।

সেবার চার্জ পুরোটাই যে ব্যাংকের আয় বিষয়টা কিন্তু এমনও নয়। প্রতিটি সেবার জন্য ব্যাংকের মানবসম্পদ, স্থায়ী সম্পদ, প্রযুক্তি বিনিয়োজিত থাকে; প্রায় প্রতিটি সেবাতেই জড়িত আছে নেটওয়ার্কিং খরচ, কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার (সিবিএস) মেইনটেনেন্স খরচ, স্টেশনারি থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ খরচ, প্রিন্টিং খরচ, বীমা খরচ, সম্পদের অবচয়সহ বিবিধ ওভারহেড খরচ। তাই চার্জকৃত ফি এর মাধ্যমে ব্যাংকের খরচ আদায় করাটাও উদ্দেশ্য। যেমন, চেক বই ইস্যুর বিপরীতে ব্যাংক যে অর্থ আদায় করে, এটা খরচ আদায়ের উদ্দেশ্যেই করে থাকে। আবার সব সেবার জন্যই তো ব্যাংক চার্জ নেয় না। মূল ব্যাংকিং সেবায় ব্যাংক কোনো চার্জ নেয় না। যদি নিতই তাহলে আপনার হিসাবে প্রতিবার টাকা জমা বা উত্তোলনেই আপনাকে মাশুল গুনতে হতো। তাছাড়া আদায়কৃত চার্জের একটি অংশ সরকারি কোষাগারে চলে যায় ভ্যাট হিসেবে।

বাড়তি সুবিধাযুক্ত, অনিয়মিত, সমস্যাকুল বা ব্যতিক্রমী সেবার জন্যই ব্যাংক আলাদা চার্জ আদায় করে, যেমন- এ্যাকাউন্ট স্ট্যাটমেন্ট, ডুপ্লিকেট ইন্সট্রুমেন্ট ইস্যু, বিদ্যমান চেক লস্ট মার্ক করে নতুন চেক বই ইস্যু ইত্যাদিতে ব্যাংক চার্জ আদায় করে থাকে। আর সেটা যদি ব্যাংক না করতো তাহলে প্রতিবার জমা উত্তোলনের পরেই ব্যাংকের কাছে গ্রাহকরা নিজের একাউন্টের স্ট্যাটমেন্ট চাইত, কার্ডের পিন রি-ইস্যুর চার্জ যদি আদায় না করা হতো, তাহলে অনেকে পিন মনে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেন না, কেউ চেক দিয়ে টাকা উত্তোলন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতো না, চেক ছাড়াই ব্যাংকে এসে টাকা উত্তোলন করার সুযোগ চাইতো। কিন্তু ব্যাংক যেহেতু চেক ছাড়া টাকা উত্তোলন এ্যালাউ করে না, আর বিশেষ কারণে করলেও আলাদা ফি আদায় সাপেক্ষে করে, তাই কেউ সাধারণত চেক ছাড়া অর্থ উত্তোলনের দাবি করে না।

তারপরও প্রতিযোগিতার বিষয়টি মাথায় রেখে অনেক নতুন এবং ব্যতিক্রমী সেবা ব্যাংক ফ্রিতেও দিচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক পে-অর্ডার, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) সেবা দিচ্ছে ফ্রিতে, ঠিকাদারদের ফ্রিতে ইজিপি সুবিধা দিচ্ছে, বিদ্যুৎ বিল/ গ্যাস বিল/ পানি বিল/ টেলিফোন বিল রিসিভ করছে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো কমিশন আদায় ছাড়াই।

