ব্যাংকিং

ব্যাংকিং: সরল বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়, সতর্কতাও জরুরী

১৯৮১ সালের শেষের দিকের কথা। আমি তখন অগ্রনী ব্যাংকের শিক্ষানবীস কর্মকর্তা একই সাথে গৌরনদী শাখার সেকেন্ড অফিসারের দায়িত্বে নিয়োজিত। রেমিট্যান্স বা টাকা স্থানান্তরের মাধ্যম কেবল ডিমান্ড ড্রাফ্ট এবং টিটি বা টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার। টিটির জন্য আমরা বেন্টলী’স কোড বা সঙ্কেত ব্যবহার করতাম। এর পরে তা পোষ্ট অফিসে যেখানে টেলিগ্রাফের সুবিধা ছিল সেখান থেকে বার্তা প্রেরন করা হতো পরিশোধকারী শাখায় (paying Branch)। অনেক সময় দেখা যেতো সে টেলিগ্রাম পৌঁছতে কয়েক দিন লেগে যেতো বিশেষ করে মফস্বল শাখা থেকে। ফলে ডিমান্ড ড্রাফ্ট বা ডিডি ছিল বেশি জনপ্রিয়।

শাখার সিকিউরিটি ইনস্ট্রমেন্টের মেইন ষ্টক থাকতো ম্যানেজারের হেফাজতে, কিন্তু চলতি ষ্টক থাকতো সেকেন্ড অফিসার হিসেবে আমার কাছে। দিন শেষে সাধারণ নিয়ম ছিল ডিডি, পে-অর্ডার ইত্যাদির সামনের কাভার পৃষ্ঠায় প্রতিদিন কতটা পাতা ব্যবহৃত হয়েছে তা লিখে রাখা এবং অবশিষ্ট পাতা কতটা আছে তা গুনে দেখা এবং লিখে রাখা। অবশিষ্ট পাতার সংখ্যা লিখে সেখানে কাষ্টোডিয়ানের অনুস্বাক্ষর করতে হতো। প্রতিটি বইয়ে এক‘শ পাতা থাকতো।

এমন একটা নতুন বই মেইন স্টক থেকে পাওয়ার পর তাতে এক’শ পাতা আছে কিনা গুনে দেখতে হতো। আমি আর গুনে দেখলাম না; ভাবলাম ম্যানেজার সাহেবের কাছ থেকে আমি নিয়েছি, এখানে গুনে দেখার কি প্রয়োজন? দিন শেষে যথারীতি ব্যবহৃত পাতাগুলোর সংখ্যা বিয়োগ করে ব্যালেন্স লিখে ডিডি বইটি আমার হেফাজতেই ভল্ট রুমে একটা ষ্টীল আলমিরায় রেখে দিতাম; কিন্তু অবশিষ্ট পাতাগুলো গুনে দেখতাম না। একই ভাবনা, আমার কাছেই তো থাকে, আমিই ডিডি ইস্যু করি, সুতরাং গুনে দেখার আর কি দরকার?

একদিন বিপত্তি ঘটলো। দেখা গেল ক্রমিক নম্বর ২৪ এর পরে ২৬, মাঝখানের ২৫ ক্রমিকের পাতাটি নেই। ম্যানেজার সাহেবকে বললাম, তিনি হন্তদন্ত হয়ে এসে বিষয়টি খতিয়ে দেখে পেরেশান হয়ে গেলেন। বললেন গতকাল দিনশেষে আপনি পাতাগুলো গুনে রাখেন নি? না বললে দায়িত্বে অবহেলা বুঝায়, হ্যাঁ বলতেও সঙ্কোচ লাগছিল যেহেতু মিথ্যে বলা হয়। আমতা আমতা করছিলাম। জিজ্ঞেস করলেন, প্রথম দিন গুনে কি একশ পাতা পেয়েছিলেন? তখন বললাম আপনার কাছ থেকে পাওয়ার পরে আর গুনে দেখার প্রয়োজন মনে করিনি। জিজ্ঞেস করলেন, এতদিন যে ব্যবহার করলেন কখনও কি গুনে দেখেন নি? জবাব দিলাম না, যেহেতু কাজটি আমি করতাম না, শুধুমাত্র ব্যালেন্স বা অবশিষ্ট পাতাগুলো হিসেব করে লিখে রাখতাম, গুনে দেখা প্রয়োজন মনে করতাম না।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

ম্যানেজার সাহেব দারুন অমায়িক এবং ভদ্র মানুষ ছিলেন। স্নেহের সুরে তিরস্কার করলেন, কাজটা ঠিক করেন নি ভাই! এখন তো মহা হুলস্থুল কান্ড হবে। হেড অফিসে রিপোর্ট করতে হবে, আপনাকে শোকজ করতে হবে! সাথে সাথে হেড অফিসে টেলিগ্রাম দেয়া হলো যে এত নম্বরের একটি ব্লাঙ্ক পাতা হারানো গেছে আমাদের শাখা থেকে। ব্লাঙ্ক পাতা হারানো মারাত্মক ঝুঁকির বিষয়, যে কেউ যে কোনো অঙ্ক লিখে কোনো শাখায় জমা দিয়ে স্বাক্ষর জাল করে টাকা নিয়ে নিতে পারে। পরের দিনই সার্কুলার লেটার ইস্যু হলো সারা দেশের সকল শাখার প্রতি সংশ্লিষ্ট পাতাটির বিষয়ে স্টপ পেমেন্ট এর নির্দেশনা দিয়ে। একই সাথে তদন্ত টীম এসে পড়লো বিষয়টি খতিয়ে দেখতে।

প্রাথমিক ভাবে তারা বললেন, মনে হচ্ছে এই বইটিতে বাঁধাই করার সময়ই একটি পাতা ইচ্ছা করে অথবা ভুলক্রমে কম দেয়া ছিল। কেননা এখান থেকে একটি পাতা ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে এমন কোনো আলামত মনে হয় না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অফিসার (আমি) দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, যদি নিয়ম মেনে প্রথম দিন গুনে নিতেন, তাহলে প্রথম দিনই বিষয়টি ধরা পড়তো। নিবন্ধটি আপনি পড়ছেন ব্যাংকিং নিউজ বিডি ডটকম-এ। পরবর্তীতে মাইল্ড ল্যাংগুয়েজে একখানা সতর্ক বার্তা খেলাম ভবিষ্যতে যেন এমন অবহেলা না করি।

বুঝলাম ব্যাংকিং এর শরীয়াতে ‘in good faith but without negligence’ নামে একখান কথা আছে যা যথাযথ ভাবে পরিপালন করি নি। good faith ঠিক আছে কিন্তু এখানে with negligence হয়ে গেছে। জীবনের প্রথম ধাক্কাটিতে অনেক শিখেছি, পরবর্তীতে এই কাজটি পরিপালনে সকল ক্ষেত্রেই যত্নবান ছিলাম। কি জেনারেল ব্যাংকিংয়ে, কি বিনিয়োগে, কি গ্রাহক নির্বাচনে কিংবা ডকুমেন্টেশনে!

লেখকঃ নূরুল ইসলাম খলিফা, সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও সাবেক প্রিন্সিপাল, ট্রেইনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, আলআরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button