বিশেষ কলামব্যাংকার

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যাংককর্মী

মো. জিল্লুর রহমানঃ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং আর্থিক সঞ্চালন অনেকটাই যেকোনো দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভর করে। মানব শরীরে ধমনি দিয়ে যেমন শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত প্রবাহিত হয়, তেমনি ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়ে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে অর্থের সঞ্চালন ও বিকাশ ঘটে। করোনাকালে ও করোনা-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক এবং আর্থিক পুনরুদ্ধারে ব্যাংকিং খাতের সুসংগঠিত ভূমিকা অনবদ্য ও অনস্বীকার্য। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করোনা-সংক্রান্ত অর্থনৈতিক এবং আর্থিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

করোনা মহামারির (সংক্ষেপে কোভিড-১৯) মধ্যে ফ্রন্টলাইনার যোদ্ধা হিসেবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। বর্তমানে দেশের ভয়াবহ এ দুর্যোগে দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের প্রায় আড়াই লাখ ব্যাংক কর্মকর্তা, কর্মচারী জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে দেশের ব্যবসায় ও মানুষের জীবনের প্রয়োজনে খাদ্য সরবরাহ, ওষুধ, জীবন রক্ষাকারী উপাদান, আমদানি রপ্তানিসহ নানা জরুরি ব্যাংকিংসেবা দিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রেখে চলেছেন। এ তালিকায় মাঠ প্রশাসন, পুলিশ, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাম সবার অগ্রগণ্য। কিন্তু তাদের প্রতিটি অবদান আলোচনায় আসছে ব্যাপকহারে। তাদের অবদান নিঃসন্দেহে শীর্ষে এবং আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যাংককর্মীদের চ্যালেঞ্জ, ত্যাগ ও ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়।

২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। এদিকে করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত বছর ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর ধাপে ধাপে সাধারণ ছুটি ও বিধিনিষেধ বৃদ্ধি করা হয়েছে। চলাচলেও নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সরকারি-বেসরকারি বেশির ভাগ অফিস বন্ধ ছিল। কিন্তু জরুরি পরিষেবা হিসেবে সীমিত পরিসরে করোনা মহামারির পুরোটা সময়ই ব্যাংক খোলা রাখা হয়।

করোনাভাইরাসের তিনটি ঢেউ বাংলাদেশে সংক্রমিত হয়েছে এবং অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বহু লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে। করোনা মহামারি প্রতিরোধের জন্য সামাজিক দূরত্ব খুবই কার্যকর একটি পদ্ধতি এবং সবার নিরাপদ টিকা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও মাস্ক পরার সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। এ কারণে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য তফসিলি ব্যাংক গ্রাহকদের অতিপ্রয়োজন ছাড়া সংশ্লিষ্ট শাখায় ভ্রমণ করতে নিরুৎসাহিত করেছিল এবং এ সময় তাদের ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের বিকল্প ঝুঁকিমুক্ত সেবাগুলো ব্যবহার করতে বারবার অনুরোধ করেছে। কিন্তু অনেকেই এ ধরনের অনুরোধ উপেক্ষা করেছে এবং গ্রাহকরা আগে থেকে এসব ডিজিটাল সেবায় অভ্যন্ত না হওয়ায় অনেকেই বাধ্য হয়ে ব্যাংকে সশরীরে উপস্থিত বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করেছে, যা ব্যাংকাদের এক ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। তখন এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে অনেকেই সংক্রমিত হয়েছে এবং অনেক ব্যাংককর্মী তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, যা অন্যান্য ফ্রন্টলাইনার যোদ্ধার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

আসলে ব্যাংকিং সেবা মানুষের জীবনের সঙ্গে এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এটাকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। মানুষের খাদ্য, ওষুধ, জীবন রক্ষাকারী উপাদান, নিত্যপণ্য সরবরাহ, আমদানি-রপ্তানি, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি, সামাজিক সুরক্ষার প্রণোদনাসহ এমন কিছু জরুরি প্রয়োজন ও চাহিদা রয়েছে; যা ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং জরুরি মুহূর্তে এসব সেবা খুবই প্রয়োজন হয়। এসব সেবা বিপদের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং বিশ্বস্ত সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। এজন্যই মূলত অনেক সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকলেও শুধু মানুষের বিবিধ জরুরি প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিংসেবা চালু রেখেছিল। ব্যাংককর্মীরাও তাদের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে এ চরম দুঃসময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে।

এজন্য তারা ফ্রন্টলাইনার করোনা যোদ্ধা হিসেবে গর্বিত। কিন্তু এ কথা সত্য, এ দেশের একদল নীরব কর্মী যারা অবলীলায় শুধু খেটে যান, কোনো প্রকার স্বীকৃতির প্রত্যাশা ছাড়াই, তারা হলেন ব্যাংকার। একজন ব্যাংকার লেনদেনের সময় করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। যেখানে ব্যাংক কর্মকর্তার সামনে গ্রাহকদের নিজেদের মধ্যে নিরাপদ দূরত্বে থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সেখানে কার আগে কে সার্ভিস নেবে, সেটা নিয়ে একজনের ঘাড়ের ওপর দিয়ে আরেকজন চেক দিয়ে টাকা উত্তোলন কিংবা জমা করার চেষ্টা করেন। এতে করে একজন ব্যাংকার খুব সহজে ব্যাংকের ভেতরেই মরণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