ব্যাংক সেবার বিনিময়ে মাশুল নিচ্ছে অন্য যেকোনো সেবা বা ব্যবসার ধর্ম মেনেই। কিন্তু সেবায় যতটা উৎকর্ষ বা আধুনিকায়ন করেছে সে হারের চেয়ে অনেক কম হারে মাশুল আদায় করছে বলেই আমি মনে করি। যেমন, বর্তমানে ব্যাংকিং সেবার আওতা বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে দ্রুততা। কয়েক বছর আগে একই ব্যাংকের এক শাখা হতে আরেক শাখায় টাকা পাঠানোটাই অসম্ভব ছিল। ভিন্ন ব্যাংকে টাকা পাঠানোটা ছিল ভাবনাতীত। এখন সব ব্যাংকেই অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে একই ব্যাংকের এক শাখা হতে আরেক শাখায় টাকা ট্রান্সফার বা উত্তোলন হচ্ছে নিমিষেই। ভাবনাতীত সেবাগুলোও এখন গ্রাহকরা পাচ্ছেন খুব সহজভাবে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের এনপিএসবি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আরটিজিএস, বিইএফটিএনের মাধ্যমে টাকা চলে যাচ্ছে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে! মোবাইল অ্যাপভিত্তিক ইন্টারনেট ব্যাংকিং, এটিএম, সিডিএম, সিআরএম, বায়োমেট্রিক ব্যাংকিং, কিউআর কোড ব্যাংকিং, ক্যাশ বাই কোড ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধার মাধ্যমে চেক ছাড়াই কিংবা ব্যাংকের কোনো শাখায় না গিয়েই গ্রাহকরা অর্থ স্থানান্তর ও নগদ উত্তোলন করতে পারছে নিজের মোবাইল ফোন/ কম্পিউটার, ব্যাংক কার্ড, এমনকি সিম্পলি কোড বা আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে।

এসব সেবা গ্রাহকদের কাছে সহজতম ও দ্রুততম করে পৌঁছে দিতে ব্যাংকের কি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে না? দক্ষ জনবল তৈরি এবং আইটি ও সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা ঢালতে হচ্ছে না? তাহলে এমন সব সফিস্টিক্যাটেড সেবা প্রদানের বিনিময়ে ব্যাংক কি গ্রাহকদের কাছ থেকে সেবামূল্য আদায় করার অধিকার রাখে না?

দুঃখের বিষয়- অনেক গ্রাহকই ব্যাংকিং সেবার এসব আমুল পরিবর্তন ও সহজীকরণের ভূয়সী প্রশংসা করলেও এসব যুগোপযোগী সেবার বিপরীতে মাশুল গুনতে নারাজ! অনেক গ্রাহক তো আছেনই যিনি ব্যাংককে বছরে ঋণের সুদ বাবদ কয়েক লাখ টাকা প্রদানের বিনিময়ে ব্যাংকের সব সেবার বিনে পয়সার ভাগীদার হতে চান- ঋণের সুদ ছাড়া আর কোনো কমিশনই, যেমন- পে অর্ডার কমিশন, ডিডি কমিশন, আরটিজিএস কমিশন, সলভেন্সি সার্টিফিকেট চার্জ ইত্যাদি কিছুই দিতে নারাজ!

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে নয়-ছয় নীতির কারণে ব্যাংকের আয়ের পথ অনেকটাই সংকুচিত হয়ে গেছে। তাই পিছিয়ে পড়া, হতদরিদ্র, ছিন্নমূল ও বিশেষ শ্রেণির গ্রাহকদের বিনা মাশুলে সেবা দেওয়া অব্যাহত রাখতে এবং ব্যাংকের ব্যবসায়িক বিষয়টি মেনে নিয়ে সেবার বিপরীতে আদায় করা যৌক্তিক মাশুলকে মেনে নেয়া উচিত এবং মাশুলের আওতা আরও বাড়ানো উচিত। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি নিশ্চিত করে প্রত্যেক ব্যাংকের জন্য একই সেবার জন্য অভিন্ন মাশুল হার নির্ধারিত থাকা উচিত। এতে সেবা মাশুলের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ কমবে, সচেতনতা বাড়বে এবং অধিকতর ব্যাংকিং শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হবে।

আরও দেখুন:
◾ ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরও বাড়লো
◾ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পণ্যের মূল্য অগ্রিম নিতে পারবে না
◾ ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা

লেখকঃ মোশারফ হোসেন, কলামিস্ট ও একটি তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button