বিনিয়োগ ও লোনবিশেষ কলাম

ব্যাংকঋণ, ভর্তুকি, অস্তিত্বহীন কোম্পানি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

ড. আর এম দেবনাথঃ বাংলাদেশে কোম্পানির সংখ্যা কত? প্রশ্নটি তোলার কারণ আছে। আর সপ্তাহ খানেক পরই আমাদের ৫১তম মহান বিজয় দিবস। এ উপলক্ষে নানা আলোচনা হবে, অনুষ্ঠান হবে। টিভিতে টকশো হবে। অনেক ধরনের লেখা ছাপা হবে। এর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ওপর লেখা থাকবে। আমার ধারণা, বাংলাদেশে কোম্পানির সংখ্যা কত, এর ওপর নিবন্ধ থাকার সম্ভাবনা কম। অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা দিক নিয়ে আলোচনা থাকতে পারে। কিন্তু অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে ব্যবসার মালিকানার পরিবর্তন হচ্ছে, তার দিকে আমাদের নজর কম। ব্যবসা করতে গেলে পুঁজি লাগে, পুঁজি সংগৃহীত হয় ব্যক্তিগতভাবে। আবার পুঁজি একটু বেশি লাগলে দরকার হয় অংশীদারি ব্যবসার, যেখানে কয়েকজন অংশীদার পুঁজি সরবরাহ করেন। আরো বড় ব্যবসা করতে গেলে লাগে ‘প্রাইভেট কোম্পানি’।

তার পরের ধরন হচ্ছে ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’। এটা অনেক বড় কোম্পানি। হাজার হাজার মানুষ এ ধরনের কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার বা মালিক। এসব পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার স্টক এক্সচেঞ্জে বা শেয়ারবাজারে কেনাবেচা হয়। মালিকানা প্রতিদিন বদল হয়। মজা হচ্ছে, এতে কোম্পানির কিছু হয় না। কোম্পানি থাকে। কর্মচারী-কর্মকর্তারা থাকেন। ব্যবসা থাকে। এটাই হচ্ছে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির বৈশিষ্ট্য। এতে আরেকটা বিষয় হয়। যদি শেয়ার মালিকদের একটা ১০ টাকা মূল্যের শেয়ারের ১০ টাকাই পরিশোধ করা থাকে, তাহলে কোম্পানি ‘লালবাতি’ জ্বালালেও শেয়ার মালিকদের কোনো দায়দেনা থাকে না। ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’ লালবাতি জ্বালালে কোম্পানির কাছে যারা পাওনাদার, তারা শেয়ার মালিকদের কাছে টাকা ফেরত চাইতে পারেন না। এসব সুবিধার জন্যই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি খুব বড় বড় কোম্পানি হয়। তারাই করপোরেট সেক্টর।

যে দেশে করপোরেট সেক্টর যত বড়, যত শক্ত, সে দেশের অর্থনীতি তত শক্ত। এর পরই ‘প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির’ স্থান। এগুলো সাধারণত পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হয়। আমাদের মতো দেশগুলোয় এদেরও অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান। এক অর্থে বলা যায়, প্রাইভেট ও পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি মিলেই উন্নয়নশীল দেশগুলোয় করপোরেট সেক্টর গড়ে ওঠে বা উঠেছে। তারাই উন্নয়নে অবদান রাখছে। প্রশ্ন, আমাদের দেশে কোম্পানি ধরনের ব্যবসার অবস্থা কী? কত কোম্পানি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছর ধরে কাজ করছে? কত কোম্পানি সরকারের খাতায় রেজিস্ট্রিকৃত/নিবন্ধিত। কত কোম্পানি চালু আছে? ভুয়া কোম্পানি কী আছে? কত কোম্পানি সরকারকে আয়কর দেয়? এসব প্রশ্নের জবাব পেলে ব্যবসাজগতের পুঁজির মালিকানার ধরন বোঝা যাবে এবং বোঝা যাবে এর দুর্বল ও সবল দিক।