লকডাউনের মধ্যে ব্যাংক মাঝেমধ্যেই বন্ধ ছিল এবং ব্যাংকিং সময়ও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এসব কারণে ব্যাংকের খোলা তারিখগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়েছে এবং এ সময়েই অধিকাংশ ব্যাংককর্মী মানুষের সেবা দিতে গিয়ে সংক্রমিত হয়েছেন। তাছাড়া এ সময় গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক ব্যাংককর্মী অফিসে আসা-যাওয়ার পথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারেননি। অনেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারেননি। গাদাগাদি করে অফিসে আসা-যাওয়ার পথে অনেকেই সংক্রমিত হয়েছিলেন। তাছাড়া জীবনকে তোয়াক্কা না করে করোনাভাইরাস ব্যাংকারদের অফিসে যাওয়া-আসা কঠিন করে দিয়েছিল। পথেঘাটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা ছিল। লকডাউনের কারণে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তাই বাধ্য হয়েই অনেককে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েও অফিস করতে হয়েছে হতভাগা ব্যাংকারদের। এ সময় কখনো হেঁটে, কখনোবা সিএনজি, অটোরিকশায় যাতায়াত করতে হয়েছে। সময়ের প্রতি সদা সচেতন এই পেশাজীবীকে অফিসে উপস্থিত থাকতে হয় নির্ধারিত সময়ের আগেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ২৭ হাজার ২৩৭ কর্মী কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৪৩ জন মারা গেছেন। গত মে মাস পর্যন্ত আক্রান্ত ছিলেন ২৫ হাজার ৪০০ ব্যাংককর্মী। ওই সময় মারা যাওয়া ব্যাংকারের সংখ্যা ছিল ১৩৩ জন। এ হিসাবে গত জুনে ১ হাজার ৮৩৭ ব্যাংককর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন ১০ জন। জুলাই ও আগস্ট মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেড়েছে। করোনায় সর্বোচ্চ ব্যাংককর্মী আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে। ব্যাংকটিতে এখন পর্যন্ত ২৭ কর্মী মারা গেছেন। এরই মধ্যে গত বছর ২২ জন আর চলতি বছরে ৫ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের ১১ জন ও ন্যাশনাল ব্যাংকের ৭ জন করোনার জীবনযুদ্ধে হেরে গেছেন।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সাধারণ ছুটি, লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ সব ক্ষেত্রেই জরুরি সেবা হিসেবে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু ছিল। ব্যাংকারদের নানা প্রতিবন্ধকতায় অফিসে যাতায়াত এবং ব্যাংকিং সেবা দিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পরিপালন করা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে এখনো স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন ব্যাংকাররা এবং বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। তাই স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি অধিক গ্রাহক সমাগম ঠেকাতে অনলাইন ব্যাংকিংয়ে জোর দেওয়া উচিত।

কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ সময়ের সাহসী এই দুর্জেয় সন্তানরা শুধু করোনাভাইরাসের ক্রান্তিলগ্নেই নয়। দেশের যেকোনো সংকটের সময় হাসিমুখে এগিয়ে এসেছেন জাতির প্রয়োজনে। কখনো শিল্প কলকারখানার শ্রমিকের বেতন, বোনাস প্রদানে। কখনো কোনো নির্বাচন উপলক্ষে নমিনেশন সাবমিটের পে-অর্ডার। কখনোবা জাতীয় আয়কর রিটার্ন জমার পে-অর্ডার ইত্যাদি কোনো জাতীয় ইস্যুতে বন্ধের দিনে অনেক সময় ঈদের ঠিক আগের দিনেও ব্যাংক কর্মকর্তারা দেশ ও জাতির স্বার্থে নিজের প্রয়োজন, সুখ, আরাম জলাঞ্জলি দিয়ে আসছেন। আর্থিক খাত বিশেষত ব্যাংকিং খাত এমনিতেই বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে, তার ওপর এই মহামারির কারণে আরো সমস্যায় পড়বে। আর ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়েছে ব্যাংকগুলোর ওপর। এতে করোনা পরবর্তীকালে অর্থনীতিকে সচল করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণ, ঋণ আদায় করতে হবে। এ সময়ে খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট, মুনাফা কমে যাওয়া নানা ধরনের সংকটে পড়বে ব্যাংক খাত।

দেশের যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভূমিকা অগ্রগণ্য ও অনস্বীকার্য। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো এবং জিডিপির কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংকারদের এখন অনেক কাজ করতে হচ্ছে। ব্যাংকাররা এই মহামারির মধ্যে এখনো ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনকে চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকির মধ্যে রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

আরও দেখুন:
◾ ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরও বাড়লো
◾ ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা

এ সময় যখন তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো দরকার, তখন অনেক ব্যাংক বেতন-ভাতা কমাচ্ছে। অনেকে ছাঁটাই করছে। এই দুঃসময়ে ব্যাংককর্মীদের বেতনে কাটছাঁট করলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন। কারণ সবার জীবনযাপনে অনেক পরিবর্তন আসবে, তাদের কর্মস্পৃহা কমে যাবে; যার প্রভাব পড়বে খেলাপি ঋণ আদায়সহ নানাবিধ কার্যাবলিতে, যার ফলে ব্যাংকের ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধি যেমন কমবে, তেমনি কমবে মুনাফা। তবে যত বাধা ও চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন, করোনা মহামারির ফ্রন্টলাইনার যোদ্ধা হিসেবে ভবিষ্যতেও ব্যাংককর্মীরা দেশের যেকোনো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও আর্থিক সঞ্চালনে মানুষের পাশে থাকবে এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন।

লেখকঃ মো. জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার ও কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button