খুবই ভালো কথা যে কোম্পানি সম্পর্কে একটি জাতীয় পত্রিকায় বেশকিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান কয়েকদিন আগে ছাপা হয়েছে। এ থেকে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে প্রায় দুই লাখ কোম্পানি আছে, যারা সরকারের খাতায় নিবন্ধনকৃত। এর মধ্যে বহু কোম্পানি কাগুজে কোম্পানি, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছুদিন আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একটি জরিপ করে। এনবিআর ৮০ হাজার অস্তিত্বহীন কোম্পানির খোঁজ পায়। এসব অস্তিত্বহীন কোম্পানির কোনো ‘টিআইএন’ নেই। যেখানে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির অফিস, সেই কারওয়ান বাজারের দুটো বিল্ডিংয়ে ১ হাজার ৪০০ কোম্পানির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব কোম্পানির কোনো কার্যালয় নেই। ২০২০-২১ অর্থবছরটি ছিল কভিড-১৯-এর কারণে একটি অস্বাভাবিক বছর। অথচ সেই বছরেও কোম্পানি নিবন্ধন বেড়েছে ৩০ শতাংশ। বলা হয়েছে, এ বছর দিনে ৪৯টি কোম্পানিকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্যমতে, দেশে এ মুহূর্তে ১ লাখ ৮৬ হাজারের ওপর প্রাইভেট কোম্পানি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ৭০-৭৫ হাজার কোম্পানি আয়কর রিটার্ন জমা দেয়। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টটিতে এত অস্বাভাবিক নিবন্ধনের কারণ হিসেবে লোকবলের অভাবকে দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, রেজিস্ট্রার অফিস শুধু কাগজপত্র দেখে নিবন্ধন দেয়। সরেজমিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আবার নিবন্ধনের পরেও কোনো সরেজমিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই।

ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকিং, অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ খবর, প্রতিবেদন, বিশেষ কলাম, বিনিয়োগ/ লোন, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ফিনটেক, ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারগুলোর আপডেট পেতে আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ 'ব্যাংকিং নিউজ', ফেসবুক গ্রুপ 'ব্যাংকিং ইনফরমেশন', 'লিংকডইন', 'টেলিগ্রাম চ্যানেল', 'ইন্সটাগ্রাম', 'টুইটার', 'ইউটিউব', 'হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল' এবং 'গুগল নিউজ'-এ যুক্ত হয়ে সাথে থাকুন।

উপরোক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিই সবচেয়ে বেশি। পার্টনারশিপ ফার্মের সংখ্যা কত তা জানা যায়নি। আর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির সংখ্যা ৩৭১-এর মতো। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির মধ্যে বহু কোম্পানি কাগুজে, যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্বহীন কোম্পানির সমস্যা অনেক। অস্তিত্বহীন কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন যেমন পাওয়া যায়, তেমনি এর ব্যালান্স শিট, প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্টও তৈরি করা যায়। কোম্পানির রেজিস্ট্রেশনের জন্য দরকার মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন (এমএ) এবং আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশন (এএ)। এসব তৈরি করার জন্য লোক আছে, ফার্ম আছে। অল্প খরচে তা তৈরি করা যায়। যারা এটি করে তারাই রেজিস্ট্রেশনও জোগাড় করে দেয়।

একইভাবে কাগুজে কোম্পানি অথবা কর্মহীন কোম্পানির জন্য হিসাবপত্রও তৈরি করে দেয়া যায়। এর জন্যও ফার্ম আছে, যারা প্রাইভেট কোম্পানির ব্যালান্স শিট, প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ট, দরকার বোধে ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট তৈরি করে দেয়। সামান্য ফি নেয়। এর বিনিময়ে অস্তিত্বহীন, কর্মহীন কোম্পানির হিসাবপত্রও তৈরি করে দেয়া যায়। এর জন্যও ফার্ম আছে, যারা প্রাইভেট কোম্পানির ব্যালান্স শিট, প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ট, দরকার বোধে ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট তৈরি করে দেয়। সামান্য ফি নেয়। এর বিনিময়ে অস্তিত্বহীন, কর্মহীন কোম্পানির হিসাব তৈরি করে দেয়। মুশকিল হচ্ছে, এ ধরনের কোম্পানিও ওইসব কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংকঋণ জোগাড় করে ফেলে। আবার এসব তৈরি কাগজপত্র ও হিসাব দেখিয়ে অনেক সমস্যা থেকেও অনেক কোম্পানি মুক্তি পায়। এক্ষেত্রে পাকিস্তান আমলের একটি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের কিছু উদাহরণ এখানে দেব, যার থেকে ‘কাগজপত্র’ কী ভূমিকা পালন করে তা বোঝা সহজ হবে।

তখন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) গভর্নর বটতলার উকিল খ্যাত আবদুল মোনায়েম খান। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের প্রতিনিধি। তিনি হঠাৎ ক্ষেপে গেলেন একটি বামপন্থী খবরের কাগজের ওপর। পূর্ব পাকিস্তানে তখন বামপন্থীরা বেশ প্রভাবশালী। ছাত্র ইউনিয়ন নামের একটি ছাত্র সংগঠন, উদীচী, ছায়ানট ইত্যাদি সংগঠন খুবই দাপুটে। তাদের সমর্থক ওই পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে এটি দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) টাকায় চলে। বিপদ। এর থেকে মুক্তি কীভাবে মিলবে? কাগুজে হিসাব তৈরি করল একটি ‘চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি’ ফার্ম। এর দ্বারা দেখানো হলো পত্রিকাটি তার নিজের টাকায় নিজে চলে। এ কাহিনী তখন মুখে মুখে। বলা বাহুল্য, স্বাধীন বাংলাদেশে এর ধরন বদলায়। তখন কোম্পানি ছিল। কিন্তু তার ‘চালচুলো’ ছিল না।

স্বাধীনতার পর যখন বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয় ১৯৮২-৮৩-এর দিকে, তখন অনেক ব্যাংক মালিক ভিন্ন পথ ধরলেন। তারা কাগুজে কোম্পানি তৈরি করতে শুরু করেন। সুন্দর সুন্দর নামের কোম্পানি। মন ভরে যায় নাম শুনলে। কোম্পানির নাম ঠিক করা, তার নিবন্ধন জোগাড় করার জন্য বিশেষ বিশেষ বিভাগ সৃষ্টি করা হয়। উদ্দেশ্য নিজেদের ব্যাংক থেকে ওইসব কোম্পানির জন্য ঋণ নেয়া। বেনামি ঋণ ফৌজদারি অপরাধ। এ কাজ অনেক দিন চলল। কিন্তু ধরা পড়ে গেল ১৯৯০ সালের দিকে। তখনকার অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান কড়া হাতে বিষয়টি ধরেন। কিন্তু অপরাধের বিচার নয়। ব্যাংক খাতে এই প্রথম দুই নম্বরি কাজের রেহাই দেয়া হয়। বেনামি কোম্পানির নামে ঋণ নেয়ার অপরাধের কোনো বিচার না করে অন্য পথ ধরা হলো। যারা ঋণ নিয়েছে তাদের দিয়ে ওইসব ঋণ স্বীকার করানো হয়। ওই দায় তাদের ওপর বর্তানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জড়িত হয়ে ত্রিপক্ষীয় সমাধানের ব্যবস্থা করা হয়। হুকুম হয় কয়েক বছরে বিনা সুদে আসল টাকা পরিশোধ করার। পরিশোধের তফশিল করে দেয়া হয়। শুনেছি তারা ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করেছেন। তাহলে তো বলতে হয় এরা ভালো গ্রাহক। অন্তত টাকা ফেরত দিয়েছেন। কেইবা ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়?

স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে বেসরকারি খাতে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিরই আধিক্য। আলোচ্য রিপোর্ট অনুযায়ী কারওয়ান বাজারে এক ঠিকানায়ই রয়েছে ১ হাজার ৪০০ কোম্পানি। ভাবা যায়? আবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক জরিপে দেখা যায় ৮০ হাজার কোম্পানিই অস্তিত্বহীন। এটা কী করে সম্ভব। অস্তিত্বহীন কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন পেল কীভাবে? রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, দুই লাখ কোম্পানির জন্য পরিদর্শক মাত্র ছয়জন। স্বল্প পরিদর্শক দিয়ে এত বিপুলসংখ্যক কোম্পানির খোঁজখবর নেয়া সম্ভব নয়। বলা যায়, ওই সাফাইয়ের সুযোগেই এক ঠিকানায় ১ হাজার ৪০০ কোম্পানি গঠিত হয়েছে। এর দায়িত্ব কার? বিশেষ করে কে এখন বলবে এসব নাম-ঠিকানাহীন, অস্তিত্বহীন কোম্পানি ব্যবসা-বাণিজ্যে ‘ভালো-মন্দ’ কী করেছে? আদৌ করেছে কিনা? তারা সরকারের কোনো সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে কিনা, নিচ্ছে কিনা? তারা কি এ কোম্পানির নামে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিয়েছে? তাদের কেউ কি রফতানি দেখিয়ে সরকার থেকে ভর্তুকি নিয়েছে কিনা। এসব প্রশ্নের উত্তর দরকার। কারণ বিনা প্রয়োজনে মানুষ কোম্পানি তৈরি করেছে, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। কে একজন বলেছেন যে ভালো নাম পাওয়া যায় না, তাই ভালো নাম দিয়ে কোম্পানি তৈরি করে বসে আছেন কাজ করবেন বলে। হতে পারে। কিন্তু আমার প্রশ্ন তারা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে কিনা। অস্তিত্বহীন কোম্পানি ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নিয়েছে কিনা। প্রশ্নটি জাগছে কারণ এর উদাহরণ আছে আমাদের দেশে।

আমাদের দেশে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির প্রায় সবই পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। এর অনেকেই বিশাল বিশাল ব্যবসা করেন। ১০০, ২০০, ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ নেন। ঋণপত্র খোলেন ১০০, ২০০, ৩০০ কোটি টাকার। ট্রাস্ট রিসিটসহ নানা ধরনের ঋণ সুবিধা তারা নিচ্ছেন। ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড সুবিধা মিলিয়ে অনেক প্রাইভেট কোম্পানির মালিকরা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। চুটিয়ে ব্যবসা করছেন তারা। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, লবণ সবই তারা আমদানিও করেন। বড় বড় মিল-ফ্যাক্টরিও তাদের। তাদেরই ব্যাংক-বীমা ও লিজিং কোম্পানি। তারাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। একেকজন, একেক পরিবার একটা, দুইটা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির মালিক নন। তাদের মালিকানায় রয়েছে ডজন ডজন প্রাইভেট কোম্পানি।

এসব কোম্পানি একত্র করে আজকাল নাম দেয়া হয়েছে ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’ অথবা গ্রুপ। কে এই ‘গ্রুপের’ আবিষ্কর্তা জানি না। তবে এটা জানি ‘গ্রুপ’ বা ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজের’ কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। আইনি স্বীকৃতি হতে পারত যদি ‘গ্রুপ’ হতো ‘হোল্ডিং কোম্পানি’ আর বাকিরা হতো সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। কিন্তু তা নয়। কিন্তু তারা ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’ ব্যবহার করেন। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস এতে কোনো আপত্তি করছে না। সরকারও এ ব্যাপারে চুপ। অথচ কাজটি আইনসম্মত নয়। ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’ বললে একটি শক্তি বোঝা যায়। অথচ আমাদের দেশের ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’ বললে ওই গ্রুপের শক্তি বোঝায় না।

অথচ এ কৃত্রিম শক্তি দেখিয়ে তাদের অনেকেই ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ সুবিধা নিচ্ছেন। মজার ঘটনা হলো তারা ব্যবসা করেন হাজার হাজার কোটি টাকার। প্রকল্প ঋণ, ঋণপত্র খোলা, ট্রাস্ট রিসিট ইত্যাদি তাদের বড় বড় অংকের। কিন্তু কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন খুবই সামান্য। ২ লাখ, ৫ লাখ, ১০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন দিয়ে তারা ব্যবসা করেন হাজার হাজার কোটি টাকার। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পুঁজি গঠনের সহায়ক নয়। আরো ঘটনা হচ্ছে তারা বড় বড় ব্যবসা করলেও বা বড় বড় ‘সম্প্রসারণ’ করলেও কেউ ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’ করতে রাজি নন। এ ধরনের কোম্পানি করলে সাধারণ শেয়ার মালিকরা কিছু লভ্যাংশ পেতেন। বোঝাই যায় আমাদের করপোরেট সেক্টর লাভ ভাগাভাগি করতে রাজি নয়। লাভ পুরোটাই তাদের। বলতে গেলে তাদের কাছে ‘লাভ আমার, লোকসান সরকারের’। অথচ বাজার অর্থনীতিতে সরকারের জড়িত হওয়ার কথা নয়। সরকার করবে নীতি প্রণয়ন ও অবকাঠামো তৈরি।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি খাতের লোকসানের বোঝা সরকারকেই বহন করতে হচ্ছে। আবার প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন বা সম্পদ বৃদ্ধি না পাওয়ার ফলে তাদের ‘বন্ধক’ (মর্টগেজ) দেয়ার ক্ষমতা নেই। অথচ ‘মর্টগেজ’ দিতে না পারলে ‘ঋণ’ পাওয়ার কথা নয়। বিনা সিকিউরিটিতে ঋণ দেয়া হয় না। দেখা যায়, এ ফাঁকে আবিষ্কৃত হয়েছে করপোরেট গ্যারান্টি এবং পারসোনাল গ্যারান্টি। আমাদের দেশে এ ধরনের গ্যারান্টির মূল্য খুবই কম। আবার অনেক মালিক বেনামি মালিক দাঁড় করায়। ওই লোকের নামে কোম্পানি করে। রেজিস্ট্রেশন হয়। সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন জোগাড় করা হয়। অথচ প্রকৃত মালিক থাকেন পেছনে। এটা হচ্ছে নতুন নতুন ঋণ নেয়ার একটা ফন্দি। এগুলো সেই অর্থে বেনামি কোম্পানি। আবার অনেক সময় প্রকৃত মালিক এক পর্যায়ে ওইসব কোম্পানির শেয়ার কিনে তার নিয়ন্ত্রণ সরাসরি নিয়ে যান। পরিশেষে বলা দরকার, কোম্পানি জগতে এসব নানা ঘটনা ঘটছে। সরকারের উচিত এসব ক্ষেত্রে নজর রাখা। বেনামি কোম্পানি, অস্তিত্বহীন কোম্পানি গঠন করে কেউ যাতে ঋণ নিতে না পারে, ভর্তুকি নিতে না পারে, প্রয়োজনীয় টাকা নিতে না পারে, সেসব দিকেও নজর রাখা দরকার।

লেখকঃ ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রিলেটেড লেখা

Back to top button